আমরা ভিখারিদাস, মৃত্যুচরণ এবং তার স্ত্রী চন্দ্রমুখীকে চিনি।প্রথম দুজন মাতাল এবং ডাক্তার। ভিখারিদাস জীবনভর ভিখারি, অসফল এবং পরমুখাপেক্ষী একজন ডাক্তার। বিশেষতঃ মদ বিষয়ে মৃত্যুচরণই তার ভরসা, মৃত্যুচরণ জাঁদসাইটে ডাক্তার।অথৈ পশার। উভয়ে অভিন্নহৃদয় বাল্যবন্ধু- প্রবল মতবিরোধ সত্ত্বেও।
অদ্য রবিবার। সকাল সকাল ভিখারিদাস মৃত্যুর কাছে এসেছে।আজ দ্বিপ্রাহরিক ভোজন এখানেই হবে। চন্দ্রমুখী মেনুকার্ড ধরিয়ে দিয়েছে। তোপসে মাছভাজা, কাৎলার মুড়ো দিয়ে সোনামুগের ডাল, সর্ষেপাব্দার ঝোল, ফুলকপি দিয়ে কই মাছ, নোনা ইলিশের ঝাল ঝাল তরকারি, শোলমাছের কালিয়া, তেঁতুল দিয়ে চুনোমাছের টক। ইলাহী ব্যাপার। পুরো মৎসমুখী।
একটু আগেই মৃত্যুর কাজের বৌটা এসে বরের অসুখ বলে’ ফিঁচকাঁদুনি গাইছিলো। মৃত্যুচরণ আগামীকাল সাদরে তাকে নিজের চেম্বারে ডেকে নিলো। ওর বরের( যে কিনা সকালে মোড়ের মাথায় ফল বিক্রি করে এবং বাকি সময় সাইকেলে করে বড়ো বড়ো বোতলে ভরে’ জল সাপ্লাই করে) কম্প দিয়ে জ্বর, পেটে ব্যথা, বমি। ওরা সামনের খালপাড়ে বস্তিতে থাকে।ভিখারিদাস মাঝে মধ্যে ওখানেও আড্ডা দিতে যায়।
ভিখারিদাস প্রশ্ন করে “হ্যাঁ রে মড়া, তুই ধবধবি চিনিস? গেছিস কখনও?”
মৃত্যুচরণ যৎপরনাস্তি বিষ্মিত হয়ে বলেন “সেটা কোথায়? সেখানে যাবো কেন? সেখানে কি হয়?”
“সেটা বারুইপুরের দুটো স্টেশন পরে। ওখানে তন্ত্র মন্ত্র বাণ মারা, মরণ উচাটন ইত্যাদি হয়। পীরবাবাদের বাড়ি। বাড়ি বাড়ি পীরবাবা। এই সব গরীব লোকেরা ওখানে যায়। সম্ভবতঃ এই লোকটার লিভার অ্যাবসেস হয়েছে। তুই তোর কাজের লোকের যতো ভালো চিকিৎসাই কর না কেন, ওদের ওষুধ কেনা, পরীক্ষা করা কিছুই সম্ভব নয়। ঐ অশিক্ষিত মালটা বরের পরা একটা শার্ট নিয়ে পীরবাবার কাছে যাবে। গিয়ে পাঁচশো টাকার হোম করবে, তারপর তিনদিন নিরামিষ খেয়ে’ সম্পূর্ণ কালো কুকুরের পাছুর পাঁচটা লোম দিয়ে মাদুলি করে’ অসুস্থ মানুষের গলায় পরাবে।এবং মরবে। তারপর ওরা সবাই তোর বাড়িতে ঝামেলা করবে”
ভিখারিদাস কান এঁটো করা হাসি হাসেন। মৃত্যুচরণ গুম হয়ে থাকেন।
“অশিক্ষিত, অভুক্ত মানুষকে, শিক্ষা, বিজ্ঞান চেতনা আর আর্থিক সচ্ছলতা না দিয়ে তুই বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা দিবি? হয় না, সিম্প্লি হয় না……”
“আচ্ছা ঠাকুরপো তুমি এ্যাতো জানো, এ্যাতো তোমার গুণ, তুমি আইবুড়ো থেকে গেলে কেন?”
“বৌঠান, সবটুকুই আপেক্ষিক। মড়া (মৃত্যুচরণ) যদি এ্যাতো টাকা ইনকাম না করে’ শুধু ঘরে বসে’ বসে’ সন্ধেবেলা বন্ধুর সঙ্গে বাংলু খেতো, তাহলে আপনিও ওকে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিতেন।এ্যাখন দ্যান না। কারণ এ্যাখন ওর আমদানি ভালো হচ্ছে।তেমনি আমার জীবনেও অনেকেই এসেছে, কিন্তু যখন তারা দেখেছে,সকালে ব্যাগ নিয়ে বেরোয় অথচ দিনশেষেও লোকটার পকেট শূন্য। না আছে টাকাকড়ি, না আছে নামযশ তখন সবাই কেটে গেছে। তখন খেলা ভাঙার খেলা। যখন দেখেছে লোকটা ভালো খাবার আর ভালো মদের জন্য বন্ধুর বাড়ি চলে যায়, তখন বুঝেছে চকোলেট আর বাথডে গিফ্ট এ মালটা দিতে পারবে না… তখন অচিন পাখি ফুড়ুৎ….”
মৃত্যুচরণ চ্যাঁচান “শাল্লা, বোকাচ্চো তোর সঙ্গে খাবারের সম্পর্ক?তোর সঙ্গে কতো ছোটবেলা থেকে…..তুই আমাদের ফ্রেন্ডশিপের ইয়ে করছিস…..” মৃত্যুর চোখ ছলছল করে।
ভিখারিদাস হাহা হাসেন “জানিসই তো….আমি জন্ম কাঙাল… যাগ্গে লাইনে আয়। সেবা কাকে বলে? তোরা সেবা করিস, না পরিসেবা দিস?”
মৃত্যুচরণ উল্টে প্রতিধ্বনি করেন “সেবা কাকে বলে?”
গোলগাল বৌঠান বলেন “ঠাকুরপো, শেষপাতে দৈ খাবে, আনাবো?”
ভিখারি ঘাড় নাড়ে।
“তবে শোন, সেবা হচ্ছে সার্ভিস, হাজিরা, পূজা; আর পরিসেবা হচ্ছে নার্সিং কেয়ার, তুই কোনোটাই দিস না। তুই জাস্ট গিয়ে স্টেথো বসিয়ে ভিড় কমিয়ে চলে আসিস। ওরাও ঈশ্বর দর্শনের মতো…..”
“তাহলে নর্ম্যান বেথুন কী করতেন ব্বে? যুদ্ধক্ষেত্রে?”
“বল কোন কোন যুদ্ধক্ষেত্রে উনি গেছেন?”
“ইয়ে মানে ঠিক ইয়ে হচ্ছে না…” মৃত্যু টাক চুলকোয়।
“উনি সোভিয়েত দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখে, যেখানে যেখানে কমিউনিস্টরা লড়াই করেছে, সেখানে সেখানে গিয়ে কমিউনিস্টদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, অথচ কোনও পার্টিই ওনাকে কমিউনিস্ট বলে স্বীকার করে নি। উনি কমিউনিস্টদের তৈরি সাধারণের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য প্রাণপাত করেছেন। ওটাই ওনার লক্ষ্য ছিলো। মানুষকে রক্তদানের প্রয়োজন বোঝাতে, সবার সামনে দাঁড়িয়ে মরণাপন্নকে রক্ত দিয়ে মরণাপন্নকে কথা বলিয়েছেন। তখন বন্ধুদের রক্ত দিতে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়েছে। ভীড় উপচে পড়েছে। আর আমরা শুধু স্টেথো বসিয়ে চলে আসি, আমরা…”
চন্দ্রমুখী বাধা দেয় “ঠাকুরপো, তোমার জন্য একটা মেয়ে দেখবো? ওমা না ওভাবে হাসলে হবে না, সত্যি বলছি…”
ভিখারিদাস ঠা ঠা করে’ হাসতেই থাকে। মৃত্যুচরণ বোতল থেকে সোডা মাপ মতো মিশিয়ে বলে “আয় রে গান্ডু চীয়ার্স করি, মালের গেলাস হাতে না নিলে তোকে মানায় না কো”