থ্যালিডোমাইড ওষুধটা ১৯৫০ এর দশকে জার্মানিতে Chem Grunenthal নামক এক ওষুধ কোম্পানি দ্বারা আবিষ্কৃত হয়। বেশ কিছু এনিম্যাল স্পেসিস ও মানুষের ওপর এর ট্রায়াল হয়। এই ট্রায়ালের নানান ভুল ছিল। ওই এনিম্যাল বা হিউম্যান সাবজেক্ট গর্ভবতী ছিল না। ডাবল ব্লাইন্ড স্টাডি হয় নি। কোনো প্লেসিবো দেওয়া হয় নি। রক্ত অথবা কোষকলাতে ওষুধের মাত্রা মাপা হয় নি। এই অবস্থায় এই ওষুধটিকে ঘুমের ওষুধ হিসেবে বাজার জাত করা হয়। এর পাশাপাশি দেখা যায় যে ওষুধটি গর্ভবতীদের মর্নিং সিকনেস বা গা বমি ভাব কমাতে দারুণ কাজ করছে। চিকিৎসকরা দেদার লিখতে শুরু করেন। হাজারে হাজারে মায়েরা ওষুধ খেয়ে ফেলেন।
১৯৫০ এর দশকের শেষ ভাগ থেকে রিপোর্ট আসতে শুরু করে (বাজারজাত করার তারিখ ১ লা অক্টোবর, ১৯৫৭) যে ওই ওষুধ সেবনকারী মেয়েদের অনেকের বিকলাঙ্গ নবজাতক জন্ম নিচ্ছে যাদের হাত পা নেই বা ছোট। ফোকমেলিয়া। বাচ্চাগুলো সিলমাছে মতো দেখতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য করা দরকার যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ-র ডাক্তার ফার্মাসিস্ট ফ্রান্সেস কেলসি-র কঠোর আপত্তির ফলে ও দেশে ওষুধটি ছাড়পত্র পায় নি।
১৯৬১ সালে এক অস্ট্রিয়ান ডাক্তার উইলিয়াম ম্যাকব্রাইড প্রথমবার সিডনির মহিলা হাসপাতালে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে সফল হন। তিনি ল্যানসেট জার্নালে প্রবন্ধ লিখে জানান। সেই ফলাফল সামনে আসতে অবশেষে সেই জার্মান কোম্পানি ২৬শে নভেম্বর ১৯৬১ সালে ওষুধটিকে ইউকে-র বাজার থেকে তুলে নেন।
ইংল্যান্ডের ভিক্টর ন্যাপ, জর্জ ক্রিস্টি ও মেরি সেলার ১৯৬২ সালে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করে বলেন যে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর ও খরগোশের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে তাঁরা তাদের সন্তান সন্ততির ওপর ওই ওষুধের কোনো টেরাটজেনিক কুপ্রভাব খুঁজে পান নি। এবং এর ভিত্তিতে বল যায় যে ওই ওষুধটা মানুষের জন্য নিরাপদ।
এর পর ১৯৬৩ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডে “কমিটি অন সেফটি অফ ড্রাগস” নামে একটা কমিটি তৈরি হয়। এর আগে ওই জাতীয় কোনো কমিটি তৈরি হয় নি। তাঁরা ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর ও খরগোশের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে ভ্রূণের ওপর কোনো ওষুধের সাইড এফেক্ট মাপার জন্য বিশদ সুপারিশ তৈরি করেন। এর পরে নতুন করে সঠিক স্টাডি ডিজাইন মেনে আবার গবেষণা শুরু হয় গর্ভবতী এনিম্যাল মডেল নিয়ে।
অবশেষে ঠিকঠাক ভাবে যখন এনিম্যাল স্টাডি হল তখন দেখা গেল যে ওই ওষুধের ফলে গর্ভপাত থেকে শুরু করে চোখ, মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নানান জায়গায় ওষুধের বিষাক্ত প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ওই স্টাডি ডিজাইনের বিশদ বিবরণ দেওয়ার অবকাশ নেই। কেবল দু একটি ইন্টারেস্টিং জায়গা বলা যেতে পারে। যেমন, এটা দেখা গেছে যে স্টাডির বেশির ভাগ এনিম্যালই রাতের দিকে সন্তানের জন্ম দেয়, আর যে বাচ্চাগুলো বিকলাঙ্গ জন্মায় তাদের ওরা খেয়ে ফেলে। তাই সকালে এসে ল্যাব টেকনিশিয়ানরা কেবল সুস্থ বাচ্চাগুলোকে দেখতে পেত। সারারাত ধরে পর্যবেক্ষণ ও সিজারিয়ান সেকশন করে দেখা গেল যে সত্যি সত্যিই বিকলাঙ্গ বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে। এসব ফলাফলের পরে ১৯৬৮ সালে ইউকে-তে মেডিসিন এক্ট তৈরি হয়।
আজ বিভিন্ন ওষুধ ভ্যাকসিন ইত্যাদি বাজারজাত করার আগে সরকারি ভাবে যে ছাড়পত্র পেতে হয় সেগুলো তৈরির এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। বিজ্ঞান নানান বেদনাদায়ক ভুল করতে করতে এগিয়েছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে বিজ্ঞান কোনো মৌলবাদী ধর্ম শাস্ত্র নয় যে সে অভ্রান্ত বলে দাবি করতে পারে। বিজ্ঞানের দর্শনের মধ্যে অন্তর্লীন উপাদান হচ্ছে তার এই ভ্রান্তির সম্ভাব্যতা যাকে কার্ল পপার ফলসিফায়েবিলিটি আখ্যা দিয়ে ছিলেন।
মরণশীল মানুষ ভুল করবে, করতে করতেই এগোবে। অসংখ্য বিজ্ঞানীর সাধনার ফলে কঠোর পরিশ্রমের ফলে আমরা সঠিক রাস্তা খুঁজে পাবো, ইঁদুরের বাচ্চার জন্ম দেওয়া দেখতে সারারাত ধরে জেগে থাকা ওই উন্মুখ মানুষগুলোর কথা মনে রাখবেন। মনে রাখবেন যে কোনো আকাশের দৈববাণী আমাদের সঠিক রাস্তা বাৎলে দিয়ে যাবে না, থ্যালিডমাইড এই শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছে। আমরা হাল ছেড়ে দেবো না