[পথচলতি স্বল্পবাস পরিহিত কোনও মহিলাকে দেখে, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মনে যে ক্রমিক দৃশ্য ভেসে ওঠে তার পরিসমাপ্তি ঘটে একটি শিশুর জন্মের মধ্য দিয়ে। – লু শুন]
১৯৮২ র কোন এক সময়ে নিয়োগীজী আমায় তাঁর সঙ্গী হয়ে হোসাঙ্গাবাদ যেতে বললেন – ‘চলুন দেখে আসি অনিল সদগোপালজীরা কি করছেন সেখানে।’
সত্তরে, চিকিৎসক বন্ধুদের দুটি আলোচনাচক্রে আমি যোগ দিয়েছিলাম, সেখানে আমি প্রথম ‘কিশোরভারতী’ সম্পর্কে শুনি। সেই থেকে তাঁদের কাজকর্ম নিজের চোখে দেখার একটা আগ্রহ আমার মনে জন্মায়। এখন নিয়োগীজীর সাথে সেখানে দুই দিন কাটানো মানে আমার কাছে এক বাড়তি উদ্দীপনা।
আমি নিয়োগীজীর ডাকে খুশী হয়ে সাড়া দিলাম।
যথা সময়ে দূর্গ স্টেশন থেকে আমরা একটি ট্রেনে চেপে বসলাম এবং সহজে দুজনে মুখোমুখি বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে মোট আট ঘন্টার সফর ছিল এবং আমরা নানাবিষয়ে কথা বলে সময় কাটিয়েছিলাম। যার মধ্যে মুখ্য আলোচনার বিষয় ছিল আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে। নিয়োগীজী নিশ্চিত ছিলেন যে আগামী বছরের মধ্যেই হাসপাতাল বিল্ডিং তৈরী হয়ে যাবে এবং তিনি হাতে পেয়ে যাবেন। যদিও ইউনিয়নের আর্থিক অবস্থা দেখে সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সংশয় ছিল। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার, পরের বছরের মধ্যে, বাইরের কোনও সাহায্য না নিয়ে, নিয়োগীজী হাসপাতাল তৈরী করে ফেললেন। সে আর এক গল্প।
কিন্তু তিনি আমার সংশয় পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং বলেছিলেন ‘ডাক্তার সাহেব সবসময় এগিয়ে থাকার স্বপ্ন দেখা ভালো। আপনি যদি স্বপ্ন পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন তাহলে অর্থ কিম্বা অন্য কোনো সমস্যা আপনার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।‘
এখানে বলে রাখি, দল্লি-রাজহরায় প্রথম দিকে আমাদের কোনও ডিসপেনসারিও ছিলো না। তখন আমার আর বিনায়কদার (ডা. বিনায়ক সেন) কাজ ছিল নানা মহল্লায় ঘুরে ঘুরে লোক জড়ো করে সভার আয়োজন করা এবং আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সেই লোকজনদের বোঝানো ও উৎসাহিত করা। যদিও বেশির ভাগ মানুষ আমাদের খুব একটা পাত্তা দিত না। আমরা হাতেকলমে কোনও রুগী দেখতাম না বলে তারা আমাদের গভীরভাবে নিত না, বিশ্বাসই করত না যে আমরা আদতে সত্যিকারের ডাক্তার। কেবল সেই কারণে আমরা ডিসপেনসারি চালু করেছিলাম। কিন্তু সেই সভা বা মিটিংগুলি করায় আমাদের প্রভূত লাভ হয়েছিল। লোকজনেদের মধ্য থেকে আমরা স্বাস্থ্যকর্মী বাছাই করি, যারা আমাদের কাজে যুক্ত হয়েছিল এবং আজও তারা দল্লি-রাজহরার শহীদ হাসপাতালে কাজ করছে।
সম্ভবত নাগপুর জংশনে নিয়োগীজী আমাকে তিন কি চার সারি পিছনে বসা একটি লোককে দেখিয়ে বললেন – ‘লোকটি সাদা পোষাকে পুলিশের লোক, দূর্গ থেকে আমাদের পিছু নিয়েছে, এখন এর ছুটি হয়ে যাবে অন্য একজন আসবে’। সত্যিই একজন নতুন লোক এলো আর লোকটির ছেড়ে যাওয়া জায়গায় বসে পড়ল।
* * *
আমরা মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদ স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে একটি বাস ধরে পালিয়া পিপারিয়াতে কিশোরভারতীর সদর দপ্তরে পৌছালাম।
যাঁরা কিশোরভারতী সম্পর্কে অবগত নন, তাঁদের সংক্ষেপে জানাই – ১৯৭২ সালে অনিল সদগোপাল নামে একজন বিজ্ঞানী, টাটা ইনিস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (TIFR)-এর মলিক্যুলার বায়োলজি ইউনিট থেকে পদত্যাগ করে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এই দূর্গম জায়গায় ‘কিশোরভারতী’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন। শুরুতে সংস্থা সেই অঞ্চলের, যেমন হোসেঙ্গাবাদ জেলার বানখেড়ি ব্লকে, আর্থিক বিকাশ সংক্রান্ত কাজকর্ম এবং গান্ধী মতাদর্শে ‘নই তালিম’ পরীক্ষানিরীক্ষার দায়িত্ব হাতে নেয়।
১৯৭২ সালে কিশোরভারতী, রাসুলিয়ার ফ্রেন্ডস রুরাল সেন্টারের সহযোগে হোসেঙ্গাবাদের ষোলোটি সরকারী মিডিল স্কুলে (ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী) ‘হোসেঙ্গাবাদ সাইন্স টিচিং প্রোগ্রাম’ (HSTP) শুরু করলে তা ভারত তো বটেই এমনকি বিদেশের মানুষদেরও নজরে আসে। বহু বিজ্ঞানী, পণ্ডিত এবং শিক্ষাবিদেরা এসে এই কর্মকান্ডে যোগ দেন। ১৯৭৮ সাল নাগাদ HSTP হোসেঙ্গাবাদ জেলার ২৮০-র বেশী মিডিল স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে HSTP-কে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে কিশোরভারতী ‘একলব্য’ প্রকল্প শুরু করে, এবং এর শিক্ষানীতি অন্য বিষয়েও প্রয়োগ করে।
* * *
নিয়োগীজীর মত অনিল সদগোপালজীও একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। বলিষ্ঠ (এখন তাঁকে দেখলে আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না), সামান্য টাকমাথায় অবিন্যস্ত কেশ, ঘন কালো দাড়ির মাঝে দু’একটা সাদা্র ঝিলিক। তিনি আমাদের তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এবং অনাবিল হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
আমরা সেখানে দু’দিন ছিলাম।
যেহেতু স্মৃতি সময়ের সাথে সাথে ঝাপসা হয়ে আসে এবং বিড়ম্বিত করে, তাই কিশোরভারতীতে ঠিক কি ঘটেছিল তাঁর বর্ণনা আমি না দিয়ে বরং ‘সংঘর্ষ আউর নির্মাণ’ বইয়ে স্বয়ং অনিল সদগোপালজীর হিন্দীতে লেখা স্মৃতিকথা ‘জনতা সে জুড়তে হি বন্দুক দিখ জাতা হ্যায়’ থেকে নেওয়া যাক।
‘এপ্রিল ১৯৮২, স্থান -কিশোরভারতী সংস্থার প্রাঙ্গণ, বনখেড়ি, জেলা হোসেঙ্গাবাদ। কিশোরভারতী এবং বিদূষক কারখানার (শাডোল জেলায় দুনু রায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত) যৌথ উদ্যোগে মধ্যপ্রদেশের স্বয়ংসেবী সংস্থাগুলি এবং অন্যান্য নির্দলীয় জনসংগঠনগুলির বৈঠক। পুরো সভায় নিয়োগীজী ছিলেন মধ্যমণি, যদিও গোটা দিন তিনি একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। উষ্ণ রাজনৈতিক তর্ক বিতর্ক শান্তভাবে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন আর মাঝেমধ্য মৃদু হাসি দিয়ে উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলেন। একসময় আচমকা তিনি সভা ছেড়ে উঠে যান। খোঁজ নিয়ে জানা গেল কিশোরভারতী সংলগ্ন বন দেখতে গেছেন। স্থানীয় মানুষদের কাছে গাছের নাম জেনে নিচ্ছেন কিম্বা ভেষজ গুল্মের গুণাগুণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
দ্বিতীয় দিন সভা যথা্রীতি শুরু হলো, কিন্তু নিয়োগীজীকে দেখা গেলো বীজ বা বিচিহীন লেবুর বাগানে ঘুরে বেড়াতে। সেই সময় তিনি দল্লি-রাজহরাতে বিরল প্রজাতির গাছপালার একটি বাগান করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং সেই কারণে খোঁজ করছিলেন দূর্লভ জাতের এই লেবু গাছের কিছু চারা জোগার করা যায় কি না। তাঁকে টেনেটুনে বৈঠকে নিয়ে আসা হলো ।
‘শাসক শ্রেণীর বর্বর আক্রমণের মোকাবেলা আমরা কেমন করে করতে পারি?’ সভা থেকে নিয়োগীজীকে জিজ্ঞাসা করা হলো – ‘বলুন আমরা কি ভাবে প্রস্তুত হবো?’
নিয়োগীজী হাসছেন, কিছু বলছেন না। যখন তাঁকে চেপে ধরা হল তিনি জামার পকেট থেকে দেশলাই বার করলেন, একজনের কাছে বিড়ি চাইলেন, জ্বালালেন। এক লম্বা টান দিলেন । তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ বঙ্গীয় বাচনভঙ্গী মিশ্রিত হিন্দিতে বললেন – দেখুন, এই যে মধ্যবর্গীয় তরুণেরা, বিপ্লবী, লেখাপড়া জানা যুবকেরা – এদের একটি বড় ভারী সমস্যা রয়েছে। যেদিন থেকে তারা জনগণের কাজে যোগদান করে এবং আন্দোলনে প্রথম পা রাখে, সেদিন থেকেই তারা বন্দুকের নল দেখতে পায়। এই ভাবনার কোনও ওষুধ নেই। শ্রমিকেরা এমন নয়, পুলিশের বন্দুকের নল তারা প্রবল সংগ্রামের পর দেখতে পায়। তার মাঝেই আন্দোলন গড়ে ওঠে।‘
সমস্ত সভা স্তব্ধ, প্রশ্ন যেমন কি তেমনই রয়ে গেল। বুদ্ধিজীবীদের তর্ক বিতর্ক, তাদের জটিল পরিভাষা হঠাৎ থেমে গেল।
নিয়োগী ফের ব্যাখ্যায় এলেন, ‘দেখুন, এই মধ্যবর্গীয় যুবকেরা খুবই লেখাপড়া জানা, তত্ত্ব বোঝে, সেইজন্য অনেক দূর অবধি দেখতে পায় এবং এক বিমূর্ত স্তর পেরিয়ে বিভিন্ন সম্ভাবনা এবং শাসকশ্রেণীর প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়। সেইখানে শ্রমিকেরা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় যা ঘটে তাই বোঝে।‘ তর্ক সহজে মেটার জায়গায় আরও ‘জটিল’ হলো। সভার নিস্তব্ধতা আরও গহীন হলো।
আমি আজ অবধি সেই শব্দগুলির গভীরতায় নিজেই ঘুরপাক খাচ্ছি। ওই শব্দগুলিতে লেনিন আর গ্রামশীর মাঝে সেই ‘মধ্যমবর্গীয়-বুদ্ধিজীবী’-র সন্তুলন খুঁজে বেড়াই যা নিয়োগী দানীটোলা খনিতে পাথর ভাঙতে ভাঙতে এবং কেরী-জুঙরায় ছাগল চড়াতে চড়াতে আত্মস্ত করেছিলো’।
* * *
মনে আছে আমার অনেকটা সময় কেটেছিল বাবা মায়ারাম বলে একজন বুদ্ধিমান তরুণের সঙ্গে।
অন্যদিকে নিয়োগীজী এক নতুন ধরণের গবাদি খাদ্য (ফডার) বা জাবের ব্যাপারে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন, যা পুষ্টিকর কিন্তু হাল্কা চাষবাসেই ফলে। কিশোরভারতী বিশেষ গাছ নিয়ে সেই রকম পরীক্ষা্নিরীক্ষা চালাচ্ছিল। আমার যতদূর মনে হয় গাছটিকে সুবাবুল বলত।
কিশোরভারতীর কম্যুনিটি কিচেনের খাবারদাবার ছিল বেশ উৎকৃষ্ট। এক বছর ধরে খাওয়া CMSS-এর মেসের খাদ্যদ্রব্যের তুলনায় তো পাঁচতারা। যদিও রান্নাবান্না ছিল নিরামিষ। আমি আর নিয়োগীজী দুজনেরই তাদের পাতে দেওয়া লেবুর উপর নজর ছিল। সাধারণ লেবুর থেকে একটু বড়, কম টক এবং বিচি নেই ।
এগুলি হলো কলমের লেবু এবং নিয়োগীজী ঠিক করলেন যে এমন বিচিহীন লেবুর চারা আমাদের দল্লি-রাজহেরায় নিয়ে যাবো।
কিশোরভারতীর সৌজন্যে একশর মতো লেবুর চারা পাওয়া গেলো। ফেরার সময় নিয়োগীজী সেই চারাগুলি কাঁধে তুলে নিয়ে চললেন। বেশ ভারী বোঝা, আমি পীড়াপীড়ি করলাম অর্ধেক গাছ আমি বয়ে নিয়ে যাই। তিনি কান দিলেন না, বললেন – এসব কাজ ডাক্তারের নয়। দূর্গ স্টেশনেও চারার বোঝা বয়ে স্টেশনের বাইরে নিয়ে এলেন এবং মাটিতে রেখে বাস স্টান্ড পর্যন্ত যাওয়ার জন্য রিক্সা খুঁজতে লাগলেন। কয়েক গজ দূরে দেখি একটি লোক হাসি হাসি মুখে নিয়োগীজীর দিকে হাত নাড়াছে। লোকটি আমাদের কাছে এগিয়ে এসে বলল – ট্রেন তো চার ঘন্টা লেট আর আমি সেই থেকে এখানে অপেক্ষা করছি। এই এলে, এখন আমি নিশ্চিন্তে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করবো’। নিয়োগীজীকে কোনও এক দিন তার বাড়ীতে চা খাওয়ার নিমন্ত্রণও জানিয়ে রাখল। নিয়োগীজী প্রতিশ্রুতি দিলেন – যেতে পারলে খুশী হবেন। লোকটি ছিল সাদা পোষাকে পুলিশের লোক।
আমরা দল্লি-রাজহরার পুরানো বাজারে বাস স্টান্ডে নেমে পড়লাম। নিয়োগীজী যথারীতি চারার বোঝা নিয়ে নামলেন। কিন্তু তাঁকে ইউনিয়ন অফিস পর্য্যন্ত বহন করতে হলো না। কিছু শ্রমিক এসে বোঝা তুলে নিল।
* * *
প্রায় সমস্ত চারা গাছ ইউনিয়ন অফিসের পিছনের বাগানে লাগানো হলো । কিছু ইচ্ছুক কর্মচারীদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হলো, তাদের নিজেদের বাড়িতে লাগানোর জন্য। একদিন ফলে ফলে সুন্দর ভরে উঠল গাছগুলি। কিছু কর্মচারী বোতলে লেবুর শরবৎ বানিয়ে অফিসে রেখে দিল, অভ্যাগতরা দেখা করতে এলে তাদের এক গ্লাস করে লেবুর শরবৎ দিয়ে আপ্যায়িত করা হতো। কিছু স্বাস্থ্যকর্মী লেবু দিয়ে সুস্বাদু আচার বানালো যা আমরা নিয়মিত চেটেপুটে খেতাম।
[এই রচনায় অনিল সদগোপালজীর দেওয়া তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।]
ইংরেজী থেকে অনুবাদ—পূর্ণেন্দু শেখর মিত্র।