আজ ভোর থাকতেই ঘুম ভেঙে গেল শুভ-র। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। উত্তর কলকাতায় ঘরের জানলা দিয়ে আকাশ দেখার কোনও সুযোগ নেই। তবু আলো ফুটে উঠছে সেটা টের পেতে অসুবিধা হয় না। শুভ কাত হয়ে আধা ঘুম আধা জাগরণে শুয়ে থাকে। মাথায় ভাবনাগুলো পাক খেতে থাকে। কলেজে আজ তাড়াতাড়ি যেতে হবে। সুমিতাদি, বিভাসদা, আশীষদা ওরা সবাই মিলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। শুভকে ওরা দলে রাখতে চায়। নিজের মধ্যে বদলটা শুভ টের পাচ্ছে। সব কিছু কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। পড়াশোনা প্রায় করে না বললেই চলে। সিনিয়ররা ভরসা দিয়েছে পরীক্ষার আগে সবাই মিলে সাহায্য করে উতরে দেবে। শুভ-রও পড়াশোনার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। মিশনে থাকার তিক্ততা যেন এখনও মনটাকে বিষিয়ে রেখেছে। মেডিক্যাল কলেজের এই সংগঠনে যুক্ত হয়ে ও জানতে শুরু করেছে “Democracy, Unity and Progress” এই তিনটেই হচ্ছে সংগঠনের মূল স্তম্ভ। এই স্তম্ভই সমাজের উন্নতির সোপান। শুধু সমাজ কেন? পরিবারেও কি এই তিনটে খুঁটির প্রয়োজন নেই। যে পরিবারে সদস্যদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার থাকে না, একতার সুর সদস্যদের এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারে না সেই পরিবারের অগ্রগতি কি রুদ্ধ হয় না! সে তো নিজের জীবন দিয়ে তা বোঝে। মাকে সে দেখেছে, কি ভাবে পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়েছে। যথেষ্ট বিদুষী হওয়া সত্ত্বেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে নি বাবা নামক এক পুরুষের সিদ্ধান্তে। বিয়ের পরে সংসার নামের শোষণ যন্ত্র তার ওপরে চাপিয়ে দিয়েছে স্বামী নামক আরেক পুরুষের দায়, দায়িত্ব, সিদ্ধান্ত। তার পরিণাম অসন্তোষ, হতাশা। কোথাও গিয়ে কি সম্পর্কের উত্তোরণের পথে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি!
আশীষদার সঙ্গে আলাপের পর যে কথাগুলো মাথায় ঢুকে গেছিল সেগুলো যেন শুভকে তাড়া করে বেড়ায়। তাদের পরিবারে শুভ তিন নম্বর প্রজন্ম যে কিনা ডাক্তার হতে চলেছে। তার ওপর ছোট থেকেই তার চোখের সামনে জেঠুকে দেখেছে। বাবাও সব সময়ে একই কথা বলতেন বড় হয়ে জেঠুর মতো ডাক্তার হতে হবে। জেঠুর মতো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হওয়া শুভ এক ধাক্কায় কেমন করে যেন একটা অন্য রকম ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে ক’মাস যেতে না যেতেই সে অনুভব করতে শুরু করেছে পসার জমানো ডাক্তার নয় সে অন্য রকম ডাক্তার হতে চায়, মানুষের মতো মানুষ হতে চায়। স্কুলে ক্রমাগত সহপাঠীদের কাছে অপদস্থ হতে হতে যখন আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল তখন তার বালক মনে অসীম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল রুশ পাইলট বরিস পলেভয়ের লেখা “মানুষের মতো মানুষ”। মানুষের জীবনে শত বাধা শত যন্ত্রণা শত প্রতিরোধ থাকা সত্ত্বেও সে এগিয়ে যায় মনের জোরে। যেমন গেছিল অ্যালেক্সেই। যুদ্ধে কাটা পড়া পায়ের বদলে কৃত্রিম পা লাগিয়ে চলতে গিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিজেকেই বলেছিল আজ পারছে না বটে দৌড়োতে, কাল পারবে, কাল যদি না পারে তা হলে পরশু…… চুলোয় যাক দৌড়বেই সে। এই আত্মবিশ্বাস তাকে মুগ্ধ করেছিল। আলেক্সেই করে দেখিয়েছিল। আবার সে যুদ্ধ বিমান চালিয়েছিল। আজ যেন নতুন করে তার মধ্যে জেগে উঠছে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার তাগিদ। মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্রাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোশিয়েসন তার ভেতরে একটা পরিবর্তন আনছে। যত শুনছে, দেখছে, জানছে শুভ তত বদলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সে ডা. দ্বারকানাথ কোটনিশের জীবন, তাঁর কর্ম ক্ষেত্র, তাঁর নিরলস সেবার কথা পড়েছে। জেনেছে ডা. নর্মান বেথুনের কথা। তার সংবেদনশীল মনে ছাপ ফেলেছে তাঁদের নিঃস্বার্থ সেবা, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত। সত্যিই তো। ডাক্তার হলে এমন ডাক্তার হওয়াই দরকার। শুভও পারবে। ক্রমশঃ মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় সে। সে আজ না পারুক, কাল পারবে, কাল না পারুক পরশু, চুলোয় যাক সে পারবেই।
এদিকে শুভ জেনেছে ছত্তিশগড়ের দল্লিরাজহরাতে খনি শ্রমিকদের আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছে। সেখানে নেতৃত্বে আছেন শংকর গুহ নিয়োগী। তাঁর নেতৃত্বে মেশিনীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে খনি শ্রমিকরা। লোকটার সম্বন্ধে যত জানছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে শুভব্রত। ছত্তিশগড় মাইনস শ্রমিক সংঘের কাজ কর্মের খবর রাখতে শুরু করেছে সে। এতদিন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সম্বন্ধে তার যে ধারণা ছিল তা যেন মিলতে চাইছে না কিছুতেই। ট্রেড ইউনিয়নগুলো মুলতঃ মাইনে বাড়ানোর দাবি, বোনাস দাবি , চার্জশিটের জবাব দেওয়া এইসব কাজই করত। কিন্তু ছত্তিশগড়ের শ্রমিক আন্দোলন এক অন্য খাতে বয়ে চলেছে। গুহ নিয়োগী বিষয়টাকে নিয়ে অন্য ভাবে ভাবছেন। ট্রেড ইউনিয়ন কেবল শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের আট ঘণ্টা নয় তার দিনের চব্বিশ ঘণ্টা নিয়েই ভাববে। বেশ চমকে দেওয়ার মতো কথাই বটে। এই সব ঘটনা যেন কোথাও গিয়ে এক সূত্রে বাঁধা। এই কলেজে ভর্তি হওয়া আর তারপর সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া, সম্পূর্ণ অন্যরকম কিছু মানুষের জীবনের বৃত্তান্ত শুভকে বদলে দিচ্ছে। শুভর উচ্চাকাঙ্ক্ষার হাওয়া মোরগ দিক বদল করে অন্য দিশায় চালনা করছে তার জীবন। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বেশ রোদ চড়ে গেছে খেয়াল করে নি সে। ঘরের ভেতরে ঘরকন্নার আওয়াজ কানে আসছে। তাদের বাড়িতে সব সময়েই আত্মীয় স্বজনে ভর্তি থাকে। কেউ না কেউ আসতেই থাকে। কলকাতার আশ্রয় বলতে তাদের বাড়িটাকেই বোঝে সবাই। গত কালই বাবার কোন পিসতুতো দাদা আর বৌদি এসেছে মালদা থেকে। ডাক্তার দেখাবে কলকাতায়। মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছে শুভ-র ঘাড়ে। কাল থেকে মায়ের মেজাজও তিরিক্ষি হয়ে আছে জানে ও। তাই আর বিছানায় পড়ে না থেকে উঠে পড়াই শ্রেয় ভেবে উঠে পড়ল। ভাইটা এখন মিশনের হস্টেলেই আছে। ছাদে গিয়ে সিগারেটে টান না দিলে পেট পরিষ্কার হবে না। তাই উঠোনের পেছনের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতেই সকালের টাটকা এক ঝলক হাওয়া এসে শুভর এক মাথা চুল এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেল। কি যেন শিহরণ খেলে গেল মনে। অকারণেই মনটা উড়ু উড়ু হয়ে গেল যেন। মনের মধ্যে একটা মুখ ভেসে উঠছে। উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ, পিঠের ওপর লুটিয়ে পড়া কালো বিনুনীতে সাপের চলন। লক্ষণ ভাল নয়। শুভব্রত কি তবে প্রেমে পড়ছে। আনমনে সিগারেট ধরিয়ে একটা বড় টান দেয়। ধোঁয়ার কুন্ডলী চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে। শুভ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে ওঠে, আজ না পারলে কাল, কাল না পারলে পরশু, চুলোয় যাক, শালা সে পারবেই।