সোশ্যাল মিডিয়ার সুশীল ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালেই বোঝা যাবে, মানুষ উৎসবে রয়েছেন, নাকি নেই।
হাতিবাগান থেকে বেহালা মার্কেট, সাধারণ মানুষ হুলিয়ে পুজোর বাজার করছেন। ক্রেতা/বিক্রেতা কারোরই ‘বডি ল্যাঙ্গোয়েজে’ কোনো শোকচিহ্ন নজরে পড়ে না। এক হাতে শক্ত করে ধরা সন্তানের হাত, অন্য হাতে গুচ্ছখানেক প্লাস্টিকের প্যাকেট — অবশ্যই জামাকাপড়ের — এমন ক্লান্ত, তৃপ্ত তরুণী মায়েদের ভিড় অটোর লাইনে, ফুচকার স্টলের সামনে, বাদুড়ঝোলা বাসের অন্দরে। বাইকে প্রেমিকা বা স্ত্রীকে চাপিয়ে মার্কেটে আসা মানুষ গলদঘর্ম কেনাকাটার মাঝে নরম পানীয় বা কাঠি আইসক্রিমে গলা ভেজাচ্ছেন, ফুটের হকার গলার শির ফুলিয়ে হেঁকে চলেছেন নিজের পসরাটি বিকোনোর জন্য — কোত্থাও কোনো ব্যত্যয় নেই।
থাকার কথাও ছিল না। অনেক ফেসবুক বন্ধু মহামিছিলের ছবি পাঠিয়েছেন, পাঠাবেন — আমার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হতে চাইবেন না, মেনে নিচ্ছি। আজকাল আর তর্ক করতে ভাল লাগে না। আমি কেবল মুদ্রার উল্টোপিঠটা দেখিয়ে গেলাম।
একটি রাজ্যের রাজধানী এবং শহরকেন্দ্রিক প্রতিবাদের জোর যেন বাকি অংশের মানসিক স্থবিরতা, মৃতোপম স্থিতিজাড্যকে তছনছ করে দিতে পারে, এই অলীক আশা সযত্নে লালন করে যাচ্ছি এখনো। কতদিন করব, জানি না।
ইতোমধ্যেই, সোশ্যাল মিডিয়ার জ্ঞানীগুণী, প্রখ্যাত কিছু মানুষ, তার মধ্যে অনেকে লেখক, কবি, সাংবাদিক — তাঁরা জুনিয়র ডাক্তারদের পুনর্কর্মবিরতিতে অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। তাদের এই পদক্ষেপের কোনো যৌক্তিকতাই তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। এটুকুতেই আটকে না থেকে তাঁরা প্রতি আক্রমণও শানিয়েছেন দেখলাম। কর্মবিরতি করলে মাইনে নিচ্ছে কেন? এ তো একধরণের তঞ্চকতা। তাছাড়া, হয় বাপের পয়সা দিয়ে পড়েছে, নয় মানুষের ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার হয়েছে, প্রথমদিকে একটু ন্যায়বিচার টিচার চেয়ে আন্দোলন টান্দোলন করেছে, ঠিক আছে, এখন আবার এত কি? নির্ঘাত পুজোর ডিউটি ফাঁকি দেবার তাল, হুঁহুঁ বাবা, আমরা সব বুঝি।
কেউ আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলছেন, উচ্চশিক্ষিতা ডাক্তারেরই শুধু প্রাণের মূল্য আছে, তাই না? সাধারণ রোগী, যারা কর্পোরেট হাসপাতালে যেতে পারবে না, তার প্রাণের কোনো মূল্য নেই? হক কথা। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের প্রাণের মূল্য অবিশ্যি কোভিডের সময়েই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, সে কথা একজন ডাক্তারবাবু বিনীতভাবে জানিয়েওছিলেন, কিন্তু সাংবাদিক সাহেব-সাহেবারা ভয়ানক গোঁসা করে উত্তর দিয়েছেন, যে তাঁদের পেশার মানুষজনও কোভিডে জীবন বাজি রেখে লড়েছিলেন, শুধু চিকিৎসাকর্মীদের শহিদের গরিমা কেন ভেট দেওয়া হবে? তাঁরা কি ফেলনা? অকাট্য যুক্তি। তা এই এত এত বাইনারির জালে আর নিজেকে জড়াতে মন চাইল না।
একটি স্থান-কালে সংঘটিত যে কোনো আন্দোলন তার বৃত্তের মধ্যে থাকা আপামর পাত্রপাত্রীর নিরঙ্কুশ স্বার্থরক্ষা করতে পারে না, সেটা সম্ভবই না। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নদীর উপর বাঁধ বসলে, তীরবর্তী বহু বাসিন্দা বেঘর হ’ন।
অতিমারির লকডাউনে শুধু রোগে নয়, অভুক্ত, কর্মহীন হয়ে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
অসংখ্য সাধারণ মানুষের রক্তমাখা শবের উপর দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এসেছে।
এগুলি কোনোটাই প্রতিরোধ করা যেত না।
জুনিয়র চিকিৎসকদের সুস্থ কর্মপরিবেশ, দুর্নীতিমুক্ত চিকিৎসাব্যবস্থা তথা কলুষহীন ডাক্তারি শিক্ষার বাতাবরণ এবং সহপাঠীর নারকীয় মৃত্যুর সঠিক ও দ্রুত বিচার — এই চাহিদাগুলির জন্য যে আন্দোলন ও কর্মবিরতি, তার থেকে উদ্ভূত রোগী ভোগান্তির চিত্রটি কিন্তু প্রতিরোধ করা যেত।
জুনিয়র চিকিৎসকরা মূলত শিক্ষার্থী, মেডিক্যাল কলেজগুলির বিভিন্ন পরিষেবায় তাঁদের কাজ সমন্বয়কের, সাহায্যকারীর, সহযোগীর। সরাসরি সরকারি চাকরি অর্থাৎ ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল এডুকেশন সার্ভিস এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত প্রফেসর, অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর তথা আর এম ও এবং জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারের এত পদ ফাঁকা কেন হাসপাতালগুলিতে?
যাদের শিক্ষানবিশ থাকার কথা, কেন তারাই হয়ে উঠলেন মেডিক্যাল কলেজগুলির চিকিৎসাব্যবস্থার মেরুদণ্ড? কেন এখনো কোনো স্বচ্ছ ট্রান্সফার পলিসি নেই চাকরিরত চিকিৎসকদের? কেন অনিয়মিত নতুন নিয়োগ? কিসের জন্য সরকারি চাকরিতে রিটায়ারমেন্টের বয়স ষাট থেকে প্রথমে বাষট্টি, তারপর এখন পঁয়ষট্টি করা হয়েছে — আবার শোনা যাচ্ছে আটষট্টি/সত্তরও করে দেওয়া হতে পারে — এই বিষয়গুলিতে একটু অন্তর্তদন্তমূলক সাংবাদিকতা কি পেতে পারি না আমরা?
জানি, সামনে বিভিন্ন পুজোর উদ্বোধন, মণ্ডপসজ্জা, আলোকবাসর এবং প্রতিমাশিল্পের অনন্য আর্ট ফেস্টিভ্যাল চলছে, এরপরে কার্নিভ্যালও থাকবে — সেখানে এইসব নীরস প্রশ্নাবলীর উপস্থাপন নেহাতই অরণ্যে রোদন।
তাই এও জানি, আমাদের মার খেতে হবে, গালাগাল খেতে হবে, ধর্ষিত হতে হবে, হাজারবার অভিযুক্ত হতে হবে চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগে। মানুষকে বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব যাদের, মানুষের করের টাকায় যাদের শিক্ষাদীক্ষা, মানুষেরই করের টাকায় যাদের স্টাইপেণ্ড/বেতন, তাদের আবার অত বাড়াবাড়ি কিসের জন্য?
হ্যাঁ, মাথা পেতেই নিলাম সব অভিযোগ। জুনিয়র/সিনিয়র সব চিকিৎসকদের সব রকম ন্যায্য প্রশ্নের জবাব বোধহয় বিপ্রতীপে থাকা সবার কাছেই রয়েছে, কেবল সঙ্গের ছবিটির প্রৌঢ়ের নীরব কান্নার কোনো উত্তর সম্ভবত কারো কাছে নেই।
উনি অভয়ার বাবা। মেয়ের প্রতীকী মূর্তির মাথায় কপাল রেখে কেঁদে ফেলেছেন।
বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন হয়ত।