বাংলা কথাটা হলো – নগর পুড়িলে দেবালয়ে কি এড়ায় – অর্থাৎ, সমাজের বাকি সব ক্ষেত্র ঘুষখোর তোলাবাজ চিটিংবাজদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে, কিন্তু চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যশিক্ষার ক্ষেত্রটি হয়ে থাকবে অপাপবিদ্ধদের চারণভূমি, এমনটা হয় না। হওয়া সম্ভব নয়।
বাকি সব ক্ষেত্রগুলো যে পথ ধরে যেভাবে রসাতলে গিয়েছে – গিয়েছে মানে আমি বা আপনি যেতে দিয়েছি – স্বাস্থ্য-ও সেই পথ ধরেই গিয়েছে। একদিনে নয়, ধীরে ধীরে অনেক বছর ধরে। ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে নামার সময় পতনশীল গাড়ির গতিবেগ, ব্রেক না থাকলে, ক্রমশ বাড়তে থাকে – শেষদিকে সেই গতি অত্যন্ত বেশি, পতনের শেষ মুহূর্তটা যদি দেখেন, সেটা আছড়ে পড়ার মতো দেখতে লাগে।
তিলোত্তমার ধর্ষণ ও হত্যা – সেই আছড়ে পড়া হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে, অন্তত অনেকের চোখে।
কিন্তু, এই অধোগতি কয়েকদিন বা কয়েকসপ্তাহ বা কয়েকমাসের নয় – চূড়ান্ত অধোগতি চলে এসেছে গত কয়েকবছর ধরেই (তার আগে অব্দি স্বাস্থ্যপ্রশাসন ভয়ানক স্বচ্ছ ও সুঠাম স্বাস্থ্যবান ছিল এমন দাবি করছি না, তবে এই বিপজ্জনক পচনের পথ ধরে চলার প্রবণতা বছরপাঁচেক হলো হয়েছে)। আপনি খবর পাননি, বা দেখেও দেখেননি, বা ভেবেছেন, ওসব নিয়ে ভাবার দরকার নেই, বা ভেবে কী লাভ! তো এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়া বা জাঁকিয়ে বসার পেছনে আপনারও দায় আছে।
হ্যাঁ, বলতেই পারেন, দায় বঙ্গীয় সংবাদপত্রসমূহ তথা সাংবাদিককুলেরও কিছু কম নয়। তাঁরা চাটনি বা খিল্লিমূলক সংবাদ পরিবেশনে যতখানি দড়, অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতায় ততখানি নন – আর যদি বা তেমন সংবাদ তুলেও আনেন, সে খবর ঠাঁই পায় ছয়ের পাতায়।
তবু, কাগজে বেরোয়নি বলে কিছুই জানতে পারেননি, এতটা বিশ্বাস করা তো মুশকিল! বাড়ির কেউ – পাড়ার কেউ – ডাক্তারি পড়ত না? ইউনিয়ন-খাতে কিংবা কলেজ ফেস্ট-এর কারণে দশ-বিশ-পঞ্চাশ হাজার যখন দিতে হয়েছে, মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনি? অথবা কোনও কোনও ডাক্তারি ছাত্র যখন পাস করার আগেই, একেবারে ‘স্বোপার্জিত অর্থে’ একলাখি ফোন বা মস্ত বাইক (কেউ কেউ গাড়িও) কিনে ফেলল – এরা তো আপনাদেরই কারও না কারও বাড়ির ছেলে, আত্মীয় কিংবা পাড়ার ছেলে – অর্থ এলো কোন পথে, জানতে ইচ্ছে করেনি?
না, বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই অসৎ নয়। ঠিক যেমন বেশির ভাগ ডাক্তারও অসাধু নন। অথবা, যেমন সমাজের বেশির ভাগ মানুষ সৎপথে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু মুশকিল হলো, এই যে সৎ জনগোষ্ঠী (যাঁরা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ), ইদানীং এঁদের মধ্যে বেশির ভাগ গা-বাঁচিয়ে চলায় বিশ্বাসী। প্রতিবাদ করে কী হবে? ঝামেলায় জড়িয়ে কী লাভ? প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি ফেঁসে গেলে কে বাঁচাবে? ও যখন কিছু বলছে না, আমার বলতে যাবার কী আছে? মোটামুটি এই সব যুক্তিতেই বিশেষ কেউ প্রতিবাদ করতে যান না। সবাই মেনে নেন, আর মানিয়ে নেন। আর দু-চারজন প্রতিবাদ করতে গেলে দুষ্কৃতিদের হাতে আক্রান্ত হন – এবং বর্তমান প্রশাসন যেহেতু দুষ্কৃতিদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত – পুলিশ-প্রশাসন দ্বারা হেনস্থাও হন। অমনি তথাকথিত সৎ ভালোমানুষরা বাড়তি যুক্তি পেয়ে যান। দেখেছ তো! আগেই বলেছিলাম, প্রতিবাদ করে লাভ নেই! করে কী লাভ হলো, উলটে নিজের আর বাড়ির লোকের হয়রানি…
তো এভাবেই এই সব দুর্নীতি চিটিংবাজি তোলাবাজি চলতেই থাকে, দুষ্কৃতিদের দৌরাত্ম্য বাড়তেই থাকে… দুষ্কৃতিরা আস্তে আস্তে শাসক হয়ে ওঠে… তাদের শাসন দুর্ভেদ্য দুর্গসম অনড় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে…
আর তথাকথিত সৎ মানুষেরা উত্তরোত্তর আরও বেশি বেশি করে ‘সহনশীল’ হতে থাকেন… আরও বেশি বেশি মেনে নেন… আর মানিয়ে নিতে থাকেন… এবং সত্যিসত্যিই বিশ্বাস করতে থাকেন, যে, “পলিটিশিয়ান মাত্রেই কোরাপ্ট, ধান্দা না থাকলে টাকা ইনকামের চেষ্টা ছেড়ে ফালতু সমাজসেবা করতে আসবে কেন”, হিসেব কষতে থাকেন, দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও কার কাছ থেকে ‘সার্ভিস’ পাওয়া যাবে… সরকারের কাছ থেকে একশ টাকা পাবার সময় তিরিশ টাকা ঘুষ দিতে হলেও ভাবতে থাকেন, তবু তো সত্তর টাকা পেলাম, এরা না থাকলে তো…
এভাবেই সৎ ডাক্তারবাবুরা দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করেন, থ্রেট সিন্ডিকেট দেখেও চুপ থাকেন, বদলির আশায় অমুককে ধরেন তমুককে তেল দেন, কেউ প্রতিবাদ করে জানলে (এমনকি করতে পারে জানলেও) তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন…
তো এভাবেই দুর্নীতির বটবৃক্ষটি শিকড় ছড়ায়, ডালপালা মেলে, ঝুরি নামিয়ে অটল অচল ও স্বতঃসিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। ধান্দাবাজ হাওয়ামোরগের দল বাসা বাঁধে। দুর্নীতির ইকোসিস্টেমই স্বাভাবিক বোধ হতে থাকে।
অন্তত ততদিন, যতদিন না অব্দি কোনও এক তিলোত্তমা ধর্ষিতা হতে হতে আমাদের লজ্জায় ফেলে। ততদিন, যতদিন না অব্দি কোনও এক তিলোত্তমা চিরঘুমে গিয়ে আমাদের আরামের ঘুমটি চটকে দেয়।
তবে হ্যাঁ, সত্যিসত্যিই ঘুম থেকে জেগে ওঠা একটা ব্যাপার আর “আমি কিন্তু ঘুমোচ্ছি না, সব দেখছি” সেটা আরেক। প্রথমটা যদি সচেতনতা হয়, তাহলে দ্বিতীয়টা সচেতনতার আত্মপ্রসাদ।
অপ্রিয় শোনালেও বলি, এই যে যাঁরা ঘরে বসে বা কর্মক্ষেত্রে সারাদিন হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন লিঙ্ক ফলো করছেন আর বলছেন ‘কী অবস্থা, না’ ‘কী যে হবে’ ‘এরা কি মানুষ’ ‘ভাবা যায় না, না’ এবং এটুকুতে সীমাবদ্ধ থেকেই নিজের প্রতিবাদী সত্তার ডিমটিতে তা দিয়ে বিস্তর আরাম পাচ্ছেন – জেনে রাখুন, এমন তা দেওয়ার আত্মপ্রসাদের মাধ্যমে কোনও ডিম থেকেই কোনও অবস্থা পরিবর্তনের ছানা ফুটে বেরোবে না।
এই অবস্থার বদল চাইলে রাস্তায় নামুন। সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধে নামুন।
এটুকু মনে রাখুন, জাস্টিস বলতে যা বোঝায় আদালত সবসময় (বা কোনও সময়ই) তা দিতে পারে কিনা সেটা তর্কযোগ্য বিষয়, কিন্তু পরিস্থিতির বদল কোনও আদালতে কোনও সওয়াল-জবাব কোনও শুনানির মাধ্যমেই আসে না। ওটা রাস্তায় নেমে আদায় করে নেবার জিনিস।