কোনও দিক থেকেই সময়টা সুখকর নয়। পাশের দেশে একেবারে রাষ্ট্রীয় মদতে সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন নেমে এসেছে। অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর কী হচ্ছে না হচ্ছে তার খবর ততোখানি দেখতে পাইনি – কিন্তু হাসিনা-সরকারের অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে সেদেশে ইসলামিক মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে এবং তাদের মূল টার্গেট সংখ্যালঘু হিন্দু। এবং অবশ্যম্ভাবী ভারত-বিদ্বেষ। শুনতে পাচ্ছি, হিন্দুদের উপর আক্রমণ, ভাঙচুর-আক্রমণ চলছে। এই পরিস্থিতিতে যেমন হয়, খবরের মধ্যে মিশে থাকছে অতিরঞ্জন, ক্ষেত্রবিশেষে গুজব – কিন্তু ঘটনা ঘটছে অবশ্যই। তদারকি সরকার মৌলবাদীদের ঘাড়ে চেপে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সুতরাং সরকারের তরফে সংখ্যালঘুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কার্যকরী কিছু সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমতাবস্থায় রাগ, অক্ষম একটা রাগ, চূড়ান্ত অস্থিরতা – আর হতাশা – মনের অবস্থা বলতে এ-ই।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া হিসেবে, এই দেশেও, বিশেষত এই রাজ্যে, যে পাল্টা বিদ্বেষ বাড়তে থাকবে, সে-ও অপ্রত্যাশিত নয়। বিদ্বেষ বাড়ছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে। সম্ভবত আরও বাড়বে। পড়শি দেশে রাষ্ট্র ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে (এবং সংখ্যালঘুর সুরক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বিস্মৃত হয়েছে) – এবং সেখানে আমাদের দেশ বিষয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষও গোপন নেই – ওদেশে যারা সংখ্যালঘু, এদেশে যেহেতু তারাই সংখ্যাগুরু (এবং ওদেশের আক্রমণকারীরা এদেশে সংখ্যালঘু), সুতরাং পাল্টা ‘উচিত শিক্ষা’ দেবার ইচ্ছেও কেউ কেউ গোপন করছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ তার সুযোগ নিতে চাইবে, এই ঘোলাজলে কেউ কেউ মাছ ধরতে চাইবে – এ তো জানা কথা।
এমন জটিল সময়ে, আমাদের মতো যারা ধর্ম বিষয়ে নিস্পৃহ এবং ধর্মের ভিত্তিতে বন্ধু-শত্রু নির্ধারণে বিশ্বাসী নই, তাদের পিঠ দেওয়ালে গিয়ে ঠেকছে। কেননা, একদিকে আমরা যেমন বিশ্বাস করি, জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে বিভাজন অনুচিত ও অন্যায়, এবং ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ – আবার এ-ও জানি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি এমনই ভয়ানক সাদা-কালোয় দেগে দেওয়া, যেখানে ভিন্ধর্মের হত্যাকারী আমাকে হত্যা করার আগে আমার অন্য কোনও দোষগুণ দেখবে না, আমি আদৌ ধর্মবিশ্বাসী কিনা যাচাই করে দেখবে না, সে শুধুই আমার নাম-পদবি দেখে সিদ্ধান্ত নেবে যে আমি হিন্দু, সুতরাং আমি হত্যার যোগ্য।
এই মানসিক অস্থিরতার মুহূর্তে ঠিক কী বলা যায়? বা আদৌ কিছু কি বলা যায়? কেননা, যা-ই বলি, তা মূলত অন্তঃসারশূন্য শোনাবে – কেউ কেউ বলবে, এসব ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের কথা – অথবা অবান্তর তো বটেই। কেননা, রাষ্ট্র যখন প্রত্যক্ষভাবে (বা পরোক্ষভাবে) সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা (ও নিশ্চিহ্ন) করতে উদ্যত হয়, তখন সীমানার আরেক পার থেকে উদ্বেগপ্রকাশ, তা যতোই আন্তরিক হোক, অর্থহীন। এদিকে সংস্কৃতিগত কারণে – এবং নাম-পদবিজনিত ধর্মপরিচয়ের কারণেও – যেহেতু অত্যাচারিতের সঙ্গে আমার কোনও ফারাকই নেই (তুলনায় সভ্যতর একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া বাদে), তাই নিজেকেও আক্রান্ত বোধ করছি।
তাহলে উপায়?
আমৃত্যু বাবা শুধু বারবার একটা কথা শিখিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে – কখনও মানুষের উপর বিশ্বাস হারাবি না। ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভাগাভাগির বহু উর্ধ্বে যে মানুষ – মানবতা – সেই মানুষের উপর বিশ্বাস।
এবং সত্য সুন্দর ও যা কিছু চিরন্তন, তার উপর বিশ্বাস।
বর্তমানের এই অন্ধকার বাস্তব। এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যাথার্থ্য প্রশ্নাতীত।
তবু অন্ধকার অতিক্রম করতে চাইলে, চিরায়ত আলোর সংস্পর্শে বেঁচে থাকতে চাইলে, আমাদের সেই অনুসন্ধানে ব্রতী হতে হবে, যা দৈনন্দিনতার মধ্যেও অমৃতের স্বাদ এনে দিতে পারে – যা বিভাজনের উর্ধ্বে ভাবতে শেখাতে পারে।
এই অমৃতের সন্ধানের কোনও ধরাবাঁধা পথ রয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবু, শিল্পকলা এমন একটি মাধ্যম, যা সরাসরি অমৃতের সন্ধান দিক বা না দিক, আমাদের এই ঘিনঘিনে দিনযাপনের মধ্যেও অমৃতের অস্তিত্ব বিষয়ে আমাদের অবহিত করতে পারে। করে-ও।
অন্ধকার এই সময়ে – অন্যায়ের প্রতিবাদের তীব্রতা এতটুকু কম না করেই – আমরা যাতে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হানাহানির উর্ধ্বে উঠে মানুষ হতে পারি – নিজেদের অমৃত-পুত্র সত্তা বিষয়ে যাতে আবারও সচেতন হতে পারি – আমরা নত হতে পারি, আশ্রয় নিতে পারি, শিল্পকলার কাছে।