Add life to years, not years to life
জানালার একচিলতে ফাঁক দিয়ে দেখে মনে হল বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। আউটডোরের রোগীও প্রায় শেষের দিকে। করোনার বাজারে এরকমই হচ্ছে এখন… আগে যেখানে ৪:৩০ টের আগে আউটডোর শেষ করাই যেত না, সেখানে এখন ২-২:৩০ টাতেই শেষ। সকালে তাড়াহুড়ো করে চলে আসায় খাওয়াও ঠিক মত হয়নি, তাই খিদেও খুব পেয়েছে। দু-একটা আউটডোর টিকিট যা বাকি আছে পাশের ঘরে দিতে বলে উঠে পড়েন রিহ্যাব ফিজিসিয়ান, ডা. বিতনু লাহা। হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছে দেখে ছাতা খুলে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালেন।
— “স্যার…স্যার শুনছেন?”
বার দুয়েক আওয়াজটা কানে আসার পর পিছন দিকে তাকিয়ে দেখেন ছিপছিপে অল্প বয়সী একটা ছেলে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। — “স্যার, চিনতে পারছেন? আমি মিরাজ।”
— “আরে মিরাজ.. তুমি? মাস্কের জন্য তো চিনতেই পারিনি!..ভালো আছো?”
মিরাজ অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার, রুরাল হাসপাতালে থাকার সময় থেকেই ডা. লাহার সাথে পরিচয়। বেশ কাজের ছেলে।
–“হ্যাঁ স্যার। ওই সমর মাস্টারকে নিতে এসেছিলাম। লালবাড়িতে ভর্তি ছিলেন, আজ ছুটি দিয়েছে।”
সমর মাস্টার পেশায় শিক্ষক হলেও গ্রামে সমাজসেবী হিসাবে তাঁর নাম আছে…সবার আপদে বিপদে পাশে দাঁড়ান। কিন্তু উনি বিপত্নীক, একমাত্র ছেলেও পড়াশুনার জন্য বাইরে থাকায় বাড়িতে ওনাকে একাই থাকতে হয়।
— “কি হয়েছে?”
— “বলছে স্ট্রোক হয়েছে… ডান দিকের হাত পা নাড়তে পারছেন না।”
— “কোথায় আছেন?”
— “ওই তো স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন… ব্যায়াম শেখাতে হবে নাকি বলেছে।”
অনতি দূরেই দেখা যায় অ্যাম্বুলান্সের স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোককে। বাঁহাত তুলে কাউকে কিছু বলতে চাইছেন, ডান হাত টা কনুই এর কাছে ভাঁজ করে বুকের ওপর রাখা। জামা ও লুঙ্গি পড়ে আছেন, পায়ের নড়াচড়া সেরকম বোঝা না গেলেও ক্যাথিটারের নল ও ব্যাগ নজরে আসে।
মিরাজ সমর বাবুর কাছে গিয়ে বললো “চিনতে পারছেন আমাদের হাসপাতালের লাহা ডাক্তারকে? এখন এখানে আছেন।”
হঠাৎ করেই ভদ্রলোকের চোখে মুখে হাসি খেলে গেল।
মিরাজ বলে উঠলো “মাস্টার সব বুঝতে পারছেন, কথাও বলছেন কিন্তু…কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মুখটাও বাঁদিকে বেঁকে আছে।”
এবার সমর বাবুর চোখে মনে হল জল। জড়ানো গলায় অনেক কষ্টে কেটে কেটে বললেন “কিছু করতে পারছি না নিজে…কথাও সবাই ঠিকমত বুঝতে পারছে না! ..এরকম জীবন রেখে কি লাভ? এর থেকে তো একবারে মরে যাওয়াই ভালো ছিল!”
কান্না ভেজা কথাগুলো শুনে মনটা বড় ভারী হয়ে যায় ডা. লাহার। সম্বিত ফেরে মিরাজের কথায়…–” স্যার, কোথায় রেফার লেখা আছে দেখুন তো?”
আউটডোর টিকিট টায় চোখ বুলিয়ে বলেন “পি.এম.আর… অর্থাৎ ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন”
— “ওই ফিজিওথেরাপি বললো.. ওটাই?”
— “না! ডিপার্টমেন্টের নাম পি.এম.আর। ফিজিওথেরাপি ওর একটা ছোট অংশ।”
— “না!..ঠিক বুঝতে পারলাম না!”
— “আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি শোনো। তোমাদের রুরাল হাসপাতালে দেখেছো তো কারা চিকিৎসা করেন?”
— “হ্যাঁ স্যার, আপনি রোগী দেখে ওষুধ ইনজেকশন লিখে দিতেন। সিস্টার দিদিমণিরা সেটা দেখে ভর্তি রোগীদের ইনজেকশন, স্যালাইন দিত। আর ফার্মাসিস্ট দাদা ট্যাবলেট, সিরাপ কখন কিভাবে খেতে হবে বলে দিত আউটডোরের রোগীগুলোকে।”
— “গ্রুপ ডি দাদাদের কথাও ভুললে চলবে না কিন্তু…যখন যেটা দরকার হাতের কাছে ঠিক এনে দিত।”
— “এটা ঠিকই বলেছেন স্যার। ঝাড়ুদার, চৌকিদার আর আমার মত ড্রাইভার…”
— “হ্যাঁ তোমরা সবাই না থাকলে আমি একা রোগী দেখতে পারতাম? না চিকিৎসা ঠিকমত হত?”
— “কিন্তু স্যার.. ডাক্তার বাবুরা না থাকলে সবই অন্ধকার। মনে আছে.. সেই আপনাকে যখন চন্দ্রপুরের হাসপাতাল থেকে আমাদের রুরাল হাসপাতালে তুলে নিল…ওই গ্রামের লোকজন কি ঝামেলাটাই না করেছিল! ওখানে তো শুধু আউটডোর চলত, ফার্মাসিস্ট আর সিস্টার দিদিমণি ভালোই ওষুধ দিতেন। তাও খবরের কাগজ, টিভিতে সবাই ছিঃ ছিঃ করলো…ডাক্তার ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা…অসম্ভব!”
— “ভালো কথা, শোনো.. আমি এই ডিপার্টমেন্টেরই ডাক্তার এখন। এখানেও ওষুধ, ইনজেকশন, স্যালাইন, অক্সিজেন সবই দরকার মত দেওয়া হয়। তবে মূলত এখানে যেসব রোগের চিকিৎসা হয়, সেগুলোর জন্য ওষুধ, ইনজেকশনের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যায়াম, মেশিনের দ্বারা বিভিন্ন ইলেকট্রিক থেরাপি, লাইটথেরাপি, মোম সেঁক…এসবের প্রয়োজন হয়। আমরা রোগী দেখে কার কি লাগবে সেটা লিখে দেওয়ার পর ফিজিওথেরাপিস্টদের দায়িত্ব সেইমত রোগীকে থেরাপি দেওয়াত বা ব্যায়াম শেখানো। ব্যায়াম মানে কিন্তু যেকোনো ব্যায়াম যখন তখন করলাম.. তা কিন্তু নয়। এক একটা রোগের ওষুধ যেমন নির্দিষ্ট, সেরকম ব্যায়ামও নির্দিষ্ট এবং নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে করলে তবেই রোগের উপশম হয়।”
— “আচ্ছা!”
— “কিন্তু শুধু ফিজিওথেরাপিস্ট না, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, অর্থোটিক্স-প্রস্থেটিক্সদের কাজটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। একজন শয্যাশায়ী রোগীকে শুধু দাঁড় করানো বা হাঁটানো না, তাকে তার স্বাভাবিক জীবিকায় ফেরানোর জন্য যা যা দরকার তা এনাদের করতে হয়। সে নিজে নিজে বসতে, দাঁড়াতে বা হাঁটতে শেখানো থেকে শুরু করে হাতের সূক্ষ কাজ, পেন ধরতে শেখানো…বা নিজের হাতে খাবার বানানো, খাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা সবই। আর বেল্ট, এক্সটার্নাল সাপোর্ট বা নকল হাত-পা.. এগুলো দেখাশুনার দায়িত্ব অর্থোটিক্স-প্রস্থেটিক্সদের। তবে এখানেও কিন্ত নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, আমরা প্রেসক্রিপশন করার পর সঠিক নিয়ম মেনে এনারা রোগীদের সেসব পরিষেবা দেন।”
— “স্যার এত কিছু হয় এখানে?”
— “শুধু এখানেই শেষ না, স্পিচ থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট, ভোকেশনাল কাউন্সিলর, সোশাল ওয়ার্কার… এরকম আরও অনেক কে নিয়ে আমাদের টিম বানাতে হয়। সেসব বলতে গেলে দেরি হয়ে যাবে আরও। চলো আগে সমর বাবুর…”
“না ডাক্তার বাবু.. আপনি চালিয়ে যান। আপনার কথা শুনে আমি মনে অনেক বল ফিরে পেয়েছি। এটাই সঠিক বিভাগ যে আমাকে আবার সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেবে… আমাকে যে বাঁচতেই হবে অন্তত ছেলেটার কথা ভেবে!” অস্পষ্ট উচ্চারণে এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলেন সমর বাবু।
— “স্যার লক ডাউনে ওনার ছেলে আসতে পারেনি। পাড়ার লোকজন কোনরকমে চাঁদা তুলে এখানে ভর্তি করেছে।”
বৃষ্টিও ততক্ষণে থেমে গেছে, মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে। ডা. লাহা তাড়া দিলেন, “আর দেরি করো না, মাস্কটা মুখে ভালো করে বেঁধে দিয়ে ভিতরে নিয়ে চলো”।
আউটডোরের রোগীদের পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে যাওয়া হল সমর বাবুকে। স্ট্রোকের সময় কাছে কেউ না থাকায় পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনার বিবরণ সেরকম পাওয়া গেলো না। তবে যেটুকু জানা গেল.. স্ট্রোকটা দিন সাতেক আগের। রুরাল হাসপাতাল থেকে এখানে রেফার করা হয়েছে। প্রেসার, সুগারের ওষুধ খেতেন, হার্টের কোনো সমস্যা ছিল বলে জানা নেই।
পি.পি.ই. পড়ে সব খুঁটিনাটি পরীক্ষা করতে লাগলেন ডা. লাহা। সমর বাবুর মুখটা এতক্ষণে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া গেল। নাকে নল পড়ানো আছে, মুখটা বাম দিকে কিছূটা বেঁকে আছে। কথা উনি বুঝতে ও বলতে পারছেন। কিন্তু উচ্চারণ অস্পষ্ট, সেটা মুখের মাংসপেশি দুর্বল হওয়ার জন্যই হচ্ছে। সুতরাং ডানহাতি মানুষের মস্তিষ্কের বাম দিকে যে স্পিচ সেন্টার দুটি থাকে.. সেগুলো বা তাদের যোগাযোগকারী ফাইবার গুলোতে কোনো সমস্যা নেই। তাই এক্ষেত্রে মুখের মাংসপেশির শক্তি ফিরিয়ে আনতে পারলেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সমর বাবু হঠাৎ বলে উঠলেন “ডাক্তারবাবু, আমি নাকের নল ছাড়াই খেতে পারবো।”
— “কি করে বুঝলেন?”
— “না মানে… কিছু মনে করবেন না! আপনাদের না জানিয়েই আমি মুখে একটু জল নিয়ে দেখেছি.. গিলতে পারছি।”
— “না না কিছু মনে করব না! এমনিতেও অন্যকোন সমস্যা না থাকলে, এক সপ্তাহের মধ্যেই গলাধঃকরণের সমস্যা আছে নাকি পরীক্ষা করে দেখা হয়। সব ঠিক থাকলে নল খুলে দেওয়া হয়। তবে যেহেতু আপনার মুখের পেশী দুর্বল, তাই খুব তরল খাবার মুখে ধরে রাখতে বা খুব শক্ত খাবার খেতে সমস্যা হতে পারে। সেজন্য গলা ভাত বা সিদ্ধ খাবার এখন খেতে দেওয়া হবে আপনাকে।”
— “ওই পরীক্ষা করতে খুব কষ্ট হয়?”
— “আরে না না… প্রথমে আমরা গলাতে দুই হাতের আঙ্গুলগুলো রেখে ল্যারিংসের ওঠানামা বোঝার চেষ্টা করি। যদি অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়, তাহলে ভিডিও ফ্লুওরোস্কপির সাহায্যে আমরা পরীক্ষা করে দেখি। এখন তো আমাদের কাছেই এসব মেশিন আছে। কার কি অসুবিধা দেখে বিভিন্ন গলাধঃকরণের পদ্ধতি শেখানো হয়। এমনকি গলার ভিতরের একটি মাংসপেশিতে বটিউলিনাম টক্সিন ইনজেকশন দিয়ে গলাধঃকরণের উপযোগী করে তোলা হয়।”
— “কিন্তু ডাক্তার বাবু আমি একা মানুষ! খাবো কিভাবে? হাত তো উঠছেই না!”
— “দেখুন স্ট্রোক রিকোভারির বেশ কয়েকটি স্টেজ আছে। প্রথম দিকে অল্প অল্প করে হাত পা নাড়াতে পারবেন, তারপর দেখবেন পেশীগুলো টাইট হচ্ছে..একে স্পাস্টিসিটি বলে। তখন আমরা প্রয়োজন মত ওষুধ বা নির্দিষ্ট কিছু পেশীতে বটিউলিনাম টক্সিন ইনজেকশন দিয়ে টাইটভাব কমাবো, যাতে আপনার কাজকর্ম করতে সুবিধা হয়। যদিও স্পাস্টিসিটি একটা সময় পর এমনিই কমতে থাকবে, তখন হাত-পাগুলো নাড়াচাড়া করার ক্ষমতাও বাড়বে।”
— “তাহলে আমি আবার আগের মত হাঁটা চলা করতে পারবো? ছাত্রদের পড়াতে পারবো?”
— “অস্বাভাবিক কিছু না। তবে আরও কয়েকটা দিন দেখতে হবে। কেমন উন্নতি হচ্ছে দেখে বলতে পারবো.. আপনি পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরে আসবেন কিনা।”
সমর বাবুর মুখে হাসির ঝলক দেখা গেল। যেন অনিশ্চয়তার পর্দা সরিয়ে মুক্ত আলোর সন্ধান পেলেন… কিম্বা দাবদাহে ওষ্ঠাগত জীবনে একমুঠো খোলা হাওয়ার পরশ! কিন্ত উত্তেজিত হয়ে বসার চেষ্টা করতেই আচমকা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন উনি। বাম হাত দিয়ে ডান কাঁধটা ধরার চেষ্টা করেন।
–“এখন এভাবে উঠতে যাবেন না! আর আপনার ডান কাঁধের পেশী দুর্বল থাকায়, বসলে বা দাঁড়ালে ডান বাহুর হাড় কাঁধ থেকে নিচের দিকে সরে আসতে পারে, যেটাকে শোল্ডার সাবলাক্সেশন বলে। তাই যতদিন না কাঁধের জোর ফিরছে আর্ম স্লিং বা বোবাথ কাফ পড়তে হবে। মনে রাখবেন একবার শোল্ডার সাবলাক্সেশন হয়ে গেলে কিন্তু স্বাভাবিক হওয়া মুশকিল!”
— “না ডাক্তার বাবু! আপনি যা বলবেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।”
— “আসলে আপনাকে ভর্তি করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো বেড ফাঁকা নেই। রিহ্যাব ফিজিশিয়ানের সুপারভিশনে কয়েকটা মাস চিকিৎসা চললে রিকোভারি অনেক ভালো হয়!”
— “তাহলে উপায়?”
— “এখন আপনাকে বাড়ী পাঠাচ্ছি, কিন্তু বেড ফাঁকা হলেই আপনাকে ফোন করে ডেকে নেবো। তবে আপনাকে এখন একজন অ্যাটেনডেন্ট রাখতেই হবে। আপনার হাত পা ও শরীর কখন কি অবস্থায় থাকবে তা খুব ভালো ভাবে মেনে চলতে হবে, নাহলে কিন্তু পরবর্তীকালে দাঁড়াতে, হাঁটতে বা হাতের কাজ করতে সমস্যা হতে পারে। কিম্বা একভাবে শুয়ে থাকার জন্য পিছনে বেডসোর হয়ে যেতে পারে। মনে রাখবেন সারাদিনে অন্তত একবার সব জয়েন্টগুলো নাড়াতেই হবে নাহলে ওগুলো শক্ত হয়ে যাবে।”
–“সে আমি ব্যবস্থা করে নেব..”.
— “আর হ্যাঁ, আপনার ক্যাথিটারেরও ব্যবস্থা করতে হবে। বেশিদিন একভাবে রাখা ঠিক হবে না!”
— “আগে কখন প্রস্রাব হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না তবে এখন মাঝে মাঝে বুঝতে পারছি।”
— “বাহ্! আমি প্রেসক্রিপশন করে দিচ্ছি…. ইনভেস্টিগেশন, ওষুধ ও যাবতীয় যা দরকার লেখা থাকবে। সেটা দেখে আপনাকে ও আপনার অ্যাটেনডেন্টকে থেরাপিস্টরা সব বুঝিয়ে ও শিখিয়ে দেবে।”
— “অনেক ধন্যবাদ! তাহলে আজ আসি ডাক্তারবাবু। আবার যেদিন ডাকবেন চলে আসবো।”
গোছগাছ প্রায় সম্পূর্ণ, স্নান সেরে একেবারে প্যান্ট শার্ট পড়ে রেডি হয়েই বসে আছেন সমর বাবু। ব্রেকফাস্ট সেরেই রওনা দেবেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। মিরাজকে নিয়ে ছেলেও চলে এসেছে সকালেই। আজ যে বড় আনন্দের দিন! কারও সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে টয়লেট, স্নান, জামা কাপড় পরিবর্তন… সবই করলেন আজ। দিন সাতেক ধরে নিজে হাতে পুরো খাবারও খেতে পারছেন। শুধু একটা মোটা হাতল দেওয়া চামচ লাগছে। আর হাঁটতে একটু সমস্যা হচ্ছে, ডান পায়ের আঙুলগুলো ঘষে যাচ্ছে। তার জন্য অবশ্য বিশেষ জুতো দিয়েছেন ডাক্তার বাবুরা। সেটা পড়লে আর ওই সমস্যা অতটা থাকছে না।
“ডাক্তার বাবু কখন আসবেন? একবার দেখা করে গেলে ভালো হত!” পাশে বসা ছেলেকে অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলেন সমর বাবু।
— “আমি কালই সব জেনে নিয়েছি বড় স্যারের কাছ থেকে। ডা. লাহাও সব বিশদে বলেছেন। মাস তিনেক পর ফলো আপে আসতে হবে। ফোন নম্বরও দিয়েছেন, অসুবিধা হলে ফোন করতে বলেছেন।”
ছেলের কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন সমর বাবু। ছেলে বেঙ্গালুরুতে রিসার্চের জন্য গিয়েছিল, লকডাউন উঠতেই ফিরে এসেছে। দু সপ্তাহ কোয়ারান্টিনে কাটিয়েই, বাবার দেখাশোনা করার সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। সেদিন ডা. লাহার সাথে কিসব ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নিয়ে কথা বলছিল, স্ট্রোক রিহ্যাবে নাকি এখন এর ব্যবহার অনেক বেড়েছে। ছেলেটাও ওসব নিয়েই নাকি কাজ করছে।
“ডাক্তার বাবু কি একটা মেশিন আনানোর কথা বলছিলেন না?” প্রশ্নটা মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করে ফেললেন ছেলেকে।
— “ওটা হচ্ছে ফাংশনাল ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন। প্রথমে একধরনের এফ.ই.এস. ব্যবহার করা হয় ট্রেনিং এর জন্য, যেটা থেরাপিস্টরা কন্ট্রোল করে। আর পরে যেটা দেওয়া হবে সেটা অটোমেটিক কাজ করবে।”
— “সে তো হল। কিন্তু সেটা আমার কি কাজে লাগবে?”
— “কেন! ওই যে তোমার ডান পায়ের পাতা… হাঁটার সময় গোড়ালি মাটিতে ঠিক মত ঠেকে না, ওকে ফুট ড্রপ বলে। ওই ফুট ড্রপ যাতে না হয় তার জন্য ওই স্পেশাল ডিভাইস তোমার পায়ে লাগানো হবে।”
— “চিকিৎসা শাস্ত্রেও এত টেকনোলজির ব্যবহার হয়!”
— “হ্যাঁ, দিন দিন চিকিৎসার সব কিছুই তো খুব উন্নত হচ্ছে। আর এখানকার পি.এম.আর. বিভাগ তো ভারতের মধ্যে অন্যতম সেরা। আমি সব ঘুরে ঘুরে দেখেছি… এত কিছু যে হয় এখানে অনেকেই জানে না!”
“আসলে এর জন্য অনেক টা আমরাই দায়ী…”, এর মাঝে কখন যে ডা. লাহা চলে এসে ওদের কথোপকথনে যোগ দিয়েছেন তা খেয়াল ছিল না সমর বাবুর।
“শুধু সাধারণ মানুষ না, মেডিক্যাল প্রফেশনের অনেকেই জানেন না এসব সম্পর্কে…সব মেডিক্যাল কলেজে ডিপার্টমেন্টও ঠিক মত নেই! ভারতের বাইরে কিন্তু ছবিটা পুরো উল্টো… যাইহোক”, বলে থামলেন ডা. লাহা। পরক্ষণেই বলে উঠলেন, “আজ তো আপনার ছুটি! হাতের ব্যথাটা আর নেই তো?”
— “না ডাক্তার বাবু! ফোলাটাও অনেক কমে গেছে… আঙুল নাড়াতেও অসুবিধা হচ্ছে না, মোটা পেন দিয়ে লিখতেও পারছি।”
“আচ্ছা ডাক্তার বাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি!” পাশ থেকে সমর বাবুর ছেলে হঠাৎ বলে উঠল
“এই যে একটা হাত পুরো ফুলে গেলো, অসহ্য ব্যথা শুরু হল এটা কি স্ট্রোকের জন্যই?”
— “হ্যাঁ, এটার নাম কমপ্লেক্স রিজিওনাল পেইন সিনড্রোম বা সি.আর.পি.এস, স্ট্রোকের একটা কমপ্লিকেসন। আমরা প্রথমে ওরাল মেডিসিন দিয়েই এর চিকিৎসা করি কিন্তু ওনার ক্ষেত্রে সেরকম সাড়া না মেলায় ঘাড়ের কাছে যে স্টিলেট গ্যাংলিয়ন আছে, ওটাকে ব্লক করা হয়, মানে ফ্লুওরোস্কপির সাহায্যে ইনজেকশন দেওয়া হয়।”
” আর বলবেন না! সেদিন ওই ইনজেকশন দেওয়ার পর ডান চোখটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। সেই নিয়ে পাশের বেডের বাচ্চাটার কি হাসি!” বলে উঠলেন সমর বাবু।
— “হ্যাঁ, ওটা তো পরদিন আবার ঠিক হয়ে যাবে বলেই ছিলাম… নরমাল ব্যাপার!”
— “হ্যাঁ ডাক্তার বাবু! যাবার আগে আপনার সাথে একবার দেখা করতে চাইছিলাম। আপনি আমার প্রচুর উপকার করেছেন…আপনার সাথে সেদিন দেখা না হলে যে কি হতো!”
— “না না… এটা ভুল কথা। সরকারী হাসপাতালে সব একটা সিস্টেম মেনে হয়। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও একই চিকিৎসা হত।”
এর মধ্যে ডায়েটের স্টাফ খাবারের জন্য ডাকতে শুরু করেছে। তাই ডাক্তার বাবু আর কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন, “ফলো আপে তাহলে আসবেন। আর বটিউলিনাম টক্সিনের ইফেক্ট কিন্তু পার্মানেন্ট না। তাই পরবর্তী কালে কারও কারও রিপিট্ করতে হয়, তখন হয়তো আরেকবার আপনাকে ভর্তি করতে হতে পারে।”
পাঠকগণ এতখন মন দিয়ে যার কথা শুনলেন তিনি একজন সেরিব্রোভাস্কুলার অ্যাকসিডেন্ট বা স্ট্রোক আক্রান্ত রোগী, যা%র ডান দিকে প্যারালিসিস বা হেমিপ্যারেসিস, সাথে স্পাষ্টিসিটি ও সি.আর.পি.এস. ছিল। আপনারা জানেন হয়ত ভারতে মৃত্যু ও অক্ষমতার অন্যতম প্রধান কারণ স্ট্রোক। বছরে ১৫ লাখেরও বেশী ভারতীয় আক্রান্ত হন এই রোগে। মোট স্ট্রোক রোগীর ১৩-১৫% হিমোরেজিক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য হয়, বাকি দের কারণ কিন্তু ইস্কেমিয়া অর্থাৎ রক্ত জমাট বাঁধার জন্য।
হিমোরেজিক স্ট্রোকে জীবনহানির হার বেশি, কিন্তু ইস্কেমিক স্ট্রোকে জীবনহানির রিস্ক কম হলেও অক্ষমতার হার অনেক বেশি। তাই অ্যাকিউট ফেজ কেটে যাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব রিহ্যাব শুরু না হলে, রোগী সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় সমর বাবুর মত এরকম সঠিক পদ্ধতিতে স্ট্রোক রিহ্যাব খুব কম রোগীরই হয়। গোটা ভারতের মতই আমাদের রাজ্যেও চিত্রটা ভিন্ন নয়! হয়ত দেখা যায়, বাড়িতে ফিজিওথরাপিস্ট এসে একবেলা কিছু থেরাপি করে যাচ্ছেন, কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হয় না। প্রকৃত বিশেষজ্ঞের অভাবে পুরোপুরি চিকিৎসা না হওয়ার জন্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না সেইসব রোগীরা। সমর বাবুর ক্ষেত্রে যেমন স্পাস্টিসিটি, সি.আর.পি.এস.- এর মত কমপ্লিকেসনগুলোকে সময় মতো নির্ণয় করা গেছে বলেই সেগুলোর সঠিক চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে, সেরকম স্ট্রোকের আরও অনেক কমপ্লিকেসন যেমন অ্যাফেসিয়া, ডিসফেজিয়া, অ্যাপ্রাক্সিয়া, হেমিনেগলেক্ট, শোল্ডার পেইন… এগুলোরও দ্রুত নিৰ্ণয় এবং চিকিৎসা একজন রিহ্যাব ফিজিশিয়ান ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু এর অন্তরায়ের পিছনে বড় কারণ স্বল্পসংখ্যক রিহ্যাব ফিজিশিয়ান, অপ্রতুল পরিকাঠামো এবং সচেতনতা।
দারুন লেখা। উপকৃত হলাম।
আপনার ফোন নাম্বারটি যদি দেন। বিরক্ত করবো না, খুব প্রয়োজন ছাড়া। আমি নিয়মিত পাঠক।
খুব সুন্দর লেখা। উপকৃত হলাম।পরের মূল্যবান লেখার অপেক্ষায় থাকলাম