“বিশ্বাস করুন স্যার, গিল্টি ফিলিং হয়।”
নেশা এক অদ্ভুত জিনিস। নেশাকে বা নেশাখোরকে, গালিগালাজ দেয় সবাই। তারপর আবার নেশার কাছেই ফিরে যায়। নেশাতে যে মুক্তি, সেই মুক্তি যে আর কোথাও মেলে না! নেশাকে গালি দিতে গিয়ে মুখ খুলি, কিন্তু তার আগে চোখ খুলে যায়। দেখি, নেশা শুধু নেশা নয় তো!
৩৫ বছর বয়সের ছেলেটা আজ এসে যখন তৃতীয়বার হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তার কি মনে পড়ছিল দশকের আগের কলেজজীবন? কলেজ জীবনের প্রতি অনেক রাগ তার। কলেজ তাকে যেটুকু না শিক্ষা দিয়েছে, তার থেকে বেশি ঢেলে দিয়েছে বিষ। কালো তরল বিষ, যা রাংতার ওপর ঘুরে বেড়ায়, নীচের আগুনের হুকুমে। এদিক থেকে ওদিক। আবার ওদিক থেকে এদিক। বিষের নাম হেরোইন। আর এই পদ্ধতির নাম? Chasing the dragon! বিষ পুড়িয়ে যেটুকু কালো ধোঁয়া হয়, সেটুকু টেনে নিতে হয় ভেতরে। এদিক থেকে ওদিক, আবার ওদিক থেকে এদিক! তারপরেই মস্তিষ্কের ভেতরে ধোঁয়া, সব কষ্ট ভুলে যাওয়া..
আগে একটু ৫০ এমএল বাংলা খেলে নেশাটা ধরতে সুবিধা হয়, আর একটু ‘মারিজুয়ানা’ টানলে নেশাটা ধরে থাকে। দামটা বড্ড বেশি কিনা..
কলেজ থেকেই শুরু। বিড়ি সিগারেট থেকে গাঁজা, ছোটো লাফ ছিল। হঠাৎ, আড্ডার বন্ধু ডেভিড একটা নতুন জিনিসে টান দিতে দিতে বললো, ট্রাই করবি? এই লাফটা একটু বড়ো হয়ে গেল। গোলিয়াথ জিতে গেল এইবার। জীবনটা আর সামলানো গেল না। কলেজটাও শেষ করা হলো না আর। গলায় আক্ষেপ, ‘ওই গ্রুপের সবাই কিন্তু এখন ভালো আছে জানেন, আমারই আর কিছু হলো না..
তারপর, নেশা ছাড়া আর ধরা। ধরা আর ছাড়া। অনেক বছর হয়ে গেল। জীবনের বছরগুলো নষ্ট হয়ে যাবার আকুতি গলায়। হায়েষ্ট Abstinence পিরিয়ড? ২ বছর। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ছেড়ে দিয়েছিলে তো ফিরে এলে কেন? তখন কষ্টের কথা উঠে আসে। ‘একটা মেয়ে’ আছে, যার ‘গল্প’টা কাল শুনবো বলে এলাম। মেয়ে আছে, গোটা হাত ভর্তি কাটা দাগ আছে, চামড়া কেটে তার নাম লেখা আছে…
নেশার অভ্যাস ফিরে আসার, মানে relapse করার, যদি একটা দিক হয় impulse control এর অভাব, তাহলে আরেকটা দিক অবশ্যই stressor এবং maladaptive coping এর উপস্থিতি। যে মানুষ কষ্ট পায় সহজেই, যার resilience কম, যার সমস্যার সঙ্গে লড়াই করার ধরণগুলো সমস্যাজনক — তাদের প্রত্যেকের নেশার কোলে ফিরে আসার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি। এর সঙ্গেই জুড়ে যায় বায়োলজিক্যাল অর্থাৎ জিনগত কারণ, সামাজিক বা পরিবারগত কারণ, এবং আর্থসামাজিক কারণ। সব মিলিয়ে নেশার কামানের গোলাতে ভরবেগ অনেক বেশি, মনের দেওয়াল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!
এইবারে আবার নেশা শুরু করেছে গত ৬ মাস। জিজ্ঞেস করলাম, এবার কী হলো? বন্ধু এসে বলেছিল, দারুণ একটা মাল দিয়েছে এবার। বারবার relapse হতে হতে দেওয়াল দুর্বল হয়ে গেছে, এটুকুতেই ভেঙে পড়ল..
সে Coaddict শব্দের মানে জানে, একসময় নিজে হেরোইন আসক্তদের OST থেরাপি দিয়েছে, কিন্তু সবকিছু জেনেও নিজেই নিজের বৃত্ত ভেঙে উঠতে পারছে না সে.. বারবার বলছে, “Wisdomটা কাজ করে না সেসময়, বোধটা কাজ করে না.. তখন মনে হয় কষ্টটা কমাই আগে যেকোনো ভাবে.. তখন Willpowerটা আর কাজ করে না..”
বললাম, কাল আসবো আবার। ওঠার সময় সে বললো, বিশ্বাস করুন, গিল্টি ফিলিং হয় খুব। জীবনের এতোগুলো বছর নষ্ট করে দিলাম..