কলকাতা থেকে প্রায় ১২০কিমি পার্থপ্রতিমা ঘাট। সেখান থেকে ছোট লঞ্চে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আমরা যখন G Plot পৌঁছলাম তখন প্রায় বেলা ১২:৩০টা। আমরা অর্থাৎ WBDF-SSU টিমের ডাক্তার, ভলান্টিয়ার ৯জন আর জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী Jolu Cares-এর ৬জনের টিম।
সুন্দরবনের দক্ষিণপূর্বে জনবসতি সহ শেষ দ্বীপ এইটা। ইংরেজ শাসনের সময় ‘লট’ হিসেবে বিক্রি হয় এখানকার অনেক দ্বীপ, তারই একটা এই G Plot, আরেক নাম, ইন্দ্রপুর। প্রায় ৮০% মানুষ মেদিনীপুর ও হুগলি থেকে এসে এখন এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। অধিকাংশ মৎসজীবি, বাকিরা কৃষক ও অন্যান্য ছোট ব্যবসার সাথে যুক্ত।
বুলবুল ঝড়ের প্রভাব এখনও এখানকার মানুষের মধ্যে টাটকা, তাই এবার ওনারা অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। বেশিরভাগ মানুষই আশ্রয় নিয়েছিলেন ওখানকার পাকা স্কুল বাড়ি ও অন্যান্য শেল্টারে। তা সত্ত্বেও একজন প্রাণ হারান এবার আম্ফানে। এখানকার একমাত্র প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসক থাকেন মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার, প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া অন্যান্য অসুখ বিসুখে ভরসা, ‘পাথর’ বা কাকদ্বীপ।
একমাত্র সরু পাকা রাস্তা আর ইঁট বেছানো গলি পেরিয়ে টোটো আমাদের পৌঁছে দিল ‘আপ্যায়ন’, আমাদের আগামি দুইদিনের আশ্রয়! ঝড়ে লন্ডভন্ড জেটি স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্যে বহু কসরতে অক্ষত অবস্থায় টপকে, বৃষ্টি আর তারপর চাঁদি ফাটা রোদ মাথায় আপ্যায়নে এসে শুনি বিদ্যুত সরবরাহ এখনো বন্ধ, কবে আসবে জানা নেই কারো। শহুরে সহযাত্রীদের মুখগুলো তখন দেখার মতন। তবে আমাদের স্থানীয় ভলান্টিয়ার অয়ন আর ওর টিম বেশ করিৎকর্মা, তাই জেনারেটরের বন্দোবস্ত হয়ে গেল, চটপট, hat’s off!
প্রথম দিন, ২০শে জুন আম্ফানের ঠিক ১ মাস অতিক্রান্ত। G Plot এর ৮টা গ্রাম কে দুই ভাগ করে নিয়ে প্রচার করা হয়েছিল।
লাঞ্চ সেরে এদিন মেডিক্যাল ক্যাম্প, উত্তর সীতারামপুরে, আর সাধারণ ত্রাণ অন্য অঞ্চলে। বিশ্বজিতদা, মৃণ্ময়, বিতান, পিয়া, স্বরূপ, অর্ণব, শুভশ্রী, কৌস্তুভ আর আমি রোগী দেখা, ওষুধ, স্যানিটারি প্যাড, স্টক সলিউশন বন্টন আর মানুষের সাথে সাধারণ স্বাস্থ্য আলোচনা চালালাম প্রায় ঘন্টা তিনেক। ততক্ষণ গোধূলি, আলোর অভাব, অতএব দিনের মতো বিরতি। দেখা হলো প্রায় ১২০জনকে। ফিরতি পথে ভাগ্যক্রমে টোটোসহ পুকুরে পরা থেকে বেঁচে ফেরা – যাকে বলে, বাল বাল বাঁচ গ্যায়া – সন্ধায় কয়েক জন অতি উৎসাহীর পুকুর সাঁতার তারপর টাটকা ভাজা কুঁচো চিংড়ি সহযোগে আড্ডা আর পরের দিনের প্ল্যান। রাতে দেশি মুরগির ঝোল আর ভাত জমলো ভালোই।
এ প্রসঙ্গে জানাই, Jolu Cares-এর ভাইয়েরা সাথে নিয়ে গিয়েছিল ১৯ কুইন্টাল বিশেষ ধরনের ধানের বীজ।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নাম আগেই নথিভুক্ত করা হয়েছিল। পরিবার পিছু ৫ কেজি করে বীজ বরাদ্দ। এই ধরনের বীজ চাষের জমিতে নোনা জলের পরিমাপ কমলে প্রায় ২২০০ কেজি ধান হয়, যা চার জনের পরিবারের তিন বছরের জন্য পর্যাপ্ত। এই ধান বিক্রি করেও তারা অর্থ উপার্জন করতে পারেন।
Jolu Cares-এর সৌরভ, শুভজিত, স্বর্ণাভ, প্রতিক, রাজেশ আর অয়ন যে রকম উৎসাহ ও যত্ন নিয়ে ত্রাণের এই কঠিন কাজ ঠান্ডা মাথায় করে চললো সত্যিই না দেখলে ভাবা যায় না। অবশ্য এর মধ্যেও কিছু মাতব্বর যে ঝামেলা করবে না, তাই হয় নাকি? সুতরাং ব্যাপারটা প্রশাসন ও পুলিশের সাহায্যে উতরানো গেল।
পরের দিন, ২১ই জুন, রবিবার, এদিন আবার পূর্ণগ্রাস সূর্য গ্রহণ। আজ আমাদের মেডিক্যাল ক্যাম্প বুড়াবুড়ির তট, একদম বঙ্গোপসাগরের সৈকত ভেঁষা, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত একটা স্কুল বিল্ডিং। মুড়ি ঘুগনী, পরোটা সবজি পছন্দমতো ব্রেকফাস্ট সেরে যাত্রা; পৌঁছন গেল ৯টা নাগাদ।
সৌরভ, শুভজিতরা সেদিন বাজারের লাগোয়া ত্রাণ শিবির করলো, আর আমরা মেডিক্যাল ক্যাম্প চালু করলাম স্কুলের অক্ষত মিড-ডে মিল খাবার শেড ঢাকা জায়গাতেই। ঘন্টা তিনেক রোগী দেখে বোঝা গেল, আম্ফানের সময় চোট পাওয়া দুই তিনজন ছাড়া বেশিরভাগই ক্রনিক রোগী, লকডাউনে বিশেষ অর্থনৈতিক ও স্থিতব্যস্থার কারণে বিপর্যস্ত। যতটা সম্ভব ওষুধপত্র ও অন্যান্য কিছু প্রয়োজনীয় ত্রাণ দেওয়া হলো।
কথা বলে বোঝা গেল এখানকার মানুষের প্রধান চাহিদা নিয়মিত রেশন, সুষম আহার, পানীয় জল ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা – বিদ্যুত এলো কি এলো না, তা নিয়ে ওদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, যতটা সম্ভব সোলার পাওয়ারই যথেষ্ট।
ইতিমধ্যে অন্য টিমও কাজ শেষ করে হাজির। ঠিক হলো এতো কাছে এসে সমুদ্র সৈকত না দেখে ফিরে যাওয়া অনুচিত।
এখানে নদী আর নেই, বঙ্গোপসাগরের যাকে বলে pristine বিচ। অসাধারণ! কিছু আবশ্যিক গ্রুপফি, সেল্ফি, দুরে থাকা প্রিয়জনের সাথে ভিডিও কল, কাঁকরা খোঁজা, আর স্থানীয় ছেলেদের সাথে বিচ-ফুটবল চললো আধ ঘণ্টা মতো।
ততক্ষণে ভাঁটার টান, পেটে ক্ষিদে আর ঘাটে অপেক্ষায় লঞ্চের টাইম লিমিট – অগত্যা বিদায়ের পালা!
ভাঙা জেটিতে, লাগানো লঞ্চে চড়া সহজ কম্মো নয়কো মোটেও, পৌঁছন গেল অয়ন আর স্থানীয়দের সাহায্যে। স্বরূপ সবার লাগেজ সামলাচ্ছিল, হঠাৎই পিছলে কাদায়, কপাল ভালো অল্পের ওপর দিয়ে গেল, না কাঁদিয়ে!
বাই বাই G Plot, এবারের মত!