হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। তাঁদের কাজ রায় দেওয়া – করেছেন।
তাতে কী এলো গেল!! ওরকম রায় তো রবীন্দ্রসরোবরে ছটপুজো নিয়েও এসেছিল। কী ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছিল তাতে? সাধারণভাবে আদালতের নির্দেশ বিষয়ে প্রাতঃস্মরণীয় অনুব্রত মণ্ডল তো সেই কবেই বলেছিলেন, আইন আইনের পথে চলবে।
পুজোকমিটিদের মধ্যে কেউ কেউ জানিয়েছেন, গতকাল অব্দি, রায় হাতে পেলে আলোচনায় বসবেন। কেউ বলেছেন, সরকার কী বলছেন, তাঁরা তার অপেক্ষায় – আর, সরকার এখনও কিছু বলেননি। আরো কেউ কেউ বলেছেন, তাঁরা সুপ্রীম কোর্টে যাবেন। অতএব…
রায় নিয়ে আরেক শ্রেণীর মানুষ মতামত জানাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বলছেন, দুর্গাপুজোর বিরোধিতা আসলে বাঙালি সংস্কৃতির ‘পরে আঘাত। ঠিকই। আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির যাঁরা পুরোধা, সে রবীন্দ্রনাথ বলুন বা বিদ্যাসাগর, তাঁরা ধূমধাম করে সার্বজনীন দুর্গাপুজো করে তবেই না সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম এগোতে পেরেছিলেন। আর এযুগে সংস্কৃতি রক্ষার গুরুভার বহন করছেন ববি হাকিম, পার্থ চাটুজ্জে বা অরূপ বিশ্বাস – এনারা না থাকলে আমাদের সংস্কৃতি কোন অতলে তলিয়ে যেত, ভেবে দেখেছেন একবার!!!
আবার কেউ কেউ বলছেন, এত মানুষের রুজিরোজগার… একটুও ভাবব না!! হক কথা। মুখ্যমন্ত্রী পুজোর খয়রাতিতে সরাসরি দিয়েছেন প্রায় দুশো কোটি টাকা (পঞ্চাশ হাজার করে আটত্রিশ হাজারের কিছু বেশী পুজো, গুণ করে অঙ্কটা বললাম) – বিদ্যুৎবিলে ছাড় এবং আরো বেশ কিছু ফীজ মকুব ধরলে পরিমাণটা দ্বিগুণ, সম্ভবত। টাকাটা অন্যভাবে খরচা করা গেলে কিছু সুরাহা হতো না? ধরুন, দশ লক্ষ পরিবারকে মাসে চারহাজার টাকা ভাতা দেওয়া গেলে??
গরীবের দুঃখে যাঁরা কাতর, তাঁদের অনেকেই বলছেন – ট্রেন বন্ধ, কাজেই অনেকেই আসতে পারবেন না – “করোনা জুজু”-র ভয়ে আরো অনেকেই বাড়ি থেকে বেরোবেন না – কাজেই, এবছর ভিড় সেরকম হতো না এমনিতেই। খুব ভালো কথা বলেছেন। তাহলে তো ফুচকাওয়ালা, বেলুনওয়ালা, রঙীন সরবতওয়ালাদের বিক্রিবাটা এমনিতেই তো তেমন একটা হতো না। হাইকোর্টের রায়ে তাঁদের ক্ষতির সম্ভাবনা কোথায়!!
অনেকে আবার এমনও বলছেন, বাসে ভিড় হচ্ছে, অফিসে যেতে হচ্ছে – শুধু দুর্গাপুজোর ভিড় নিয়েই কথাবার্তা? সত্যিই তো!! কাজে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা আর উৎসব, একই নিশ্চয়ই!!! গরীব মানুষ যদি একটা পান-গুমটি বানানোর আশায়, বা একখানা নিজের রিকশা কেনার আশায় ধার করেন, তাঁর সেই দেনার সাথে যিনি জুয়ায় টাকা উড়িয়ে দিয়ে আরো টাকা ধার করেন – ব্যাপারটা একই – দুক্ষেত্রেই দেনা। ভিড় দুজায়গাতেই।
তিনটে প্রশ্ন করা যেতে পারত। কিন্তু, সেগুলো এনারা পড়ে আসেন নি। সম্ভবত, আগের বছর পরীক্ষায় এসে গেছিল বলে এবার আর ইম্পর্ট্যান্ট নয় বলে ধরে নিয়েছেন।
১. এই মুহূর্তে রাষ্ট্র কেন প্রান্তিক মানুষজনের খাওয়াপরার দায়িত্ব নেবেন না? কেন তাঁদের ঝুঁকিবহুল ভিড়ভাট্টায় বেলুন কি বাঁশী বিক্রি করে পয়সা জোটাতে হবে? এই পথে উপার্জন করতে গিয়ে কেউ যদি করোনায় প্রাণ হারান (ফেসবুকীয় জ্ঞানীগুণীদের মতেই, করোনায় মরে দেড় শতাংশ – এক লাখে দেড় হাজার – হাজারে দেড়শ – এর মধ্যে একটাও গরীব থাকবে না!!!), তাহলে তাঁদের পরিজনের কী হবে??
২. পুজো যদি মেনে নেওয়া হয়, বাস যদি চালু থাকে – তাহলে লোকাল ট্রেন কেন চালু হবে না? হ্যাঁ, ঝুঁকি থাকবে – করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি। কিন্তু, রিস্ক-বেনিফিটের হিসেব কষলে ট্রেন চালানোর বিরুদ্ধে যুক্তি থাকে কি? কোন রিস্ক-বেনিফিটের অঙ্কে পুজোর ভিড় এলাউড, অথচ লোকাল ট্রেন নয়??
৩. একজায়গায় বেশী মানুষ জড়ো হওয়া নিয়ে আপত্তি যদি না-ই থাকে, তাহলে ইশকুল খুলবে না কেন? আপনার-আমার বাড়ির বাচ্চারা অনলাইন ক্লাস করছে – তাদের পড়াশোনা এমনকি একবছর বন্ধ থাকলেও, কিচ্ছু আসবে যাবে না – কিন্তু, গ্রামেগঞ্জের গরীব মানুষের পরিবারের একটা আস্ত প্রজন্ম পাকাপাকি স্কুলছুট হয়ে যেতে চলেছে। তার আর্থসামাজিক অভিঘাত হিসেব করেছেন??
আর হ্যাঁ, দুর্গাপুজোর পরে ডাক্তারবাবুদের আশঙ্কা অনুসারে করোনার বাড়বাড়ন্ত হলে কিন্তু এই দুই ও তিন নম্বর পয়েন্ট বিশ বাঁও জলে চলে যাবে। মানে, সেরকম সংক্রমণের বাড়াবাড়ির মুহূর্তে নতুন করে ইশকুল বা ট্রেন চালু করার দুঃসাহস কোনো অকুতোভয় নেতা/নেত্রীই নেবেন না – একুশের ভোট বৈতরণী পার হওয়ার জন্যে ধর্মানুষ্ঠান জারি রাখা বা ক্লাবদের খুশী রাখা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ইশকুল বা ট্রেন ততখানি নয়।
দেশজুড়ে করোনার গ্রাফ নিম্নমুখী – একা পশ্চিমবঙ্গ মাথা তুলছে – পুজোর পর গ্রাফ সবেগে মুখ তুলে চাইলে দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্ন রাজ্য হিসেবে গণ্য হয়ে একঘরে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা – অন্য প্রদেশে কাজ করার সুযোগ হারানোর সমূহ বিপদ। সেই মুহূর্তে, শুধু ভাজপা-কে গালি পেড়ে ধান সেদ্ধ হওয়ার আশা কম।
কাজেই, কার “পেটের ভাত” আর কার “পেটে লাথি”-র অঙ্ক শোনাচ্ছেন দুর্গাপুজোর ছলে??
প্রাসঙ্গিক, প্রয়োজনীয় লেখা।