কী বলবো একে, বন্যার জলোচ্ছ্বাস নাকি ঝড়ের তান্ডব? লকডাউন একটু শিথিল হতেই সারা পশ্চিমবঙ্গ এসে আছড়ে পড়েছে আমাদের আউটডোরে। নয় নয় করে চিকিৎসক জীবনের অনেকগুলো বছর কাটলো কিন্তু এরকম পাগল পাগল অবস্থা কোনদিন হয়নি। এত মানুষ! এত চিৎকার! এত রোগ! এত কান্নাকাটি! ক’দিনের লকডাউনে যাবতীয় দীর্ঘদিনের রোগ ঘেঁটেঘুঁটে একাকার হয়ে গেছে। শহুরে ছাদের তলায় শুয়ে ঘূর্ণিঝড় যশের তান্ডব কবেই ভুলে গেছি আমরা কিন্তু তার ক্ষত এবার ধীরে ধীরে সামনে আসছে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অসহায়তার অযুত-নিযুত গল্পের সামনে অসহায় হয়ে বসে থাকছি। খসখসিয়ে তিনটে ওষুধ লেখা ছাড়া অথর্ব চিকিৎসকের আর কিচ্ছু করার নেই।
– সেই গত বছর অক্টোবরে শেষ দেখিয়েছিলে। তারপর?
প্রশ্নটা সহজ, উত্তরটাও জানা। তবু জিজ্ঞেস করি। পরপর উত্তর আসে-
– গাড়িঘড়া বন্দ হ’লি কী করি বলঅ ত? ভাড়াগাড়ির অত টাকা কথায় পাব? ঘরে পাঁসটা পেট…
– এখনঅ বন্যার জল ভালঅ করি সরে নি। জমিজমা সব গ্যেসে। খুব খারাপ অবস্তা। বাপের বাড়ি থিইক্যে আসতিসি। একোনো ঘরে ফিরতে পারিনি।
– গাড়ি নাই। আজ আমাদের উখান থিইক্যে মাছের গাড়ি আসতেসিল। সেই গাড়ি করে…
টেবিলের উল্টোদিকে ডাক্তারের দীর্ঘশ্বাস হাজারো চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্নাকাটিতে ঢেকে যায়। অকারণে পেপারওয়েটটা হাতের মধ্যে ঘোরাতে থাকি। খটাখট করে পেনের খাপটা খোলা-বন্ধ করি ক’বার। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আগুনের আঁচ পোহানোর কায়দায় বেকুবের মত প্রশ্ন করি-
– তাহলে তোমাদের চলছে কী করে?
জ্যা-চ্যুত তীরের মত উত্তর আসে-
– চলসে আর কই? কানেরটা মহাজনের কাসে বন্দক দি কুনোমতে…
– অর বাবা কোলকাতায় কাজ করত। লকডাউনের জন্যি সব কাজ বন্দ।
– ওই টুকটাক চাষবাস স্যালঅ। বন্যার পর কী হবে কে জানে…
আর তাদের বাচ্চারা? এতদিন করোনাকাল কাটিয়ে এলাম কিন্তু এত ঘেঁটে যাওয়া রোগী করোনাকালেও এই প্রথম। কবে থেকে ওষুধ বন্ধ কোনও হিসেব নেই। কেউ আবার ওষুধ খাইয়ে গেছে তো গেছেই। ওষুধ বন্ধের ফলে খিঁচুনি হ’লে মাথায় জল ঢালা আর অদৃষ্টকে অভিশাপ দেওয়া সম্বল। সবথেকে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে স্টেরয়েডের অপব্যবহার। সব ফুলে ফুটবল হয়ে গেছে, উচ্চতায় বাড়ছে না, রক্তচাপ আকাশ ছুঁই ছুঁই। ডাক্তার না দেখিয়ে দীর্ঘদিন মাত্রাতিরিক্ত স্টেরয়েড খাওয়ানোর ফলে চোখে ছানি পড়ে গেছে। তবু ওষুধ চলেছে পুরোদমে। কেউ কেউ কী ওষুধ খাইয়েছে তার কোনও ঠিক নেই। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে প্রেসক্রিপশন পাওয়া যায় না। ওষুধের খালি প্যাকেট কোথায় হারিয়ে গেছে, সে শুধু যশই জানে। ফলে ওষুধ সম্পর্কে বাচ্চার বাবা-মা যতটা অন্ধকারে চিকিৎসকও ঠিক ততটাই।
কত সামাল দেবো, কীভাবে সামাল দেবো জানিনা। শিয়ালদা স্টেশনে নামার পর ওরা দল বেঁধে এতটা রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে এসেছে। ওরা বিশ্বাস করে এসেছে, শহরের বড় ডাক্তার মন্ত্রবলে সব রোগ ভ্যানিশ করে দেবে। ওরা জানে না, শহরের ডাক্তার তার ক্ষুদ্র জ্ঞান আর সামর্থ্য নিয়ে প্রতিদিন আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। অসহায়তার স্রোতে সেও ভেসে যাচ্ছে।
বেশ পেট ভরে সকালের খাবার খেয়ে আউটডোরে এসেছি। মাঝে একবার দশ মিনিট উঠে গিয়ে এক কাপ চা। চায়ে চিনি বেশি হয়ে গেছে বলে মেসের দাদার কাছে মৃদু অভিযোগও জানিয়েছি। সত্যিই তো, এত চিনি দিলে শরবত খাচ্ছি নাকি চা খাচ্ছি বোঝা দায়। অভিযোগ জানানোর মতোই একটা বিষয় বটে! জানতাম না, তার কিছুক্ষণ বাদেই আমার কর্ণকুহর ফুঁড়ে ঢুকে যাবে কয়েকটা শব্দ-
– সকাল থ্যিকে এখনো খাওয়া হয়নি ডাক্তারবাবু। বাচ্চাটাও খায়নি।
কী নির্লজ্জের মত ভালো আছি, তাই না? কী নিরুত্তাপভাবে ভালো আছি। আউটডোর যখন শেষ হবে তখন আমার ভাতগুলো ঠান্ডা শক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু থাকবে। সুনিশ্চিত ভাবে আমার জন্য ভাত থাকবে। মাছের কাঁটা চেবাতে চেবাতে বলবো-
– তরকারিটায় একটু নুন কম হয়েছে, বুঝলে দাদা…
(ছবিতে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত স্টেরয়েড অপব্যবহারের ফলে ফুলে যাওয়া গোলুদের একজন)
© Soumyakanti Panda