কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলেই পরিচিত যুবকটিকে দেখতে পেলাম, হাতে কার্ড, “স্যার,সামনের রবিবার আমার ছেলের উপনয়ন আপনি অবশ্যই আসবেন। ঘটনাচক্রে এই ছেলেটিই বছর চোদ্দো আগে আপনার হাত ধরেই প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিল।”
বলব কি বলবো না ভেবে দ্বিধাগ্রস্ত চিত্তে যুবকটির পিঠে হাত রেখে সস্নেহে বললাম,”আমি তো ভাই উপনয়ন অনুষ্ঠানে যাই না।”
যুবকটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আমিও স্যার এই সব বিষয়ে খুব উদার, অনেক নিয়ম কাটছাঁট করে দিয়েছি।”
মৃদু হেসে ওকে বিদায় করে পিছন ফিরলাম। কতই বা বয়স তখন আমার বারো-তেরো হবে। দাদার সবেমাত্র পৈতে হয়েছে, কত পেন, বই উপহার, এমনকি একটা গোটা দু-চাকার সাইকেলও পেয়ে গেল।
“মা আমার কবে পৈতে হবে?” প্রশ্নের উত্তরে মা এর জবাব, “সময় হলেই হবে”। স্বল্পভাষী, গম্ভীর মায়ের এটুকু উত্তরই যথেষ্ট।
অবশেষে সময় এলো। তখন আমার ক্লাস সেভেন, এর পরেই পড়ার চাপ তাই এটাই সময়। মন আমার আনন্দে ভেসে যাচ্ছে। মামার বাড়িতে আগেই বলে রেখেছি, দাদাকে সাইকেল দিয়েছ, আমার চাই হাতঘড়ি-রিস্টওয়াচ। শুধু মাথা ন্যাড়া আর কানফুটো নিয়েই একটু চিন্তা। কিন্তু দুটো নাকি কাচকলা পাওয়া যায় যা দিয়ে কালা-নাপিতকে মারা যাবে। আমি রোজ টিপ প্র্যাকটিস করি আর মা বলে চলেছে,”খবর্দার জোরে মারবে না।”
“তিনদিন তোমাকে দণ্ডীঘরে থাকতে হবে, বাইরে বেশি বেরোনো যাবে না”–মা’র এমন নির্দেশ শুনে আমি বায়না ধরলাম, “ঠিক আছে, ঐ তিনদিন আমার বন্ধুরা আসবে, গল্প করবো, ক্যারম খেলবো। শিবুকে আসতে বলছি।
মা’র কপালে ভ্রূ কুঞ্চিত,”শিবু না এলেই নয়”।
“কেন? শিবু তো আমার সবচেয়ে বন্ধু, সবসময়ই আমার কাছে আসে, অসুবিধা কোথায়?”
মা এবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করল ,”ঠাকুর্দার আপত্তি আছে। ও তো শিবু ঘোষ।”
এই প্রথম জানলাম শিবু শুধু শিবু নয়, শিবু মানে শিবকুমার ঘোষ, অভিজিৎ মানে অভিজিৎ মুখার্জী। দণ্ডীঘরে অব্রাহ্মণের প্রবেশ নিষেধ। উপনয়নের খুশির স্বাদ কেমন তিতকুটে হয়ে গেল। এরপর যথাসময়ে উপনয়নও হোল। মা বললেন “তিনদিন পরে একটা অনুষ্ঠানে হবে, তোর সব বন্ধুদের আসতে বল, কোনো অসুবিধে নেই।“
কিন্তু সেই তিনদিনের মধ্যে ঘটলো আর এক ঘটনা। বুদা ঠাকুমাকে আমরা ঠাকুমা বলেই জানতাম। নিজের ঠাকুমাকে কোনদিন চোখে দেখিনি। সমস্ত কাজে দু-তিন দিন আগে থেকেই কোথা থেকে যেন বুদাঠাকুমা হাজির হয়ে যেতো। আর আমাদের সব বায়না–খাবারের ইচ্ছে সব বুদাঠাকুমা মেটাতো। বুদাঠাকুমা ছাড়া অনুষ্ঠান বাড়ি ভাবা যেতো না। তা সেই বুদাঠাকুমাকে অনেক খুঁজেও উপনয়নের তিনদিন আমার ধারেকাছে দেখতে পেলাম না।
জানলাম বালবিধবা বুদাঠাকুমা নাকি কোনো এক কালে ঘোষবাড়ীর বৌ ছিল।
ঐ বয়সে অদ্ভুত এক চিত্তবৈকল্য হলো। কালের নিয়মে বড় হলাম, ভেতরের কেউ যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করল, উপনয়ন একটা অত্যন্ত বাজে অনুষ্ঠান। যে কৈশোরে পৃথিবীর সব মানুষকে উদার চোখে দেখার কথা, সুকৌশলে সুচতুর ব্রাহ্মণকুল এই সময়ে তাদের চোখে বর্ণের ঠুলিটি পরিয়ে দেয়। এই সময়ে নাকি দ্বিজত্ব লাভ করে, নতুন জন্ম লাভ করে, কিন্তু এ কোন জন্ম!!
নিজস্ব জীবনে এসে ঠিক করলাম আর কোনো উপনয়ন অনুষ্ঠানে যাবো না। অনেকেই বলতে শুরু করল, আরে আমরা আজকাল আর অতো নিয়মকানুন মানি না। আরে এ উপলক্ষে খাওয়া দাওয়া তো হয়,আর ব্রাহ্মণের ছেলে সবকিছু তো তুলে দিতে পারি না।
কেউ কেউ বলল–নিজের ছেলের বেলায় কি করে দেখব!
দিন যায় প্রকৃতির নিয়মে আমিও পুত্র সন্তানের জনক হলাম এবং উপনয়ন ছাড়াই সে মুখার্জি পদবী নিয়ে যুবক হয়ে উঠলো। চাকুরি বা বিবাহ কোথাও কোনো অসুবিধা হয়েছে বলে জানা নেই।
আজ উপনয়নের নিমন্ত্রণ পেয়ে মনে হলো, উপনয়ন তো সত্যিই এক সূন্দর অনুষ্ঠান। বয়ঃসন্ধিক্ষণে এক কিশোরের নতুন জন্ম। এমন দিন কবে আসবে যেদিন জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল কিশোর বয়ঃসন্ধিকালে দ্বিজত্ব প্রাপ্ত হবে। উপনয়নের নতুন নয়ন দিয়ে এই জগৎ, জীব, প্রকৃতির দিকে দেখবে। সকলে নতুন গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত হবে যা সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাবে সকলকে ভালোবাসতে বলবে, নতুন সূর্য প্রণামের মন্ত্রে প্রকৃতি আরো সবুজ হয়ে উঠবে।
আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন একজন অব্রাহ্মণ পিতা তার পুত্রের উপনয়নের কার্ড হাতে আমার কলিংবেলে হাত রাখবে। আজ না হয় কাল নয়তো বা পরশু—আমি অপেক্ষায় রইলাম।