সন্ধ্যের চেম্বার তখন প্রায় শেষের পথে। হঠাৎই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন নন্দী বাবু। দীপক বাবুর ছেলেটা হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে গেছে।একটু দেখে দিতে হবে। চোখের ঈশারায় ভেতরে থাকা বিছানায় শুইয়ে দিতে বললাম। তিন চার জন মিলে ধরে শুইয়ে দিলো দীপক বাবুর ছেলেকে। সারা শরীর ঘামে ভিজে চপচপে। হাত পা ঠান্ডা। বছর পঁয়ত্রিশের ছেলেটির বড়সড় শরীর। পা দুটি ওপরে তুলে ধুরতেই হালকা চোখ মেলে তাকালো। তূরীয় চাহনির মাঝে মদিরার গন্ধে আমার ছোট্ট চেম্বারে তখন মাথা ধরে যাবার জোগাড়। ঘামে ভেজা হাতের কব্জিটা টেনে নাড়ি ধরে বুঝলাম, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে নাড়ি। হাতের ব্লাড সুগার মেসিনে দেখলাম অস্বাভাবিকভাবে সুগার (রক্তশর্করা) লেবেল নেমেছে। এর মাঝেই হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। উঁকিঝুঁকি উৎসুক জনতার মধ্যেও চিন্তার কাঁপুনি শুরু হলো।
আমি অবশ্য অত্যন্ত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, মদ খাওয়ায় সঙ্গী ক’জন ছিলো? কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর এলো – জনা ছ’য়েক।
কি দিয়ে মদ খাচ্ছিলেন? মানে ‘চাট’ হিসেবে কি খাচ্ছিলেন?
এবারের প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেলেন ভদ্রলোক? এহেন অবান্তর প্রশ্ন শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক জনতার কপালেও ভাঁজ পড়লো।
শুয়ে থাকা দীপক বাবুর ছেলে কিন্তু নির্দ্বিধায় কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন “ছোলা”।
এবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ভাগে কি কম ছোলা পড়েছিলো?
এবারের অহেতুক প্রশ্নে উৎসুক জনতার মাঝে নিন্দার গুঞ্জন শুরু হলো।
শুয়ে থাকা রোগী কিন্তু স্পষ্ট জবাব দিলেন “ছোলার ভাগ আমি প্রায় পাইইনি”
ব্যস, এবার আমার দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর পালা। আমাদের লিভার আমাদের শরীরের রক্তশর্করার নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ কিনা কোনো কারণে রক্তশর্করা কমে গেলে গ্লুকোনিওজেনেসিস জাতীয় পদ্ধতির মাধ্যমে রক্তশর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে স্বাভাবিক করে নেয়।
আবার কোনো কারণে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে তাকে আবার গ্লাইকোজেনেসিস জাতীয় পদ্ধতির মাধ্যমে কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনে।
কিন্তু এক্ষেত্রে লিভারকে আবার অ্যালকোহলকেও পরিপাক করতে হয়েছে। বেচারা লিভার দুয়ের মাঝে পড়ে অ্যালকোহলের পরিপাককেই প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। ফলে গোলেমালে রক্তশর্করার নিয়ন্ত্রণে নজর কম হওয়ায় কমে যাওয়া রক্তশর্করা বাড়িয়ে আর নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে সকাল থেকে না খেয়ে থাকা ও তারউপর ভাগের ছোলায় সঠিক ভাগ না পাওয়া – দুয়ের পাকেচক্রে রক্তশর্করার স্বাভাবিকতা আর ফিরে আসেনি। ফলে হাইপোগ্লাইসিমিয়া তৈরী হয়ে ঘামে মুড়েছে শরীর। শুরু হয়েছে কাঁপুনি।
চিকিৎসা নেহাৎই সহজ। সাথে সাথে ডেক্সট্রোজ শুরু করলাম।সাবধানতার আবহে থায়ামিন ইঞ্জেকশন দিলাম। সাথে অভয় দেওয়ার সাথে সাথে শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো উৎসুক অপেক্ষমান জনতা।
চিকিৎসার কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তের গ্লুকোজ স্বাভাবিক হতেই সুস্থ বোধ করতে শুরু করলেন রোগী।
চেম্বার ছেড়ে বেরোনোর আগে কানে কানে বলে দিলাম- এবার থেকে ছোলার ভাগটি ছেড়ো না বন্ধু।









