দিবি সূর্য্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ।।
পৃথিবীর ইতিহাসে, বিজ্ঞানের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য দিন। কালো দিনও কি বলা যায়? প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ। গীতার এই শ্লোক উচ্চারিত হয়েছিল পারমাণবিক বোমার জনক রবার্ট ওপেনহাইমারের ওষ্ঠে।
আকাশে যদি যুগপৎ সহস্র সূর্য্যের প্রভা উত্থিত হয়, তাহা হইলে সেই সহস্র সূর্য্যের প্রভা মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভাব তুল্য হইতে পারে।
সেই সহস্র সূর্যের প্রভা মানুষ দেখলো প্রথম পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণের মাত্র কয়েকদিন পর। জাপানের দুটি শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকি তার শিশু বৃদ্ধ পশুপাখি গাছপালা শুদ্ধ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে। মানুষ দেখল অতি ক্ষুদ্র কণা পরমাণু ভেঙ্গে গেলে কি অপার শক্তি নির্গত হয়। মানুষ অনুভব করল
“কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো
লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ।”
“আমিই মৃত্যু আমিই ধ্বংস।”
পরমাণুর মধ্যে নিহিত আছে অসীম শক্তি। ইলেক্ট্রন, প্রোটন নিউট্রন। পারমাণবিক কণা ভাঙ্গা গড়ার খেলায় মেতেছে। নির্গত হচ্ছে শক্তি। নির্গত হচ্ছে রেডিয়েশন। একদিকে সৃষ্টি একদিকে ধ্বংস। অপরিসীম শক্তি। সে কি কেবল ধ্বংসই করেছে? না।
১৮৯৫ সাল উইলহেম কনরাড রন্টজেন আবিষ্কার করলেন এক্স রে। আবিষ্কার করলেন ইলেকট্রনের স্রোত একটা টার্গেটে আঘাত করলে নির্গত হচ্ছে এক অজানা রশ্মি। যার নাম দিলেন এক্স রে। প্রায় একই সময় আরেক বিজ্ঞানী হেনরি বেকারেল রেডিওএক্টিভিটির ধারণা দিলেন। কিছু পদার্থ (পরমাণু) অস্থির এবং নিজে নিজে ভেঙ্গে যায় আর নির্গত হয় রেডিয়েশন মানে একধরনের রশ্মি। ঠিক এক্স রে র মতো ভৌত গুণাবলী সম্পন্ন। অসীম এর ক্ষমতা যা তখনো মানুষের অজানা। ১৮৯৮ সাল মানবজাতির ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশী ধীসম্পন্ন দম্পতি মেরী কুরী আর পিয়ের কুরী আবিষ্কার করলেন রেডিয়াম। রেডিয়েশনের উৎস। সেই পারমাণবিক ক্রীড়া। সেই ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রনের একে অপরের সাথে ভাঙা আর গড়া। পারমাণবিক শক্তি।
এক্স রে আর ন্যাচারাল রেডিয়েশন এরপর বদলে দেবে মানুষের জীবন। বদলে দেবে চিকিৎসা শাস্ত্র। এক্স রে ব্যবহার করে দেখা যাবে শরীরের ভেতর, এটা প্রায় সবাই জানেন। আধুনিক সিটি স্ক্যান ও যে এক্স রে ব্যবহার করেই হয় সেটাও অনেকে জানেন। কিন্তু জানেন কি ১৮৯৫ সালে এক্স রে আবিষ্কারের কিছু দিনের মধ্যে এমিল গ্রুবে নামে একজন, শিকাগো শহরে এই এক্স রে ব্যাবহার করে ফেললেন ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায়?
এদিকে মাদাম কুরী কাজ করে চলেছেন রেডিও এক্টিভিটি নিয়ে। বর্ননা করেছেন এর চরিত্রাবলী। জানা যাচ্ছে এই রেডিয়েশন ধ্বংস করতে পারে কোষ যা জীবনের একক। ভিয়েনােতে লিওপল্ড ফ্রন্ড সফল ভাবে একটি শিশুর হেয়ারি মোল মানে একটা ত্বকের অসুখ সারিয়ে দিলেন এক্স রে ব্যাবহার করে। তাও কত সালে জানেন? ১৮৯৬, এক্স রে আবিষ্কারের মাত্র একবছর পর।
একের পর এক আবিষ্কার হতে থাকল নানা রেডিওএক্টিভ বা তেজস্ক্রিয় মৌল। রেডিয়াম ব্যবহার শুরু হল ক্যান্সার চিকিৎসায়। খোঁজ চলতে লাগলো এমন তেজস্ক্রিয় মৌল যা থেকে নির্গত রেডিয়েশন ঢুকতে পারবে শরীরের গভীরে যেখানে ক্যান্সার আছে। রেডিয়াম বা কম শক্তির এক্স রে ব্যবহার করে সেরে যেতে লাগলো ত্বকের ক্যান্সার। যদি সম্ভব হয় শরীরের কোন গহ্বরে ক্যান্সার হলে, যেমন জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রেডিয়াম ঢুকিয়ে দেওয়া হল নলের মতো বা সুঁচের মাধ্যমে। কিন্তু শরীরের গভীরে ঢুকতে পারা যাচ্ছে না তবুও। অধরা থেকে যাচ্ছে অনেক ক্যান্সার। সব জায়গা রেডিয়েশন পৌঁছাতে পারা যাচ্ছে না।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। তৈরি হল নিউক্লিয়ার রিএক্টর। আমেরিকা হাতে নিল ম্যানহাটন প্রজেক্ট। বানানো হল গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র পারমাণবিক বোমা আর তার সাথেই মানুষ বানাতে সক্ষম হল রেডিওআইসোটোপ বা তেজস্ক্রিয় কণা। আবিষ্কার হল কোবাল্ট ৬০ তেজস্ক্রিয় মৌল। ড: হারল্ড ই জন স্যাস্কাচন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহার করার অনুমতি চাইলেন কোবাল্ট ৬০ মৌল, ক্যান্সার চিকিৎসায়। এ এমন একটা মৌল যা থেকে নির্গত হয় উচ্চ শক্তির গামা রেডিয়েশন যা শরীরের গভীরে প্রবেশ করে ধ্বংস করে ক্যান্সারের কোষ।
১৯৫১ সালে সফল ভাবে ওয়ার মেমোরিয়াল চিলড্রেন্স হাসপাতালে (লন্ডন ওন্টারিও) সফল ভাবে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হল কোবাল্ট ৬০। এরপর এই বিগত দশক পর্যন্ত কোবাল্ট ৬০ দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়েছেন অযুত নিযুত ক্যান্সার রোগী। মানুষ কোষের ভেতর পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখল এর রেডিয়েশন বা রে বিনষ্ট করে দিতে পারে অমর ক্যান্সার কোষের ডি এন এ। মৃত্যু ঘটে ক্যান্সার কোষের। সুস্থ হন রোগী।
এদিকে এক্স রে নিয়ে চলেছে গবেষণা, কেবল রোগ নির্নয় বা ডায়াগনোসিস এই নয়, এক্স রেও যে ঠিক একই রকম রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয় রশ্মি তা মানুষ জেনেছে বহুদিন, ব্যবহার হয়েছে ক্যান্সার চিকিৎসায়। কিন্তু সমস্যা একটিই, কম শক্তির এক্স রে শরীরের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। এবার এই এক্স রে-কে আরো শক্তিশালী করার গবেষণা জন্ম দিল লিনিয়ার এক্সিলারেটরের, যার সাহায্যে ইলেকট্রনকে গতি বাড়িয়ে বানানো হল উচ্চ শক্তির এক্স রে। কোবাল্টের মত কেবল একটি নির্দিষ্ট শক্তি নয়, যেমনটা চাই ঠিক তেমনি শক্তির রে বানানো সম্ভব হলো। আবার ক্যান্সার বা টিউমারের আকার অনুযায়ী এই এক্স রে-কে নির্দিষ্ট আকারে বেঁধেও ফেলা গেল। স্বাভাবিক কোষ বাঁচিয়ে মেরে ফেলা গেল ক্যান্সার কোষ। সুস্থ হতে লাগলেন শত শত রোগী। কমে গেল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এর সাথে যুক্ত হলো কম্পিউটার। কঠিন কঠিন গণনা করে রেডিয়েশনের ডোজ সঠিক ভাবে দেওয়া সম্ভব হলো।
পারমাণবিক শক্তি, অনিয়ন্ত্রিত, ধ্বংস করে দিয়েছে গোটা শহর। মানুষ একের পর এক গণবিধ্বংসী মারণ পারমাণবিক অস্ত্র জড়ো করেছে আবার সেই একই পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সুস্থ করছে লক্ষ লক্ষ ক্যান্সার রোগী।
মানুষই পারে। মানুষের হাতে অপার শক্তি।
“তত্বমসি” আমিই সেই। আমিই সর্বশক্তিমান
“অহম ব্রমহাস্মি” এই অপার শক্তি ব্যাবহৃত হোক মানব কল্যাণে।
“সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ
সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।
সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু
মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ্ভবেৎ।।”
৬ই আগস্ট ছিল হিরোশিমা দিবস, আগামী ৯ই আগস্ট নাগাসাকি দিবস।