আগের পর্বগুলোয় কিছু মানুষের সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আমার দেখানো একটা দিকের বাইরে পাঠক তাদের সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। এবারের পর্বে যিনি থাকবেন, তাঁকে সবাই চেনেন। আমার থেকে কিছুটা বেশিই চেনেন। তবু মনে হলো আমার জীবনের একজন প্রায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকে যদি ‘আমার চেনা’তে না চেনাই তাহলে তো আখ্যানটাই অসম্পূর্ণ থাকবে। আমাকে তো জানতে তোমাকেই খুঁজেছি। “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।/ এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।’
ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচয় হবার পরপরই। তখনকার মায়েরা এখনকার মায়েদের মতো হাতে প্লাস্টিকের অক্ষর তুলে দেবার বদলে বর্ণপরিচয় তুলে দিতো। কালো স্লেটে সাদা খড়িতে আঁকা হতো মাতৃভাষার লিখিত রূপ। অক্ষরগুলোর সঙ্গে সড়গড় হয়ে গেলেই হাতে উঠতো সহজপাঠ। অজান্তে রবীন্দ্রনাথকে জানা। সেখানেও স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ শেখা- তবে একটু অন্যভাবে। “ছোটো খোকা বলে অ আ/ শেখেনি সে কথা কওয়া।” এতো ছন্দবদ্ধ ভাবে মাতৃভাষা শেখার সৌভাগ্য খুব কম জাতির ভাগ্যে জোটে। তার সাথে উপরি পাওনা নন্দলাল বসুর আঁকা। “রেগে বলে দন্ত্য ন/ যাব না তো কক্ষনো”র সঙ্গে আঁকা রাখালের ছবিটা মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। রাখাল একটা গরুকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। গরুটাও বেশ বেয়াড়া, কিছুতেই যাবে না। অবাক চোখে ছবিটা দেখতে দেখতে ‘দন্ত্য ন’র ভেতরে ঢুকে যেতাম। গরুটাকে ছেড়ে দিয়ে শিশু আমি রাখালের সাথে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতাম।
একটু বড়ো হতে ‘বাধ্যতামূলক আবৃত্তি’ করতে হতো। সে তো সবাইকেই করতে হয়। কিছুটা বড়োদের মনোরঞ্জনের জন্য আর কিছুটা স্কুলের চাপে। সেখানেও রবীন্দ্রনাথ। “মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।” কবিতাটা একটুখানি এগোনোর পরই খুব নাটকীয় ভাবে চোখ পাকিয়ে বলে ওঠা- এমন সময় ‘হাঁরে রে-রে-রে-রে’/ ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে।
অধিকাংশ বাঙালী বাচ্চাদের মতো আমিও ওই কবিতা আবৃত্তি করেছি।
আর বাচ্চাদের নাটকের হাতেখড়ি হয় ডাকঘর নাটক দিয়ে। আমি সেজেছিলাম রাজকবিরাজ। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় জানতেন যে আমাকে ভবিষ্যতে কবিরাজি করেই খেতে হবে। একগাল নকল দাড়িগোঁফ পরে নাটকটা করতে হয়েছিল। এরমধ্যে মুশকিল ব্যাকস্টেজে দাড়ি নিয়ে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। গরমকাল। ঘামে দাড়ির আঠা গেল নরম হয়ে। ডায়ালগ বলবো না দাড়ি সামলাবো? কিছু ডায়ালগ ভুলভাল বলা হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। নয়তো কবিরাজের কথায় দর্শকদের হাসার কোনো কারণ ছিলনা। বাবা-মা নাটক দেখতে এসেছিল। বলেছিল – ওটুকু ধরতে নেই।
প্রথম বাঁদরামোও রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। যখন জানলাম রবীন্দ্রনাথ কখনো স্কুলে যাননি তখন আমার সে কি আনন্দ! কি একটা কারণে সেদিন আমার স্কুলে যাবার মোটে ইচ্ছে নেই। (হয় হোমওয়ার্ক হয়নি, নয়তো আকাশে প্রচুর ঘুড়ি উড়ছিল।) মায়ের কাছে রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ টেনে আনলাম। মাও আমার কান টেনে লম্বা করে দিল। আমার মা খুব মারকুটে ছিল। আগের জন্মে নাৎসি সরকারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের দায়িত্ব প্রাপ্ত অফিসার ছিল আমার মা। যেটুকু লম্বা হয়েছি সেটা মায়ের জন্যই।
লেখা পড়ে প্রথম কাঁদা? কার্টসি রবীন্দ্রনাথ। দেবতার গ্রাস কবিতায় –“মাসি’ বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক/ অনন্ততিমিরতলে; শুধু ক্ষীণ মুঠি/বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি/ আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।/ “ফিরায়ে আনিব তোরে’ কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে/ ব্রাহ্মণ মুহূর্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে–/আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।” পড়ে আকুল হয়ে কেঁদেছিলাম। ‘পূজারিণী’ কবিতাও কাঁদিয়েছিল।
বাঙালী প্রেমে পড়বে অথচ রবীন্দ্রনাথ উঁকি দেবেন না- তা কি হয়? আমাদের প্রজন্মকে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার হাতছানি দেওয়া শিখিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। তাঁর পরিচালিত শ্রীমান পৃথ্বীরাজে “সখী, ভাবনা কাহারে বলে”, দাদার কীর্তির ” বঁধু, কোন আলো লাগলো চোখে” বা ভালবাসা ভালবাসার “হার মানা হার পরাবো তোমার গলে” শুনিয়ে কত ছেলে মেয়ে পরস্পরের প্রতি প্রেম নিবেদন করেছিল তার ইয়ত্তা নেই। দুটো নারী-পুরুষের মধ্যে প্রেম হবে অথচ রবীন্দ্রসংগীত হাইফেন হবেনা সেটা আমাদের সময়ে ভাবা যেতনা।
বয়স এগিয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে নতুন নতুন করে জেনেছি। বয়সের সাথে সাথে কিছু কিছু গানের মানে বদলে গেছে নিজের কাছেই। “তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে ” যে মানে নিয়ে একটা একুশ বছরের ছেলে গেয়েছিল সেই মানেটা একটা পঞ্চাশ বছরের পৌঢ়ের কাছে সম্পূর্ণ অন্য অর্থ নিয়ে ফিরে আসে। বা আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায় – এখন গভীরভাবে ভাবায়।
প্রিয়জন হারানোর বেদনায় রবীন্দ্রনাথ স্বান্তনা হয়ে পাশে দাঁড়ান। বাবা-মার মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথকে ভেবে সামলে উঠেছিলাম। প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর পর কি অসামান্য উপলব্ধি তাঁর- “শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্চে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই।” বুক নিংড়ে নিজেকে বুঝিয়েছি- “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ।।”
অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসি বলেই সম্পাদক মশাই আমাকে ‘অনেক মানুষ, একলা মানুষ’ ধারাবাহিক ভাবে লিখতে বলেছিলেন। কিন্তু একলা মানুষ হয়ে দাঁড়ানোর সময়েও যে মানুষটা পাশে থাকেন তাঁকে উপেক্ষা করি কি করে?
অসাধারণ,
অনেক ধন্যবাদ 😊🙏
Rating 110/100
Thank you Dada
অসাধারণ sir.আজ 22 শে শ্রাবণের দিনে একদম উপযুক্ত গল্প।
ধন্যবাদ রিয়াঙ্কা😊🌷