আজকের জরুরী মিটিং-এ সুবিমলবাবুও আমন্ত্রিত। বয়েস নব্বুই ছুঁইছুঁই। এখনো ঋজুভাবে হাঁটেন, কয়েকদিন আগে পর্যন্ত নিয়মিত পথে বেরোতেন। ইদানীং পথে-ঘাটে বাইক, টোটোর অবাধ গতিতে একটু সন্ত্রস্ত। কিন্তু খবরের কাগজ নিয়মিত পড়েন, টিভির খবর শোনেন। কিন্তু কোথাও কিছুতে মতামত আজকাল আর দেন না।
লোকাল কাউন্সিলর ছেলেটি অবশ্য বলেছিল, “স্যার”–, আজকাল তো আবার মেসোমশাই, কাকাবাবু ডাক উঠে গেছে, সবাই স্যার। তা সে বলছিল, “স্যার, গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।”
সুবিমলবাবুই হেসে বলেছিলেন,”না না, এই তো সামনেই স্কুল। আর রোববার, রাস্তাঘাট ফাঁকা। ও আমি হেঁটেই চলে যাব।”
আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই চলেছে স্কুলের মিটিং-এ। এ এক অভূতপূর্ব সমস্যা। এলাকায় শেষ ছ’মাসে প্রায় দশজন অসুস্থ মানুষ বাড়িতেই মারা গেছেন, কিন্তু কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় নি, কাজেই ডেথ-সার্টিফিকেটের অভাবে প্রত্যেকেরই পোস্ট-মর্টেম হয়েছে।
“তুই একবার ভাব”–স্বপনবাবু বলছিলেন, “আমার বাবা অশীতিপর বৃদ্ধ, অসুস্থই ছিলেন। শেষ ইচ্ছেয় বাড়িতে রেখেছিলাম। যখন শেষ অবস্থা কোনো ডাক্তার পেলাম না!”
“আরে ডাক্তার পাবি কোথায়? এলাকার সব ডাক্তারই তো এখানকার বাড়ি ছেড়ে দূরের আবাসনের বাসিন্দা। হাসপাতালে নিয়ে গেলি না কেন?”
“সে এক মজার ব্যাপার। কি নাকি ‘ব্রট ডেড’ লিখে সোজা পোস্ট-মর্টেমে পাঠিয়ে দিল।”
“শালাকে একটু চমকালি না কেন?”
“আরে আজকালকার ডাক্তাররা ক্যালানিকেও ভয় পায় না। থানা,পুলিশ ,কাউন্সিলর সবাই পিছু হটল। ‘ব্রট ডেড’-এর নাকি এটাই নিয়ম।”
“আমাদের পুলিশ আবার বলে কিনা আপনি যে বাবাকে মারেন নি, তার কি প্রমাণ। ভাব একবার!”
হঠাৎই একটা ব্যস্ততার ভাব মিটিং-এ। স্থানীয় বিধায়ক অলক রায় আর কমল মাজিও হাজির।সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আজকের মিটিং-এ এঁরা কি বলেন।
সবাই মিলে এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ সুবিমলবাবুকেই মঞ্চে সভাপতি করে দিল। অবশ্যই সর্বসম্মতিক্রমে নয়। বিধায়কের উপস্থিতিতে অন্য কেউ সভাপতি ইদানীংকালে বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু কোথায় যেন আজকের সভাটা একটু অন্য সুরে বাঁধা।
“বন্ধুগণ”–তরুণ ছাত্রনেতা বলতে উঠেছেন, “সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ডাক্তাররা ডাক্তারি পড়ে পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে, এলাকার মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এর একটা বিহিত এখুনি হওয়া দরকার। মেডিকেল কাউন্সিল আমাদের। রেসিডেন্সিয়াল অ্যাড্রেসে না থাকলে এদের রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া হোক।”
“এতোই কি সহজ”– ফিসফিস করলেন এলাকার শিক্ষক।
“আমাদের দাবি, লোকাল কাউন্সিলরদের ডেথ-সার্টিফিকেট দেবার অধিকার দেওয়া হোক”–কাউন্সিলর সমীরণ বলল।
আরো সব কাউন্সিলররা সগর্বে উচ্চরোল তুলল, “রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট, ক্যারেকটার সার্টিফিকেট যদি দিতে পারি, হোয়াই নট ডেথ সার্টিফিকেট?”
বিধায়ক উঠলেন, “এভাবে তো আমরা আপনাদের ক্ষমতা দিতে পারি না।”
হৈ হৈ করে উঠলো সব কাউন্সিলররা, “কেন নয়?”
“আমরা ওপরে দাদা বা দিদির সাথে কথা না বলে”–
কথা শেষ করতে দিল না এলাকাবাসী, “আর কতদিন একথা শুনব? আমাদের এলাকার মানুষের কি স্বাভাবিক মৃত্যু হবে না?”
“আরে অসুখ করলে তো কিছু মানুষ মারা যাবেই, এটাই তো স্বাভাবিক।”
“হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটাই আমরা ভুলে গিয়েছিলাম”–মঞ্চে উঠেছেন বর্ষীয়ান শিক্ষক অলকেশ লাহিড়ী।
এলাকার সকলের শ্রদ্ধেয়। “আমরা একবারও ভাবছি না চিকিৎসকরা কেন চলে গেলেন।আমাদের এই এলাকায় অন্তত পাঁচজন চিকিৎসকের বাড়ি ছিল, যাঁরা নিজের বাড়িতেই রুগী দেখতেন, রাত-বিরেতে সাড়া দিতেন।”—সবাই মন দিয়ে শুনছে,”এক একটা মৃত্যু, ভাঙচুর, অপমান তাঁদের সপরিবারে পাড়াছাড়া করল।”
“তাই বলে তারা ভুল চিকিৎসা করে পার পেয়ে যাবে?”—কাউন্সিলরের সহকারী এক বছর ষোলোর হুঙ্কার।
“তবে তো শুধু ডেথ সার্টিফিকেট কেন, এলাকার চিকিৎসার অধিকারও কাউন্সিলরদের হাতে তুলে দেওয়া হোক”—কিছু মানুষ সরব।
“আমাদের এ মিটিং অনেক আগে করা উচিত ছিল”—অলকেশবাবু বলে চলেছেন, “আমরা একজন ডাক্তারকেও আটকাতে পারিনি বরং ব্যস্ত ছিলাম ওঁদের ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে পার্টি অফিস, ক্লাবঘর আর পেছনের বাগানে সাট্টা-জুয়ার আড্ডা বসানোয়। এখন সময় এসেছে ওনাদের ফেরানোর।”
“তা সিএম-কে দিয়ে একটা অর্ডার বের করলেই হয়, ‘গো ব্যাক টু ইওর হোম'”-––কাউন্সিলরের সহজ সমাধান।
“অতটা বোধহয় সহজ নয়”—মুচকি হেসে মঞ্চ ছাড়লেন অলকেশ বাবু।
মিটিং প্রায় শেষের মুখে, কোনো সমাধান সূত্র নেই।সভাপতির ভাষণ দিতে সুবিমলবাবু উঠলেন। দুটি ছেলে ধরতে এসেছিল, নিজেই তাদের সরিয়ে দিলেন, “এই জীবনটাতে তো অনেক দেখলাম।আজ আমি অবাক হলাম কোনো একজনও চিকিৎসককে ডাক্তারবাবু বললেন না। আজ এলাকা চিকিৎসকশূন্য হওয়া একটা দীর্ঘ মেয়াদী ক্রিয়া-কর্মের ফল। আজ চিকিৎসকেরা এক সমাজবহির্ভূত জীব”—-একটু হাঁফাচ্ছেন বৃদ্ধ সুবিমলবাবু। একটু জল খেলেন, “আমি বলি কি বাবা, ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে বেশ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ডাক্তারবাবুদের ফিরিয়ে আনতে হবে।বল রাজী আছো?”
সমস্বরে প্রায় সবাই বলে উঠল, “বলুন কাকাবাবু, বলুন দাদু।”
সুবিমলবাবু লক্ষ্য করলেন, একটাও “স্যার” শোনা গেল না। বিধায়করা উসখুস করে কাজ আছে বলে সভা ত্যাগ করলেন। সুবিমলবাবু শুরু করলেন, “প্রথমেই ছ’মাস শুধু ‘ডাক্তারবাবু’ বলা অভ্যেস করো। শুধু ডাক্তার নয়, ডাক্তার বললেই বাবু যোগ করতে হবে। তাহলেই দেখবে মুষ্টিবদ্ধ হাত আলগা হয়ে যাচ্ছে।”
সভার মধ্যে বিড়বিড় সুর শোনা গেল, “ডাক্তারবাবু!ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু।”
“এবার আমরা নিজেদের মধ্যে পাঁচজন করে দায়িত্ব নিই, ডাক্তারবাবুদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলো দখলমুক্ত করে সংস্কার করার। বাড়িগুলো যথেষ্ট ভালো করে ওনারা করেছিলেন। সেই বাড়ি বাগান সুন্দর করে সাজিয়ে ওঁদের মাসে বা সপ্তাহে একদিন বেড়াতে আসতে বলা হোক।”
“ওঁরা আসবেন?”
“অবশ্যই আসবেন। আমরাই ওঁদের বাড়ি বাগান পাহারা দেব। ওনাদের পরিবারকে এলাকার অতিথি করে নেবো। এটা কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া।”
“আর আমাদের চিকিৎসা!”
“ডাক্তারবাবুরা চিকিৎসা না করে থাকতে পারেন না।”
সুবিমলবাবু তাঁর সিরিয়াল দেখা নলেজে সবায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “তাহলে? ডান?”
সবাই সমস্বরে বলে উঠল,”ডান।”