১.
আউটডোরে মারমার কাটকাট ভিড়। পাঁচ-ছ’জন ডাক্তার মিলেও হিমশিম খাচ্ছি। সকাল সাড়ে ন’টায় বসে ওপিডি শেষ করতে করতে সাড়ে তিনটে-পৌনে চারটে বাজছে। এখন যত দিন যাবে ভিড় আরও বাড়বে। রাজ্য কিংবা রাজ্যের বাইরের অন্যতম রেফারেল সেন্টার আমাদের হাসপাতাল। দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগী। বিচিত্র তাদের ভাষা, পোষাক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান। কেউ পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের অভাবে ধুঁকছে, কেউ অগাধ প্রাচুর্যের ছাপ নিয়ে স্ফীতোদর হয়ে হাঁফাচ্ছে। কেউ মারীর আতঙ্কে দীর্ঘদিন হাসপাতালমুখো হয়নি- রোগ ঘেঁটে ঘ। কেউ তিনদিনের সর্দিকাশিতে তিনজন ডাক্তার বদলের পর টেবিলে একদিস্তা প্রেসক্রিপশন আর একবস্তা ওষুধ রেখে বলছেন, “ডক্টর, ওকে ক্ল্যাভাম, অ্যাজিথ্রাল আর ট্যাক্সিম-ও খাইয়েছি কিন্তু কাশিটা কমছে না। আরেকটু ভালো অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিন না… দাম নিয়ে ভাবতে হবে না। যা ভালো হয় লিখুন।” কারো কোলে দুটো বাচ্চা, আঁচলে জড়িয়ে আরও দুটো, ডানহাতে হাতপাখা, পায়ে সস্তা তাপ্পিমারা চপ্পল। স্পাইডারম্যান আঁকা টি-শার্টের বাচ্চার ডানদিকে চিপসের প্যাকেট হাতে বাবা আর বামদিকে ‘ছেলে আমার কিচ্ছু খায় না’ বলা মা-ও বিরলদৃষ্ট নয়। কেউ অপারেশনের ডেট না পেয়ে পেয়ে জুতোর সুখতলা খুইয়ে ফেলেছে, কেউ নাভির ওপরে দেড় মিলিমিটার লম্বা ফুসকুড়ি নিয়ে ভেবে আকুল। মাঝে-মাঝেই চ্যাঁচামেচি, “ওই হলুদ জামার মা লাইন ভেঙ্যা আগে ঢুকে গ্যালঅ গ। ওই তো… ধর! ধর দিকিনি! আমরা কুন সক্যাল থ্যিকানু লাইন দিছি আর উ আগে দেখি লিব্যা?” সিকিউরিটি দাদাদের গলা পাওয়া যাচ্ছে, “লাইন করে আসবেন। মাস্ক ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। চার নম্বরের বাইরে ওজন করে ডাক্তারবাবুর কাছে যাবেন।”
– বিলাড টেসের ঘর কথায় বলত্যে পারব?
– ইমার্জেন্সি থেকে ভর্তি করতে বলেছে। সেটা কোনদিকে?
– বাচ্চার খুব পেটে ব্যথা। আগে ছেড়ে দিন না দাদা…
আরও কত-কত্ত কথার গিজগিজ! তার ওপর ক্যান্টিনের চায়ের হাঁক, অ্যাম্বুলেন্সের ট্যাঁওওও, স্ট্যাম্প মারার ঘটাস, চেয়ার-টেবিল সরানোর খটাখট, কোভিড ভ্যাক্সিনের জন্য মাইকে ঘোষণা। আর সব ছাপিয়ে প্রাজ্ঞ সত্যান্বেষীর মতো অনেক ওপরে থেকে ঘটাং ঘটাং করে ঘুরে চলেছেন ঝুলপড়া সিলিং ফ্যান। স্বাস্থ্য-শ্রমিকদের জন্য হাওয়া-বিলাসের আয়োজন। নিচে ঘাড় গুঁজে হাঁফাতে হাঁফাতে প্রাণপণে লাইন কমাচ্ছেন সরকারি চিকিৎসক। প্রতি রোগীর জন্য বরাদ্দ দেড় থেকে দু’মিনিটে ওই যতটুকু হয়। রোগীর বাড়ির লোক ভাবছে- রাত থেকে উঠে, না খেয়ে, এতদূর এলাম; হারামির বাচ্চা ডাক্তার শালা ভালো করে দেখলোই না। ডাক্তার ভাবছে, চারটে বাজতে চললো- দুপুরের খাওয়া তো দূরের কথা, সকালের হাল্কা টিফিন কবেই হজম হয়ে পেটে ছুঁচোর ডন!
২.
অথচ, ব্যাপারগুলো অন্যরকম হতে পারতো। নাক দিয়ে জল ঝরা, পেট গুড়গুড় আর দেড় মিলিমিটার ফুসকুড়ির চিকিৎসাগুলো বাড়ির পাশের হাসপাতালেই হয়ে গেলে বড় হাসপাতালের ভিড় অনেক কমতো। তাতে জটিল রোগের চিকিৎসা অনেক যত্ন নিয়ে করা সম্ভব হ’ত। রেফারেল সিস্টেম ভালো হ’লে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার মাথা ভারী হয়ে পড়তো না। আপনার হাতে টাকা থাকলে অবশ্য আপনি এসব যুক্তি শুনতেই চাইবেন না। যেমন ভাবে বাজারে আলু-পটল কেনেন সেভাবেই ডাক্তার ‘কিনতে’ চাইবেন। ‘স্রেফ এমবিবিএস’ ডাক্তার দেখলে আপনার নাক শিঁটকোয়। অফিস-ফেরত মাথাব্যথায় নিউরোলজিস্ট, প্রেশার মাপাতে কার্ডিওলজিস্ট ছাড়া আপনার চলে না। চৌখস শব্দরাজি শোভিত স্বরযন্ত্র ভরা-শ্রাবণের দাদুরীসম বেজে ওঠে, “আমরা অ্যাপোলো-আমরি ছাড়া দেখাই না।”
চিকিৎসা ব্যবস্থায় জেনারেল ফিজিশিয়ানদের অর্থাৎ আপনার ভাষায় ‘পাতি এমবিবিএস’-এর অবদান অনস্বীকার্য। গ্রামীণ স্বাস্থ্যের উন্নতি না করে, উপযুক্ত রেফারেল সিস্টেমের প্রচলন না করে স্বাস্থ্যবীমা আর আকাশঝাড়ু সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের ঢক্কানিনাদ একটি বিশুদ্ধ গিমিক।
৩.
আগে এমবিবিএস ডাক্তার দেখবেন। তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। তারপর, প্রয়োজন মনে করলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পরামর্শের জন্য পাঠাবেন। একাধিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শের প্রয়োজন হ’লে সবার প্রেসক্রিপশন দেখেশুনে আবার ছোটখাটো কিছু সংশোধন করার দরকার হ’লে সেটা সংশ্লিষ্ট জেনারেল ফিজিশিয়ান-ই করবেন। আপনি বলবেন, বিশেষজ্ঞের ওপরে আবার জেনারেল ফিজিশিয়ানের ফোঁপরদালালি কেন? কারণ, দুজন ভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ একই ধরনের দুটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন। যেখানে হয়তো দুটোর মধ্যে একটা হলেই চলবে। কিংবা ধরুন, দুটো ওষুধ একসাথে খাওয়া যায় না। দুটো প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে সেই কাটা-ছেঁড়ার কাজটা করবেন জেনারেল ফিজিশিয়ান।
আপনি বলবেন, এসব আবার হয় নাকি? এ তো অবাস্তব ব্যাপার! না। অবাস্তব নয়। সত্যিই এরকম স্বাস্থ্যস্বর্গ আছে। চলুন, চেঙ্গাইলের (হাওড়া) শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য-কেন্দ্রের গল্প শোনাই। কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ডা. পুণ্যব্রত গুণ। আমাদের ভালোবাসার, শ্রদ্ধার পুণ্যদা। যদিও ‘কেন্দ্রবিন্দু’ কথাটা আক্ষরিক অর্থে সঠিক হলেও ভাবার্থে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। এখানে ‘আমরা সবাই রাজা’। তাই স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক এবং একজন সাফাই-কর্মীর মতামত একই গুরুত্ব বহন করে। রোগীর নাম নথিভুক্ত হওয়ার পর ওজন, রক্তচাপ, উচ্চতা ইত্যাদি লিখে রাখেন এক বা দু’জন প্রশিক্ষিত কর্মী। বাংলায় লেখা রোগের ইতিহাসের ছক পূরণ করে দেন আরও জনা দুই-তিনেক প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী। তারপর, রোগীকে প্রথমে দেখেন জেনারেল ফিজিশিয়ান। পুণ্যদা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন জেনারেল ফিজিশিয়ান রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকদের মধ্যে ডা. মৃণ্ময় বেরা এখানে নিয়মিত চিকিৎসা করেন। মৃণ্ময় মেডিক্যাল কলেজে আমার জুনিয়র। অন্যান্য চিকিৎসকদের সবার নাম নিলে লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাবে। এমনিতেই আমার এসব লেখা পড়ার যোগ্য হয় না। আকারে বাড়লে সম্ভবত আমি ছাড়া আর কেউই পড়বেন না।
জেনারেল ফিজিশিয়ানের রেফারেল অনুযায়ী রোগী শিশুরোগ, চর্মরোগ, মানসিক স্বাস্থ্য, চক্ষু, ইএনটি, গাইনি, ফিজিওথেরাপি, ফিজিক্যাল মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ পান। রক্ত-মূত্র পরীক্ষা, এক্স-রে, ইউএসজি, ইসিজি, স্পাইওরোমেট্রি, সাইকোলজির পরীক্ষা ইত্যাদিও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যেই হয়। জেনেরিক নামে লেখা ওষুধ পাওয়া যায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ফার্মাসিতে।
এতসব শোনার পর আপনি ভাবছেন খরচ নিশ্চয়ই আকাশ ছুঁইছুঁই। তাহলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একদম শুরুর দিনগুলো থেকেই বলি। ১৯৯৫ সালের ২১ শে মার্চ ডা. গুণ লক-আউট হওয়া কানোরিয়া জুটমিলের শ্রমিকদের নিয়ে এই মহাযজ্ঞের গোড়াপত্তন করেন। তখনও ক্লিনিক বসতো সপ্তাহে ছয়’দিন। ডাক্তারের ভিজিট ছিল এক টাকা। তারপর আড়াই দশক পেরিয়ে এখনও জেনারেল ফিজিশিয়ানকে দেখানোর খরচ মাত্র কুড়ি টাকা! রেফার হ’লে প্রতি জায়গায় কুড়ি টাকা হিসেবেই বাড়তি দিতে হয়। ওষুধ কিংবা পরীক্ষার খরচও নামমাত্র। প্রতিদিন এক-দেড়শো মানুষ এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। শুধু, আসার সময় জেনে আসবেন এখানে এলে আম্বানি আর হরিদাস পাল একইভাবে চিকিৎসা পান। এখানে হজমি সিরাপ, লিভার টনিক, খিদে বাড়ানোর ওষুধ ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখা হয় না। আর এই টাকার মধ্যেই প্রায় ত্রিশজন স্বাস্থ্যকর্মীর মাসোহারার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ, এটুকু প্রমাণ করা যায়- সরকার চাইলে খুব অল্প খরচে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বিনামূল্যে সবার চিকিৎসা সম্ভব।
এ তো গেল বাইরের দিক। এবার নিজের কথা একটু বলি। ছাত্রাবস্থায় এবং পরে চিকিৎসক হিসেবে অনেকবার চেঙ্গাইলের এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেছি। গেলেই চা-মুড়ি কিংবা ডিমটোস্ট। পরিচিত দাদা-দিদিদের সাথে জমিয়ে আড্ডা। তার মধ্যেই রোগী দেখা। দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থাও ওখানেই।সাথে কাছ থেকে একটা আগুনকে দেখার সুযোগ। আমি ছাপোষা, ঘরকুনো মানুষ। ল্যাতপেতে শিরদাঁড়া নিয়ে কোনোরকমে টিকে থাকি। ডাক্তারি করতে গিয়ে যে নেহাত ভেসে যাইনি তার একটা বড় অবদান ওই আগুনটার। শুধু আমি নই; আমার মতো নতুন প্রজন্মের অনেক ডাক্তারের কাছে তিনি আদর্শের আগুন। ডা. গুণ। চোখে মোটা চশমা, জামার ওপরের দুটো বোতাম খোলা, পায়ে চপ্পল; ষাটোর্ধ একটা লোক। কথা বলতে গেলে আটকে যায়। “এত বিবিইইইড়ি খেয়ো না। মরে যাবে শালা। বিড়ি ববঅঅন্ধ না করলে আমি ওষুধ লিখবো না।” লোকটা রেগে গেলে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চিৎকার করে। রোগীর জন্য ভালোবাসা ভরা বিস্তীর্ণ বুক দিয়ে তাদের আগলে রাখে।
আমার কাছে চিকিৎসক বলতে ঝাঁ-চকচকে হাসপাতালের হাল্কা আলো শোভিত পরিবেশের কোট-টাই-রিমলেস ভেসে ওঠে না। মারীর দেশের শীতল অন্ধকারে ডা. পুণ্যব্রত গুণের মতো আগুনের প্রয়োজন। বড্ড প্রয়োজন।
(ন’বছরের পুরোনো ছবি। ‘মাস্ক নেই কেন’ জানতে চাইবেন না।)