সত্যি বলছি, শুরুতে মনখারাপ হচ্ছিল। আর খুব খুউব কষ্ট।
তার পরের ধাপে, খুব রাগ হচ্ছিল। সাঙ্ঘাতিক রাগ – এবং অক্ষম একটা রাগ।
এবং তারও পর, হতাশা।
আর এই মুহূর্তে, ঘেন্না। স্রেফ রাগ আর ঘেন্না।
এরা পার পেয়ে যাবে! এরা!! এরা ডাক্তারি করতে থাকবে!! এরা অসুস্থ অসহায় মানুষের চিকিৎসা করবে – কেউ কেউ হয়ত চিকিৎসা-শিক্ষাব্যবস্থায় আসবে – কেউ কেউ নয়, হয়ত অধিকাংশই আসবে, কেননা ছাত্রাবস্থায় তো ডাক্তারিটা শিখল না, অগত্যা – লেখাপড়া শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানগম্যি ছাড়া স্রেফ রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের তেল মেরে সুনজরে থাকার সুবাদে দাপট দেখানোর পক্ষে আপাতত মেডিকেল কলেজগুলোই সেরা জায়গা – তবু…
এই এত বড় ঘটনার পর, এদের কিচ্ছুটি হবে না!!!!
এ-ক-টা অ-ন-ডি-উ-টি ডা-ক্তা-র স-র-কা-রি সে-ট-আ-পে ডি-উ-টি চ-লা-কা-লী-ন ধ-র্ষি-তা ও নি-হ-ত!!!
দেশে তো বটেই, বিশ্বেও এমন ঘটনা প্রায় নজিরবিহীন!!
দলীয় মুখপাত্র কুণাল ঘোষ, যদ্দূর জানি, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় বেশীদূর এগোননি। উনি না-ই জানতে পারেন, কিন্তু তৃণমূল মানেই অশিক্ষিত, এমন তো নয় – অমুক জায়গায় ধর্ষণ-খুন হয়েছিল, তখন তো বলতে আসেননি এজাতীয় কুযুক্তি দিয়ে এই ঘটনা ঢাকা যাবে না, এটুকু বাকিরা বোঝেন না?
দেশের সর্বত্র তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরে ঘটনাটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে – শাসক দল জানেন না? বিলেতফেরত ইংলিশ মিডিয়াম মহুয়া ম্যাডাম এই কথাটা বোঝেন না??
তারপরও…
হ্যাঁ মাননীয়া, সুকুমারমতি ছাত্রছাত্রীদের যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠা-দিবসে গতকাল আপনি নরম-গরম বাণী পরিবেশন করলেন – জেনে রাখুন, এই ঘটনা ঘটতে পেরেছে সেই ছাত্র-সংগঠনের কল্যাণেই।
হ্যাঁ মাননীয়া, এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত হিসেবে যাদের যাদের নাম উঠে আসছে – এবং তোলাবাজি দাদাগিরি ঘুষ নিয়ে নম্বর বাড়ানো প্রশ্নপত্র বিক্রি ইত্যাদি প্রভৃতি – এবং ওষুধের চোরাকারবার থেকে শুরু করে সেক্স র্যাকেট ইত্যাদি – আর স্বাস্থ্য-দফতরের নিয়োগ পদোন্নতি বদলি প্রভৃতি তো আছেই – আপনিও নিশ্চিতভাবে জানেন, সেই নামগুলোর প্রত্যেকে সেই সংগঠনের সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত অথবা তারা সেই সংগঠনেরই উজ্জ্বল ফসল।
তবে মাননীয়া, আপনার একটা কথা বাকিরা ভুল বুঝেছে। ওই ফোঁস করা-র পয়েন্টটা। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, ছোবল না মেরে ফোঁস করতে। আপনিও ঠিক একই কথা বলেছেন। তবে একটু ভিন্ন অর্থে।
আপনিও জানেন, আপনার স্নেহচ্ছায়ার বেড়ে ওঠা কিছু বিষধর বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। একেবারে ছোবল মেরে বসেছে। আপনি তাদের আরেকটু সংযমী হতে বলছিলেন। বলছিলেন, বাছারা, একেবারে সরকারি হাসপাতালে ডিউটিরতা-কে এমন করে ছোবল মারলে পরিস্থিতি সামলানো মুশকিল হয়ে যায় – খুব ‘রাগ হলে’ তোরা বরং ফোঁস করিস, অধিকাংশ ডাক্তার ওই ফোঁস-এর ভয়েই ঠান্ডা! কিন্তু সে কথা, হায়, বাকিরা বুঝলই না!
যাক গে!
গতকাল যা-ই বলুন, মাননীয়া আজ লিখিতভাবে জানালেন, যে, ডাক্তারদের আন্দোলনে তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। ভালো কথা। আন্দোলন, অর্থাৎ কর্মবিরতি। সমর্থন করছেন তো? প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হেলথ সেক্রেটারি থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজগুলোর প্রিন্সিপাল এমএসভিপি-দের জানিয়েছেন এই ‘সমর্থন’-এর কথা?
বাই দ্য ওয়ে, মাননীয়া, আজকের ওই অডিও ক্লিপ-টা শুনলেন?
বাবা-মাকে মেয়ের মৃত্যুর খবর দিচ্ছে আপনার হাসপাতালের কোনও এক বেতনভুক কর্মী। শুনলেন পুরোটা? কেমন লাগল??
খুনটা যে করা হবে – এবং খুনটা যে করা হয়ে গেছে, এরপর পরবর্তী কাজগুলো সারা বাকি – অর্থাৎ ঘটনাক্রম জানা ও প্রত্যাশিত না হলে, এক অন-ডিউটি ডাক্তারের ধর্ষণ খুনের খবর পাওয়ার পর এমন স্বাভাবিক ম্যাটার-অফ-ফ্যাক্ট নিস্পৃহ কণ্ঠে কথা বলা যায়? এমপ্যাথি সহমর্মিতা সহানুভূতি এসব দিকের কথা বাদই দিচ্ছি – আপনার দলে থাকতে হলে ওইসব নিয়ে চলা মুশকিল!
তো শেষমেশ কী ভাবছেন, মাননীয়া?
চেপে দিতে পারবেন?
যে লুম্পেনদের রাস্তায় ছেড়ে রেখে সেই ভরসায় শাসন চালাচ্ছেন, তাদেরই আরও উত্তেজিত করে ক্ষুব্ধ জনতার দিকে লেলিয়ে দেবেন?
নাকি পুলিশ লাগিয়ে সামলানোর চেষ্টা করবেন?
অথবা হাতে তিরিশটা এমপি আছে এই গাজর ঝুলিয়ে সেন্ট্রাল লেভেল থেকে সিবিআই-কে ম্যানেজ করবেন?
তবে এবারে কিন্তু পরিস্থিতি জটিল। অত সহজে সামলানো যাবে বলে মনে হয় না। দেখুন পারেন কিনা?
পোষা গুণ্ডা কিন্তু কুকুর নয়। তাদের আনুগত্য বদলাতে সময় লাগে না। পুলিশের যে অংশটা অপদার্থ, তাদের কথা আলাদা – কিন্তু সৎ বিবেকবান অফিসারদের কথা তো ছেড়েই দিন, এমনকি ধামাধরাদের মধ্যে যারা দক্ষ, তারা-ও আপাতত জল মাপছে। মোদ্দা কথা, এদের দিয়ে জনরোষ ম্যানেজ করা কঠিন। অগত্যা ভরসা বলতে, এক এবং একমাত্র সেটিং। কেন্দ্রের সঙ্গে সেটিং। হবে এযাত্রা?
নাকি…
নাকি আপনার দল আপাতত শরীরের একটা অংশ বাদ দিয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করবে?
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নর্থ বেঙ্গল লবি-র দাপাদাপি বন্ধ করবেন? স্বাস্থ্য-দফতরের সিন্ডিকেট রাজ বন্ধ করে একটা বার্তা দিতে চাইবেন?
কাজটা সহজ নয় অবশ্যই, কেননা একেবারে খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে – শীর্ষ অধিকর্তা থেকে শুরু করে কলেজে কলেজে ছড়িয়ে থাকা ফড়ে-দাদা, ছাঁটতে হবে অনেককেই – কিন্তু উপায় বলতে এই মুহূর্তে এছাড়া আর কী-ই বা আছে?