যে সময়কার কথা, সে সময় ছত্তিশগড় ছিল মধ্যপ্রদেশে। দক্ষিণপূর্বের সাতটা আদিবাসী-প্রধান জেলা—দুর্গ, রাজনাদগাঁও, রায়পুর, বস্তার, বিলাসপুর, রায়গড়, সরগুজা নিয়ে ছত্তিশগড়।
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছত্তিশগড়—লোহা, কয়লা, চুনাপাথর, ডোলোমাইট, কোয়ার্জাইট, তামা, ইউরেনিয়াম, টিন, বক্সাইট, ফেলস্পার, মাঙ্গানিজের খনি ছড়িয়ে আছে। আছে বিশাল কৃষিযোগ্য ভূমি। নদীগুলোতে বছরের প্রায় সব সময়ই জল থাকে, নদী ছাড়াও আছে পাহাড়ী ঝর্না থেকে উৎপন্ন বড় বড় জলাশয়। জঙ্গলে আছে শাল, সেগুন, তেন্দু, মহুয়া, বাঁশ, প্রভৃতি বনজ সম্পদ।
প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ভিত্তি করে ছত্তিশগড়ে গড়ে উঠেছে বড় বড় শিল্পোদ্যোগ—শুরুর দিকে যেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা ছিল পাবলিক সেক্টরে। প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াও ছত্তিশগড়ের শিল্পায়নে বড় ভূমিকা সেখানকার সস্তা শ্রমশক্তির।
রুশী সহায়তায় ১৯৫৮-এ গড়ে ওঠা ভিলাই ইস্পাত কারখানা দুর্গ জেলায়। এ কারখানা লোহা আকর নেয় দুর্গ জেলারই দল্লী-রাজহরা, মহামায়া ও আড়িডুংরি খনি থেকে। কোয়ার্জাইট সরবরাহ করত দুর্গ জেলার দানীটোলা খনি। লাইম স্টোন আর ডোলোমাইট আসে যথাক্রমে দুর্গ জেলার নন্দিনী ও বিলাসপুর জেলার হীর্রী খনি থেকে। এ কারখানাকে জল যোগায় তন্দুলা, গোন্দলী, বইডিহি, খরখরা, গঙ্গরেল, প্রভৃতি জলাশয়, ফলে দুর্গের চাষের জমিতে সেচের জল মেলে না। লোহাপাথর বহন করার জন্য রেললাইন বসানো হয় দল্লী-রাজহরা থেকে ভিলাই অবধি, বিনষ্ট হয়েছে হাজার-হাজার একর কৃষিভূমি আর বনভূমি। কারখানা ও খনিগুলোর বর্জ্যপদার্থে লাগাতার দূষিত হয়ে চলে জল-বাতাস-মাটি। দুর্গ জেলার প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়ে যায়, বছরের পর বছর দুর্গ খরাগ্রস্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষিত হয়ে চলে।
এত কিছু নিয়েছে ভিলাই ছত্তিশগড় থেকে অথচ দেয় নি ফিরিয়ে কিছুই। ভিলাই কারখানার বিশাল কর্মী-বাহিনীর মধ্যে কেবল নীচের স্তরের এক অংশই ছিলেন ছত্তিশগড়ী, যাঁরা খনিতে পাথর ভাঙ্গেন, ট্রাকে পাথর ভরেন। উৎপাদন বাড়ানোর ছুতোয় মেশিনীকরণ করে তাঁদের ছাঁটাই-এর চেষ্টা কেমন করে রুখে দিয়েছিলেন দল্লী-রাজহরার খনি-শ্রমিকরা সে কাহিনীই বলব আজ।
দল্লী-রাজহরাঃ দল্লী আর রাজহরা দুটো পাহাড়ের নাম, লোহাপাথরের পাহাড়। দল্লী পাহাড়ে তিনটে খনি—দল্লী, ময়ূরপানি আর ঝরনদল্লী। রাজহরায় দুটো—রাজহরা আর কোকান। দল্লী-রাজহরা খনিসমূহ বা Dalli Rajhara Group of Mines বলতে অবশ্য এ পাঁচটা ছাড়াও আরও দুটো লোহাখনিকে বোঝায় ১৮ কিলোমিটার দূরের মহামায়া খনি আর ২০ কিলোমিটার দূরের আরিডুংরি খনি। এই খনিগুলোর মালিক ভিলাই ইস্পাত কারখানা।
এই পাঁচটা খনিকে কেন্দ্র করে পঞ্চাশের দশকের শেষে গড়ে উঠেছিল দল্লী-রাজহরা খনি শহর। আমি যে সময় ছত্তিশগড়ে (১৯৮৬-১৯৯৪) সে সময়ে দল্লী-রাজহরার জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার। দল্লী-রাজহরার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতেন ডোন্ডী-লোহারা ব্লকের আরও প্রায় এক লক্ষ মানুষ, যাঁরা কাঠ, সবজি, শস্য, দুধ, প্রভৃতি যোগান দিতেন দল্লী-রাজহরার অধিবাসীদের, তাঁদের যোগানোর জন্য কৃষিকাজ করতেন।
দল্লী-রাজহরার লোহাখনির ঠিকা শ্রমিকদের স্বাধীন ইউনিয়ন বা ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ (সি এম এস এস) গড়ে ওঠে ১৯৭৭-এর ৩রা মার্চ। এই ইউনিয়নের অভিনব আন্দোলনগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মেশিনীকরণ-বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনকে বুঝতে গেলে ম্যানুয়াল খনি ও মেকানাইজড খনির কর্মপদ্ধতি বুঝে নেওয়া দরকার।
ম্যানুয়াল খনির কর্মপদ্ধতিঃ
১। প্রথমে প্রসপেক্টিং অর্থাৎ মাটি বা পাথর খুঁড়ে দেখা কোথায় ভাল আকরিক আছে।
২। এরপর কোয়ালিটি ব্লকিং যাতে খননের উপযুক্ত জায়গা চিহ্নিত করা হয়।
৩। ব্লক প্রিপারেশন অর্থাৎ আকরিকের ওপর মাটি ও পাথরের স্তর সরানো, আসা-যাওয়ার রাস্তা তৈরী করা।
৪। ড্রিলিং অর্থাৎ আকরিকে ছেঁদা করে, যে সবে ডিনামাইট রেখে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
৫। ব্লাস্টিং—ডিনামাইট ফাটিয়ে বড় বড় আকরিকের চাঙ্গড় আলাদা করা হয়।
৬। রেজিং—বড় চাঙ্গড়গুলোকে শাবল আর বড় হাতুড়ি (ঘণ) দিয়ে ভাঙ্গার কাজ পুরুষ রেজিং শ্রমিকদের। ভাঙ্গা টুকরোগুলোকে ছোট হাতুড়ি মেরে আরও ছোট করার কাজ মূলত নারী রেজিং শ্রমিকদের। তারপর ০ থেকে ১০ মিলিমিটার ও ১০ থেকে ৮০ মিলিমিটার এই দুই সাইজে ভাগ করে রাখা।
৭। ট্রান্সপোর্টিং—ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক ঝুড়িতে করে টিপার ট্রাকে আকরিক ভরেন, ড্রাইভার ট্রাক নিয়ে যান গন্তব্যে।
ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে যন্ত্র লাগে—প্রস্পেক্টিং-এর জন্য বোর (অর্থাৎ খোঁড়ার যন্ত্র), ছোট ড্রিলিং মেশিন, শাবল, হাতুড়ি, গাঁইতি, কোদাল, ইত্যাদি।
মেকানাইজড খনির কর্মপদ্ধতিঃ
ব্লক প্রিপারেশন করা হয় বুলডোজার দিয়ে।
সাধারণ ড্রিলিং-এর বদলে হেভি ড্রিলিং।
সাধারণ ব্লাস্টিং-এর বদলে হেভি ব্লাস্টিং।
আকরিকের চাঙ্গড়কে এ ক্ষেত্রে খনিতে ভেঙ্গে ছোট করা হয় না। বড় চাঙ্গড় শভেল দিয়ে ভরা হয় ডাম্পারে। বেশ কয়েকটা টিপার ট্রাকের কাজ করতে পারে একটা ডাম্পার। বড় পাথরের যে ওজন টিপার ট্রাক সহ্য করতে পারে না, তা অনায়াসেই সহ্য করে ডাম্পার।
পাথর ভেঙ্গে ছোট করার কাজ হয় প্ল্যান্টে। জ-ক্রাশার ১০০০ মিলিমিটার অবধি সাইজের পাথরকে ভেঙ্গে ছোট করে। আরও ছোট করার জন্য ব্যবহৃত হয় কোন-ক্রাশার।
তাহলে আমরা দেখছি—মেকানাইজড পদ্ধতিতে রেজিং শ্রমিকের কাজ করে বুলডোজার, শভেল, জ-ক্রাশার, কোন-ক্রাশার। আর ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকের কাজ করে শভেল।
দল্লী-রাজহরা খনিসমূহের রাজহরা খনি প্রথম থেকেই মেকানাইজড ছিল। কোকান, দল্লী, ঝরন-দল্লী, ময়ূরপানি, মহামায়া ও আরিডুংরিতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে খনন চলত। পরে আরিডুংরিকে মেকানাইজড করে দেওয়া হয়, সেখানকার এ আইটিইউসি-নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক-ইউনিয়ন রুখতে পারেনি। এরপর ভিলাই ইস্পাত প্রকল্পের ম্যানেজমেন্টের নজর পড়ে দল্লীর ওপর।
গত শতকের আটের দশকের শেষভাগের হিসেব—সে সময় দল্লী-রাজহরা খনিসমূহের লোহাখনিগুলো আকরিক সঞ্চয় ছিল মোটামুটি এরকম—
- রাজহরা—৩৫ মিলিয়ন টন
- কোকান—৩ মিলিয়ন টন
- দল্লী ও ময়ূরপানি—১৭০ মিলিয়ন টন
- ঝরন-দল্লী—৩৫ মিলিয়ন টন
- মহামায়া—১৫ মিলিয়ন টন
- আরিডুংরি—১৮ মিলিয়ন টন
মেশিনীকরণের জন্য যে পরিমাণ পুঁজি লাগে, সে তুলনায় কোকান বা মহামায়ার আকরিক সঞ্চয়ের পরিমাণ কম হওয়ায় ম্যানেজমেন্ট কখনওই এ দুটোকে পুরোপুরি যন্ত্রীকৃত করার কথা ভাবেনি। অন্যদিকে দল্লী খনিতে আকরিকের সঞ্চয় বিশাল আর দল্লী, ময়ূরপানি ও ঝরন-দল্লী একই পাহাড়ে অবস্থিত—তাই একটা খনি মেকানাইজড হলে পরে বাকী দুটোকে করা সহজ।
ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ তৈরী হওয়ার আগে অর্থাৎ ১৯৭৭-এর আগেই দল্লী খনি মেকানাইজেশনের কাজ শুরু হয়ে যায়। বসানো হয় কোন ক্রাশার, যাতে পাথর ভাঙ্গা হয়। প্ল্যান্ট বসানো হয়—স্ক্রীনিং (ছাঁকাই), সর্টিং (বাছাই) ও ওয়াশিং (ধোলাই), যাতে আকরিকের গুণমান বাড়িয়ে তাকে ইস্পাত কারখানার উপযুক্ত করা যায়।
১৯৭৮ থেকে ইস্পাত প্রকল্পের ম্যানেজমেন্ট বাকী কাজ করার প্রয়াস শুরু করে—খনি অঞ্চলে চলাচলের জন্য চওড়া রাস্তা বানানো যাতে শভেল, ডাম্পার যাতায়াত করতে পারে; হেভি ড্রিলিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আনানো; শভেল ও ডাম্পার কেনা; জ ক্রাশার বসানো।
এই সময় বস্তারের বাইলাডিলা খনিতে এক ঘটনা ঘটে। লোহাখনি মেশিনীকরণের সামনে ছাঁটাই হন কয়েক হাজার শ্রমিক। সেখানকার শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল এ আই টি ইউ সি-র। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিষ্ক্রিয় থাকে, স্থানীয় নেতা মেশিনীকরণের বিরোধিতায় শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের গুলি আর ঠিকাদারদের গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণের সামনে হার মানেন শ্রমিকরা। বাইলাডিলার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেন দল্লী-রাজহরার শ্রমিকরা। শংকর গুহ নিয়োগী লেখেন—‘কিরন্দুল কী অগ্নিগর্ভ সে’ (কিরন্দুলের অগ্নিগর্ভ থেকে)।
আন্দোলন দিয়ে মেশিনীকরণকে আটকানোর পাশাপাশি শ্রমিক ইউনিয়ন তথ্যগত ভাবে মেশিনীকরণের বিরুদ্ধে যুক্তি সাজালো। নীচের সারণিগুলো সে সময়কার প্রচার পত্র থেকে নেওয়া।
সারণি ১
টন প্রতি উৎপাদন খরচ, টাকায় (১৯৭৮-’৭৯)
ম্যানুয়াল খনি মেকানাইজড খনি
রেজিং খরচ ১৮.৫০ ৩৯.৭৫
ট্রান্সপোর্ট খরচ ২২.৪২ ৬৬.৯৯
অন্যান্য খরচ ৫.০৯ ০.৫৭
ট্যাক্স ৪.০০ ৪.০০
মোট ৫০.০১ ১১১.৩১
সূত্রঃ ভারত সরকারের ইস্পাত ও খনি মন্ত্রক
সারণি ২
ড্রিলিং-ব্লাস্টিং-এ খরচের তুলনা, টাকায়
চালু পদ্ধতি প্রস্তাবিত পদ্ধতি
হ্যামার ড্রিলিং ৪.৩০ প্রতি মিটার হেভি ড্রিলিং ১১১.০০ প্রতি মিটার
ব্লাস্টিং ১.৫০ প্রতি টন হেভি ব্লাস্টিং ৩.৭০ প্রতি টন
সূত্রঃ ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের সমীক্ষা
সারণি ৩
শভেল-পিছু বার্ষিক খরচ, টাকায়
বিনিয়োগের দরুন সুদ ৪,৫০,০০০
ডেপ্রিসিয়েশন ৪,৫০,০০০
রিপ্লেসমেন্ট, ডেভেলপমেন্ট ২,০০,০০০
পাওয়ার শভেলের বিদ্যুত-খরচ ১,০৮,০০০
লুব্রিকেশন ২৮,০০০
শভেল-পিছু অফিসার ও শ্রমিকের খরচ ৪,০০,০০০
মোট ১৬,৩৬,০০০
সূত্রঃ ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের সমীক্ষা
ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ হিসেব করে দেখালো—দল্লী-মেকানাইজেশনে পাঁচটা শভেল লাগার কথা, এর জন্য মোট বার্ষিক খরচ ৮১,৮০,০০০ টাকা। এই অর্থে দশ হাজার নতুন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতে পারে, আর এই মেশিনগুলো বসলে কাজ হারাবেন কর্মরত সাড়ে সাত হাজার শ্রমিক।
মেশিনীকরণ এলাকার অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে
মেশিনীকরণ হলে রেজিং ও ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকদের কাজ থাকবে না—তাঁদের পরিবারবর্গ হবে অন্নহীন; খনিশ্রমিকদের রোজগারের ওপর নির্ভরশীল দল্লী-রাজহরার দোকান-বাজার বন্ধ হয়ে যাবে, আশেপাশের যেসব গ্রামের মানুষ বাজারে পণ্য বিক্রি করেন তাঁরা রুজিরুটি হারাবেন; খনিশ্রমিকদের আয়ের একাংশে গ্রামে তাঁদের পরিবারের যে চাষবাস চলত তা বন্ধ হয়ে যাবে; ডাম্পার ট্রাকের জায়গা নেওয়ায় বিশাল সংখ্যক ট্রাকমালিক, ড্রাইভার, হেল্পার, গ্যারেজমালিক, গ্যারেজশ্রমিক বেরোজগার হয়ে যাবেন। এলাকার অর্থনীতি ও জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার এই বাস্তব সম্ভাবনার কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করে ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ তার মেশিনীকরণ-বিরোধী আন্দোলনের সপক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন জোগাড় করতে সক্ষম হয়।
মেশিনীকরণের এই পরিকল্পনা দেশদ্রোহিতার নামান্তর
মেশিনীকরণ হলে একদিকে দেশের বেকারের সংখ্যা বাড়বে, অন্যদিকে আর্থিক ও কারিগরী ক্ষেত্রে পরদেশ-নির্ভরতা বাড়বে—এই বিষয়টাও ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ তার প্রচারে জোরের সঙ্গে বলে।
মেশিনীকরণের জন্য ঋণ দেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, মেশিন ও স্পেয়ার পার্টস কিনতে হবে সে দেশ থেকে, কারিগরী জ্ঞানও আসবে সে দেশ থেকে। দেশের স্বার্থ, জনসাধারণের স্বার্থ, দেশের আত্মনির্ভরশীলতা বিসর্জিত হবে, বিনিময়ে হয়তো কিছু নেতা ও আমলার বিদেশী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ভরবে।
ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ-এর বিকল্প অর্ধ-মেশিনীকরণের প্রস্তাব
যে সময় দল্লী-রাজহরায় মেশিনীকরণ-বিরোধী আন্দোলনের শুরু, তখন কেন্দ্রে জনতা পার্টির সরকার, ইস্পাত মন্ত্রী বিজু পটনায়েক। শংকর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়, তিনি ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ-এর যুক্তিগুলো শোনেন। শুনে তিনি বলেন—কোন ক্রাশার এবং স্ক্রীনিং, সর্টিং ও ওয়াশিং প্ল্যান্ট বসাতে যে ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়ে গেছে তা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। ইউনিয়ন বিকল্প কোনও প্রস্তাব দিক, যাতে শ্রমিকরাও কাজ হারাবেন না আর বিনিয়োগ নষ্ট হবে না।
ইস্পাত মন্ত্রীর এই চ্যালেঞ্জের মুখের জন্ম নিল ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ-এর বিকল্প অর্ধ-মেশিনীকরণের প্রস্তাব।
- হেভি ড্রিলিং, হেভি ব্লাস্টিং, শভেল, ডাম্পার ও জ ক্রাশার, ইত্যাদি মেশিন লাগানোর পরিকল্পনা বাতিল করে চালু পদ্ধতি অর্থাৎ সাধারণ ড্রিলিং, ব্লাস্টিং, রেজিং ও ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক এবং টিপার ট্রাক চালু রাখতে বলা হল। এতে শ্রমিক ছাঁটাই হবে না আর উৎপাদন খরচও কম হবে।
- যেসব মেশিন কেনা হয়ে গেছে সেগুলোকে রাজহরার মেকানাইজড খনি ব্যবহার করতে বলা হল, কেননা সে খনির যন্ত্রপাতির আয়ু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।
- যে কোন ক্রাশার এবং স্ক্রীনিং, সর্টিং ও ওয়াশিং প্ল্যান্ট ইতিমধ্যে বসানো হয়ে গেছে সেগুলোকে চালু করতে বলা হল। কেন না এতে আকরিকের গুণমান বাড়বে। তাছাড়া লোহা পাথরকে খুব ছোট টুকরো করতে হবে না বলে রেজিং শ্রমিকরা বেশী উৎপাদন করতে পারবেন, খুব ছোট টুকরো করার কাজ করবে কোন ক্রাশার।
১৯৭৯-এর ২০শে এপ্রিল ইউনিয়নের সঙ্গে এক চুক্তিতে ভিলাই ইস্পাত কারখানার ম্যানেজমেন্ট দুই বছরের জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে সেমি-মেকানাইজড পদ্ধতিতে দল্লী খনির কাজ চালাতে স্বীকৃত হল। ঠিক হল দুই বছর পর ফলাফল বিচার করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ম্যানেজমেন্ট পূর্ণ মেশিনীকরণের পরিকল্পনা ত্যাগ করেনি
চুক্তি মতো দুই বছর পর কিন্তু ফলাফল বিচার করা হল না। দল্লী খনিতে ১৯৮৯ অবধি সেমি-মেকানাইজড পদ্ধতিতেই কাজ চলে এসেছে। কিন্তু দশ বছরে ম্যানেজমেন্ট বারবার শ্রমিকদের প্রতিরোধ দুর্বল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। ম্যানুয়াল খনির শ্রমিক সংখ্যা কমানো চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে ম্যানুয়াল খনির উৎপাদন কমে এবং উৎপাদন বাড়ানোর অজুহাতে মেশিন লাগানো যায়।
১। অবসর, মৃত্যু, ইত্যাদি কারণে শূন্য শ্রমিকের পদগুলোতে নতুন শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২। দল্লী রেলওয়ে সাইডিং-এ ওয়াগনে আকরিক ভরতেন প্রায় ১০০০ মহিলা শ্রমিক। তাঁদের ডিপার্টমেন্টাল করে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার করা হয়। ওয়াগনে আকরিক ভরার কাজ হতে থাকে ছোট শভেল দিয়ে। এই মহিলা শ্রমিকরা ছিলেন এ আই টি ইউ সি-ভুক্ত এস কে এম এস ইউনিয়নের সদস্যা। এস কে এম এস শভেলের বিরোধিতা করে না। এবার ডিপার্টমেন্টাল হওয়া মহিলাদের অন্য খনিতে ট্রান্সফার করা হয়। তাঁদের বড় অংশেরই স্বামী দল্লী-রাজহরায় কর্মরত। পরিবার বজায় রাখতে তাঁরা স্বেচ্ছা অবসর নিতে থাকেন।
৩। দল্লী-রাজহরার অধিকাংশ শ্রমিকই ছিলেন নিরক্ষর। নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে ৪০ থেকে ৫৮ বছর বয়সী প্রায় ৫০০ শ্রমিককে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়।
৪। কোকান খনির আকরিক ভান্ডার শেষ—এই মিথ্যা অজুহাতে খনি বন্ধ করে ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের সদস্য ১২০০ শ্রমিককে মহামায়ায় পাঠানোর চেষ্টা করা হয়, যাতে ইউনিয়নের শক্তি কমে। লম্বা লড়াই চালিয়ে অবশ্য শ্রমিকরা ১৯৮৭-তে ম্যানেজমেন্টকে খনি খুলতে বাধ্য করেন।
৫। খনির যে সব এলাকায় ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের প্রভাব কম সে সব জায়গায় ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকদের ছাঁটাই বা ডিপার্টমেন্টাল করে ট্রান্সফার করা হতে থাকে, তাদের কাজ করানো হতে থাকে শভেল দিয়ে।
৬। দল্লী ও ঝরনদল্লীতে কিছু ঠিকাদার ও শ্রমিকদের কিছু কো-অপারেটিভ সোসাইটি ঠিকা নিয়ে রেজিং ও ট্রান্সপোর্টিং-এর কাজ চালাত। তাঁদের কন্ট্রাক্টের পুনর্নবীকরণ না করে শ্রমিকদের বেকার বানানোর চেষ্টা করা হয়, শ্রমিকরা অবশ্য এই চেষ্টা ব্যর্থ করেন।
৭। যে সব পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করেন, সেখানে স্বামীকে ডিপার্টমেন্টাল করে অন্য খনিতে ট্রান্সফার করা হয়। স্ত্রীরা স্বেচ্ছা-অবসর নেন। এভাবে প্রায় ৮০০ মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা কমে।
৮। যে সব শ্রমিক বেশী দিন কাজ করেছেন, তাঁদের আকর্ষণীয় অর্থ সহ ভলান্টারী রিটায়ারমেন্টের প্রলোভন দেখানো হয়। ম্যানেজমেন্টের মূল লক্ষ্য ছিল ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ, কিন্তু ইউনিয়ন তার শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় পুরোপুরি অটুট রাখে। চোট পড়ে এ আই টি ইউ সি-র সদস্য-সংখ্যায় যার দালাল নেতারা ম্যানেজমেন্টের এ কাজে মদত দেয়।
ম্যানেজমেন্টের নতুন আক্রমণ
১৯৮৮-র ডিসেম্বর মাসে ভিলাই ইস্পাত কারখানা ভিলাই-এর এক বড় ঠিকাদারকে ১৬ কোটি টাকার ঠিকা দেয় দল্লী মেকানাইজেশন স্টেজ টু-র জন্য। প্রথম পর্যায়ে জ ক্রাশার, স্ক্রীনিং-সর্টিং-ওয়াশিং প্ল্যান্ট বসানোর কথা।
এবার মেশিনীকরণের পেছনে তাদের যুক্তিগুলো ছিল এরকম—
- উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মেশিনীকরণ দরকার। ১৯৯৫ সালে বার্ষিক ৫০ লক্ষ টন ইস্পাত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে গেলে বর্তমান মাত্রায় লোহা আকর উৎপাদন করলে চলবে না।
- ইস্পাত কারখানার নতুন ব্লাস্ট ফার্নেসের জন্য আরও ভালো গুণমানের লোহা আকর চাই, তা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
- মেশিনীকরণ হলে শ্রমিক ছাঁটাই হবে—ইউনিয়নের এই আশংকা অমূলক।
ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের পাল্টা যুক্তি
- দল্লী-রাজহরার উৎপাদন খরচ বেশী নয়, আকরের গুণমানও বেশ ভালো।
খনির নাম কোথায় যায়? প্রতি টনের উৎপাদন খরচ গুণমান (Fe%) শ্রমিক সংখ্যা
দল্লী-রাজহরা ভিলাই স্টীল প্ল্যান্ট ১০৪ টাকা ৬৩.৮ থেকে ৬৫.৭৬ ১২,০০০
বরসুয়া রাউরকেল্লা, দুর্গাপুর, বোকারো ৯৮ টাকা ৬০.৯ থেকে ৬২.৫ ১,৯০০
বোলানি দুর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্ট ১০৩ টাকা ৬১.৪২ থেকে ৬২.৫৭ ১,৭০০
কিরিবুরু বোকারো স্টীল প্ল্যান্ট ৯৩ টাকা ৬২.৮৩ থেকে ৬৩.৬২ ১,৬৫০
মেগাতিবুরু বোকারো স্টীল প্ল্যান্ট ১১৭ টাকা ৬১.৩৩ থেকে ৬২.৩৭ ২,০০০
গুয়া দুর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্ট ৯০ টাকা ৬০.৩৬ থেকে ৬০.৪৪ তথ্য নেই
বাইলাডিলা জাপান ১২৫ টাকা আকরে এলুমিনা বেশি ৩,৪০০
সূত্রঃ স্টীল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, ১৯৮৭-‘৮৮
দল্লী-রাজহরা খনিসমূহের ম্যানুয়াল খনির উৎপাদন খরচ ভারতে সবচেয়ে কম।
খনির নাম কোন ইস্পাত কারখানায় যায়? টন প্রতি উৎপাদন খরচ
মনোহরপুর IISCO ১২৮.২৭ টাকা
বোলানি দুর্গাপুর ১৪৮.৬৬ টাকা
কালতা রাউরকেল্লা ১৩২.৯৭ টাকা
ঝরনদল্লী ভিলাই ৮৯.২৩ টাকা
সূত্রঃ স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (’৮৭-৮৮)
১৯৯৫ সালে ৫০ লক্ষ টনের লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই মাত্র ৫৪০ জন শ্রমিক
দল্লী-রাজহরায় যে গুণমানের লোহা আকর পাওয়া যায় তার ১.৬ টন থেকে ১ টন ইস্পাত তৈরী হয়।
অর্থাৎ ৫০ লক্ষ টন ইস্পাতের জন্য চাই ৫০X ১.৬ = ৮০ লক্ষ টন আকর।
১৯৮৯-এ দল্লী-রাজহরার খনিসমূহের বার্ষিক লোহা আকর উৎপাদন ছিল এরকম
রাজহরা মেকানাইজড খনি ২৮ লক্ষ টন
দল্লী ও ময়ূরপানি ২৮ লক্ষ টন
ঝরনদল্লী ৬ লক্ষ টন
মহামায়া, আড়িডুংরি ও কোকান ১০ লক্ষ টন
মোট ৭২ লক্ষ টন
অর্থাৎ চাই আর ৮ লক্ষ টন আকর।
ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ হিসেব করে দেখিয়ে দেয় আর মাত্র ৫৪০ জন শ্রমিককে নিয়োগ করলেই ৮ লক্ষ টন অতিরিক্ত উৎপাদন করা যাবে।
- ইউনিয়ন হিসেব করে দেখায় জ ক্রাশার বসলে রেজিং শ্রমিকের কাজ থাকবে না। জ ক্রাশারের উপযোগী মাল সাধারণ ট্রাকে বহন করা যায় না, তাই ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকও কর্মচ্যুত হবেন। মোট উদ্বৃত্ত হবেন ১০,০০০ শ্রমিক, এঁদের মধ্যে ৭৫০০ ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ-এর সদস্য, বাকীরা আই এন টি ইউ সি ও এ আই টি ইউ সি-র।
- ইউনিয়ন হিসেব করে দেখায় মেশিনীকরণ পুরো হয়ে গেলে দল্লী-রাজহরার ১ লক্ষ ২০ হাজার-এর বসতি উজাড় হয়ে গিয়ে থাকবেন মাত্র ২০ হাজার মানুষ।
ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ দাবী জানায় মেশিন যদি লাগাতেই হয়, তাহলে আগে এই ১০০০০ শ্রমিকের কাজের নিরাপত্তা চাই—
- ঠিকাদারী ও কো-অপারেটিভ সোসাইটি-ভুক্ত শ্রমিকদের সম্মানের সঙ্গে বিভাগীয়করণ করা হোক—যাতে তাঁরা বিভাগীয়করণের পরও জরুরী উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, ম্যানেজমেন্ট যাতে ইচ্ছেমতো তাঁদের ছেঁটে ফেলতে না পারে।
- অবিলম্বে গ্র্যাচুইটি দিতে হবে।
- যতদিন না বিভাগীয়করণ হচ্ছে, ততদিন এঁদের ক্যাজুয়াল লীভ ও ফেস্টিভ্যাল লীভ দিতে হবে।
১৯৮৯-এ কেমন করে শ্রমিকরা লড়াই করেছিলেন?
খনিতে মেশিন বসানোর ঠিকা পেয়েছিল ভিলাই-এর বি কে কোম্পানী, প্রথমে তারা মাটি খোঁড়ার জন্য ৯৭ জন ঠিকা শ্রমিককে কাজে লাগায়। জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে দল্লী মাইন্সে তারা মেশিন নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সি এম এস এস-এর শ্রমিকরা দিনের পর দিন মেশিনের পথ অবরোধ চালিয়ে যান।
ফেব্রুয়ারীতে মেশিন লাগানোর বিরোধিতায় নাগরিক সভা অনুষ্ঠিত হয় বিধায়ক জনকলাল ঠাকুরের আহ্বানে।
দল্লী খনিতে ক্রাশিং প্ল্যান্ট কবে বসবে তা অনিশ্চিত, তাই ভিলাই স্টীল প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ এইচ এস সি এল-কে ঠিকা দেয় চারটে ছোট ক্রাশার চালানোর। সি এম এস এস-সদস্যদের মনোবল ভাঙ্গার জন্য প্রথম ক্রাশারটার সাব-কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয় এ আই টি ইউ সি-ভুক্ত এক ভুয়ো সমবায় সমিতিকে। চাকরী দেওয়ার নাম করে এ আই টি ইউ সি-নেতারা গ্রামীণ বেকার যুবকদের কাছ টাকা তুলতে থাকে। দ্বিতীয় ক্রাশারটার ঠিকা দেওয়া হয় এক স্থানীয় ঠিকাদারকে, সেটাতেও এ আই টি ইউ সি-র মাধ্যমে শ্রমিক নেওয়া হয়।
ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার ‘নও জওয়ান সংগঠন’ আন্দোলন করে তৃতীয় ক্রাশারটার ঠিকা ছিনিয়ে নেয়, সেখানে ১২০ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। অন্যদিকে দ্বিতীয় ক্রাশারের শ্রমিকরা কিছুদিনের মধ্যে ন্যূনতম মজুরী ও ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে এ আই টি ইউ সি ছেড়ে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সংগঠনে এসে আন্দোলন শুরু করেন। বেগতিক দেখে এইচ এস সি এল আর চতুর্থ ক্রাশার চালু করে না। হতাশ হয়ে এ আই টি ইউ সি হিংসার আমদানী করে, সি এম এস এস সদস্যরা আক্রান্ত হতে থাকেন।
বি কে কোম্পানী প্রারম্ভিক কাজের জন্য যে ৯৭ জনকে নিযুক্ত করেছিল, তাঁদের দৈনিক মজুরী দিত ৮ টাকা। ন্যূনতম ১৭ টাকা ১৮ পয়সা দৈনিক মজুরীর দাবীতে তাঁরা হরতাল শুরু করেন। শুরুতে সি এম এস এস-এর সদস্যরা মেশিনের পথ অবরোধ করছিলেন, এবার মেশিনবাহী গাড়ীর পথ আটকাতে শুরু করেন এই ৯৭ জন।
বিপাকে পড়ে বি কে কোম্পানী সি এম এস এস ও শংকর গুহ নিয়োগীর বিরুদ্ধে মামলা করে যাতে তাঁরা গাড়ী রুখতে না পারেন।
মার্চের মাঝামাঝি এইচ এস সি এল-এর ক্রাশার তিনটে বন্ধ করে দেওয়া হয়, যেখানে তখন সি এম এস এস সদস্যদের সংখ্যাধিক্য।
এ আই টি ইউ সি মিছিল নিয়ে সি এম এস এস সদস্যদের বস্তিগুলোতে ঢুকে গালিগালাজ করে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে যাতে তাঁরা মারামারি শুরু করেন—শান্তিরক্ষার নামে ১৪৪ ধারা জারী করা যায়—মেশিনীকরণ-বিরোধী আন্দোলনও যাতে সহজে দমন করা যায়। সি এম এস এস সদস্যরা শান্ত থেকে তাদের চাল বানচাল করে দেন।
এবার খনি-কর্তৃপক্ষ সি এম এস এস-ভুক্ত এক সমবায় সমিতিকে কাজের এলাকা ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেয়, এলাকায় শভেল দিয়ে উৎখনন হবে, সি এম এস এস হরতাল করে।
বি কে কোম্পানীর মামলায় দুর্গ সিভিল কোর্ট রায় দেয় নিয়োগী-সহ তিন সি এম এস এস নেতা গাড়ীর পথ অবরোধ করতে পারবেন না। কোর্টের আদেশের তোয়াক্কা না করে শ্রমিকরা অবরোধ চালিয়ে যান।
১লা এপ্রিল থেকে সি এম এস এস স্লো ডাউন শুরু করে, ভিলাই কারখানা চালু রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ বাইলাডিলা থেকে টনপ্রতি ৪০০ টাকা দামে লোহা আকর আনতে বাধ্য হতে থাকে।
৬ই এপ্রিল মেশিনীকরণের বিরুদ্ধে দল্লী-রাজহরায় সর্বাত্মক হরতাল হয়। অন্যদিকে এ আই টি ইউ সি-র জনসমর্থন কমতে থাকে।
মে মাসের শুরু থেকে সন্ত্রাস শুরু করে এ আই টি ইউ সি—ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার বিধায়কের জীপে আক্রমণ, সি এম এস এস সদস্যদের মারধোর। পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে সি এম এস এস—কোনও সাধারণ শ্রমিককে নয়, বেছে বেছে এ আই টি ইউ সি-র নেতাদের ওপর মার পড়ে, তাদের সন্ত্রাস বন্ধ হয়ে যায়।
৬ই মে কোর্ট প্রশাসনকে আদেশ দেয় যে কোনও ভাবে বি কে কোম্পানীর শ্রমিকদের কাজের জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। সময়টা বোঝা দরকার—১৯৮৯ বিধানসভা নির্বাচনের বছর, দুর্গ মধ্যপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোতিলাল ভোরার গৃহ-জেলা। প্রশাসন জানত গুলি না চালিয়ে সি এম এস এস-এর অবরোধ ভাঙ্গা যাবে না আর তেমনটা ঐ সময় বাঞ্ছনীয় নয়।
পুলিশ-প্রশাসন সি এম এস এস নেতাদের কাছে প্রার্থনা করে—কোর্টের সম্মানরক্ষার্থে একবার এ আই টি ইউ সি সদস্যদের কাজের জায়গায় পৌঁছে দিতে দেওয়া হোক। এ আই টি ইউ সি-র ৮০০ জনের মধ্যে ১৭০ জন সাহস করে ৩৫০ আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানের পাহারায় কাজের জায়গায় যান। কোর্টের আদেশে ছিল কেবল তাদের কাজের জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার সময় নিরাপত্তা দেওয়া, পৌঁছিয়ে আধাসামরিক বাহিনী ফিরে আসে। ১৭০ জন শ্রমিক কাজের জায়গায় আটকা পড়েন।
১লা এপ্রিল থেকে ১লা মে সি এম এস এস স্লো ডাউন চালায়, ২রা মে থেকে হরতাল—রোজ ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের ৪০ লক্ষ টাকা করে লোকসান হতে থাকে। কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রকের টনক নড়ে। ইস্পাত মন্ত্রী মাখনলাল ফোতেদারের সঙ্গে নিয়োগীর আলোচনা হয়। তিনি বলেন মেশিনীকরণ রদ করার ক্ষমতা তাঁর নেই, কেন না এটা জাতীয় শিল্পনীতির অংশ। বিভাগীয়করণের দাবীকে যুক্তিযুক্ত বলে মেনে নিয়ে তিনি বলেন—মন্ত্রকের স্তর থেকে দল্লী-রাজহরার ১০ হাজার ঠিকা শ্রমিককে বিভাগীয় করলে সারা ভারতে খনিতে কর্মরত আরও প্রায় এক লাখ ঠিকা শ্রমিককে বিভাগীয় করার দায়িত্ব পড়বে মন্ত্রকের ওপর। তাই সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের স্তরেই নিতে হবে।
২রা মে থেকে হরতাল চলে। ২৪শে মে শ্রমিকরা কাজে ফিরলেন বটে কিন্তু চাপ বজায় রাখতে স্লো ডাউন জারী রইল।
এ আই টি ইউ সি আবার সন্ত্রাসের পথে গেলে সি এম এস এস-এর প্রতিরোধে যোগ দিলেন এলাকার ব্যবসায়ী ও অন্য শ্রেণীর মানুষজন।
জুন মাসে প্রথমে বিধায়ক জনকলাল ঠাকুরের ১৯ দিন অনশন, তারপর ১২ দিন অনশন চালান কমরেড শংকর গুহ নিয়োগী। অন্যদিকে শ্রমিকদের অবরোধ আন্দোলন চলতে থাকে।
অবশেষে ১২-১৩ আগস্ট সি এম এস এস ও ভিলাই স্টীল প্ল্যান্ট ম্যানেজমেন্টের মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হল—
১। ঠিকাদারী ও সমবায় সমিতি-ভুক্ত প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক গ্র্যাচুইটি পাওয়ার অধিকারী হলেন। ১৯৭২-এর গ্র্যাচুইটি আইন প্রণীত হওয়ার পর এই প্রথম ঠিকাদারী শ্রমিক গ্র্যাচুইটি পেলেন।
২। বছরে ৭ দিন ক্যাজুয়াল লীভ ও ৫ দিন ফেস্টিভাল লীভ পাওয়া গেল।
৩। ঠিক হল কোন্ডেকসা ‘বি’-তে কেবল আকর স্তরের ওপরের মাটি ও অপ্রয়োজনীয় পাথরের স্তরই শভেল ও বুলডোজার দিয়ে সরানো যাবে। মাইনিং কি পদ্ধতিতে হবে তা খনি কর্তৃপক্ষ সি এম এস এস-এর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবেন।
৪। যতদিন বর্তমান প্রজন্মের শ্রমিকরা আছেন ততদিন কোন্ডেকসা ‘এ’, ময়ূরপানি ও ঝরনদল্লীতে মেশিনীকরণ হবে না।
৫। বিভাগীয়করণের কাজ শুরু করা হবে।
আবারও মেশিনীকরণ রুখে গেল শ্রমিকদের আন্দোলনের সামনে।
নিয়োগী-হত্যা ও মেশিনীকরণ
১৯৯১-এর ২৮শে সেপ্টেম্বর ভিলাইয়ের শিল্পপতিদের নিযুক্ত ঘাতকদের গুলিতে শহীদ হন কমরেড নিয়োগী। ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার নেতৃত্বে মতাদর্শগত সংগ্রাম চলতে থাকে—শ্রেণীসংগ্রাম বনাম শ্রেণীসমঝোতা।
সি এম এস এস-এর নেতৃত্ব দখল করেন সমঝোতাপন্থীরা। তাঁদের মধ্যে বন্ধু খুঁজে পায় ভিলাই ইস্পাত কারখানার ম্যানেজমেন্ট। ১৯৯৪-এর মাঝামাঝি সি এম এস এস নেতৃত্ব শ্রমিকদের বিভাগীয়করণের পরিবর্তে মেশিনীকরণ করার জন্য খনি ছেড়ে দেওয়ার চুক্তি করে।
এই চুক্তি ছিল ইংরাজীতে। শহীদ হাসপাতালের চিকিৎসকরা এই চুক্তি হিন্দীতে অনুবাদ করে সাধারণ শ্রমিকদের পড়াতে থাকেন। তাঁরা দেখান—বেশী বয়সের শ্রমিকরা বিভাগীয়করণের আওতায় আসবেন না, কিভাবে বিভাগীয়করণের আগে শ্রমিকদের মেডিকাল পরীক্ষার নামে অযোগ্য ঘোষণা করে বাদ দেওয়া হবে…। চিকিৎসকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমাকে প্রথমে সংগঠন থেকে সাসপেন্ড ও পরে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন আরও দুই চিকিৎসক। কিন্তু আমরা চুক্তি কার্যকর হওয়া আটকাতে পারিনি।
দল্লী-রাজহরাঃ এখন
১৯৯৪-এ দল্লী-রাজহরা ছেড়ে ছিলাম, আবার যাই ১৩ বছর পরে ২০০৭-এ, তারপর ২০১৬-এ। এক লক্ষ কুড়ি হাজার মানুষের আবাদীতে লোক-সংখ্যা তখন মোটামুটি ৪০ হাজার। শহরে সাইকেল রিকশ চলে না—ভিলাই ইস্পাত কারখানার যে রেগুলার ও ডিপার্টমেন্টাল শ্রমিকরা এখন শহরে থাকেন তাঁদের স্কুটার-মোটরসাইকেল-গাড়ী আছে, রিকশ লাগে না। অনেক দোকান চিরতরে তালা-বন্ধ, সিনেমাহল বন্ধ হয়ে গেছে—দরজায় ঘাস গজিয়েছে…।
বিভাগীয়করণের আওতায় আসেন নি বয়স্ক শ্রমিকরা, তাঁদের স্বেচ্ছাঅবসর নিতে প্ররোচিত করা হয়। মেডিকাল টেস্টে আনফিট হন অনেকে। যাঁরা ফিট হন, তাঁদের বিভাগীয়কৃত করে অন্য খনিতে ট্রান্সফার করা হয়। স্বামী-স্ত্রী আলাদা জায়গায় কাজ পেলে স্ত্রী কাজ ছাড়তে বাধ্য হন…। মেশিনীকরণের চুক্তিতে সাক্ষর করে ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘকেই বিনাশের দিকে ঠেলে দেন নিয়োগী-পরবর্তী ইউনিয়ন নেতারা।
১৬ বছর লড়াই চালিয়ে মেশিনকে রুখে রেখেছিলেন, শ্রমিকদের ছাঁটাই আটকেছিলেন দল্লী-রাজহরার ঠিকাদারী লোহাখনি-শ্রমিকরা। তাঁদের আন্দোলনের ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকগুলো অন্য শ্রমিকদের শিক্ষিত করবে—এমনটাই ধারণা আমার।