ইদানীং কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আমি যা লিখি তা মহৎ কিছু নয়। আমি লিখি রোজনামচা। যা দেখি তাই লিখি। কল্প জগতে পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
আমি লেখক নই। যা লিখি সেটা শিল্প নয়। শিল্প সৃষ্টির মধ্যে অনিশ্চয়তা থাকে। সত্যিকারের শিল্পী নিজেও শিল্প সৃষ্টির সময় জানেননা তিনি কোথায় গিয়ে পৌঁছবেন। তিনি একটা ঘোরের মধ্যে লিখে যান, ছবি এঁকে যান। ব্যাপারটা অনেকটা মা হওয়ার মতো। মাতৃ গর্ভে সন্তান বেড়ে উঠছে, কেউ জানে না সন্তানটি ছেলে না মেয়ে? দেখতে কেমন হবে? সুস্থ ভাবে জন্মাবে? পুরোটাই চরম অনিশ্চয়তা, তবুও অপূর্ব আনন্দ। নতুন সৃষ্টির আনন্দ।
আমার লেখায় নতুন সৃষ্টির আনন্দ নেই। আমি টুকলি করে লিখি। আমার একঘেঁয়ে খুপরি জীবনে যা দুয়েকটা বৈচিত্র্যময় ঘটনা ঘটে সেগুলো থেকেই টুকি। লেখার সময় মোটেই ঘোরের মধ্যে থাকি না। এই যেমন লিখছি, বড় মেয়ে সানাই পাশে বসে অঙ্ক করছে আর ক্রমাগত ঘ্যান ঘ্যান করছে। ছোটো মেয়ে রানী বেসুরে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে।
টুকলি করার সুবিধা হচ্ছে বার বার মনঃসংযোগ বিঘ্ন হলেও সমস্যা নেই। তাই আমারও বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। তাছাড়া মেজাজটা আজ ভালো রয়েছে। এই ডিসেম্বর মাসে সারাদিনের বিদঘুটে বৃষ্টির ফলে আজ রোগী বেশ কম হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছি।
অন্যদিন খুপরিতে রোগীর ভিড়ে নাকানি চোবানি খাই। ইচ্ছা থাকলেও তাঁদের সাথে দুচার কথার বেশি বলা সম্ভব হয় না। আজ রোগীর ভিড় একেবারেই ছিল না। একটু সময় নিয়ে তাঁদের কথা শোনা সম্ভব হয়েছে। রোগীরাও খুশি, ডাক্তারও খুশি।
তবে খুপরি জীবী ডাক্তারের জীবনে নিরবচ্ছিন্ন খুশি বলে কিছু নেই। বাড়িতে বেশ শান্তিতে রোগী দেখছিলাম। দুপুর একটা দেড়টা হবে, হঠাৎ বাইরে বিশাল শোরগোল। “ডাক্তারবাবু, শিগগিরি দেখুন, দাঁতে দাঁত লেগে গেছে।”
একটা টোটোয় একজন নয়; দুজন রোগী। একজন বয়স্ক মহিলা, তিনি বুক চাপড়ে হাহাকার করছেন। আর একজন কমবয়সী মহিলা অজ্ঞান হয়ে গেছেন, তার শরীরটা টোটোর মেঝেয়, আর মাথাটা সিটের উপরে।
আমি বয়স্ক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম “কি হয়েছে?”
উনি বললেন, “আমার কিছু হয়নি ডাক্তারবাবু, আপনি আমার ছেলেকে দেখুন, ওকে বাঁচান। এই যে ওর সব কাগজপত্র।” উনি আমার হাতে একগাদা রিপোর্ট ধরিয়ে দিলেন।
পেছনে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে বললেন, “গতকাল আমাদের একমাত্র সন্তান মারা গেছে। তারপর থেকে এরা দুজন এমন করছে। ঐ যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ওটা আমার বৌমা। বুঝে উঠতে পারছি না আমি কী করব। নাতিটাকে নিয়ে আরও মুশকিলে পড়েছি।”
এতক্ষণে খেয়াল করলাম টোটোর মধ্যে জড়সড় হয়ে একটি বছর চার-পাঁচের বাচ্চা বসে আছে। ফুটফুটে চেহারা। আহারে এটুকু একটা ছেলে পিতৃহীন হলো। জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হয়েছিলো?”
“হার্ট এটাক। আপনার এখানেই এনেছিলাম চারদিন আগে। আপনি ইসিজি করে বলেছিলেন হার্ট এটাক হয়েছে। এখুনি ভর্তি করতে হবে। সাথে সাথে অমুক নার্সিং হোমে নিয়ে গেছিলাম। এতো নামকরা নার্সিং হোম, কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচাতে পারলাম না।”
মনে পড়ে গেছে ছেলেটির কথা। আহারে, কতো আর বয়স হবে, ত্রিশ- বত্রিশ। ছেলেকে এ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় ভদ্রলোক আমার হাত ধরে বার বার বলছিলেন, ছেলে ভালো হয়ে যাবে তো ডাক্তারবাবু?” আমি বলেছিলাম “নিশ্চয়ই হবে।”
তবুও এই দুঃখের পরিস্থিতিতেও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ভাগ্যিস ‘এ এম আই’টা বুঝতে পেরেছিলাম। না হলে অমুক নার্সিংহোমের বদলে আমার বিরুদ্ধেই উনি অভিযোগ করতেন। খুপরিজীবী চিকিৎসকেরা সবসময় একটা সরু সুতোর উপর দিয়ে হাঁটেন।
তবে এখন এই দুই মহিলাকে সামলানোই মুশকিল। দুজনকে ধরে ধরে খুপরিতে ঢোকানো হলো। বয়স্ক মহিলা আক্ষরিক অর্থেই পাগলামি করছেন। প্রেশারও মাপতে দিচ্ছেন না। বলছেন, “আমার প্রেশার মাপছেন কেন? আমার ছেলেরটা মাপুন। ওকে সুস্থ করে দিন ডাক্তারবাবু।”
বৌমাকে এক্সামিনেশন টেবিলের উপর শোয়ানো হয়েছে। ওনার জ্ঞান আপাতত ফিরেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছেন। একেবারে নারকীয় পরিস্থিতি। বাচ্চা ছেলেটি অবাক হয়ে মা আর ঠাকুমাকে দেখছে। একটা ছোটো কাগজে দুটো ইনজেকশন লিখে গৌরকেই দোকানে পাঠালাম। এই দুজনকে একটু শান্ত করার দরকার। সকাল থেকে খুপরিতে যে শান্তির পরিবেশ বিরাজ করছিল, তা ততক্ষণে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যান্য রোগী আর রোগীর বাড়ির লোকেরাও ভিড় করছে। সকলে সান্ত্বনা দিতে চাইছে। কিন্তু সদ্য সন্তান হারা মা অথবা স্বামী হারা স্ত্রীকে কী আদৌ সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব।
ভাবছিলাম, “ঈশ… যদি এই হতভাগা খুপরিজীবী ডাক্তার না হয়ে অন্য কিছু হতাম, তাহলে রোজ রোজ এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।” পরিস্থিতি মোটামুটি হাতের বাইরে। এমন সময় ছোট্ট ছেলেটি আমাকে বলল, “কাকু তোমাকে একটা কথা বলবো?”
“বলো।”
“তোমার না প্যান্টের চেন খোলা।”
ছেলেটির মা আর ঠাকুমা দুজনেই কান্না থামিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটির মা বললেন, “ছি ছি… রাজা, বড়োদের সাথে এমন ভাবে কথা বলতে নেই।”
“প্যান্টের চেন খোলা থাকলেও বলবো না?”
“না, বলবে না। ডাক্তারবাবু আপনি কিছু মনে করবেন না।”
“না না… ইয়ে আমি কিছু… মানে আপনার ছেলে বেশ স্মার্ট।”
“স্মার্ট না, একেবারে রাম বিচ্ছু।”
“না না, বিচ্ছু কোথায়… কী বুদ্ধিমান ছেলে…” বলতে বলতে বুঝতে পারছিলাম পরিস্থিতি আস্তে আস্তে আয়ত্তে আসছে। ওনাদের অবসাদ কমানোর মূল ওষুধটা বুঝতে পেরেছি। এই পাঁচ বছরের পুঁচকে ছেলেটাই ওই দুই মহিলাকে অবসাদে ডুবে যেতে দেবে না।