‘যে বেশি পড়াশোনা না ডাক্তারী করে তার ডাক্তারী করাটা যেন এক অনন্ত সমুদ্রে দিশাহীন ভাবে ভেসে থাকা। আর যে রোগী না দেখে শুধুই পড়াশোনা করে সে কোনওদিন সেই জ্ঞান সমুদ্র দেখলো না।’
উইলিয়াম ওসলার (১৮৪৯-১৯১৯) একবার এইরকমই উক্তি করেছিলেন।
‘রোগী’ শব্দটা আমরা বারবার ব্যবহার করি আর অনেক সময় বেশ হালকাভাবেই বলে থাকি। ছেলে তার বৃদ্ধ বাবাকে, স্বামী তার দুদিনের জ্বরে ভোগা স্ত্রীকে, মা তার কোলের শিশুকে নিয়ে এসে বলে ‘আপনার পেশেন্ট’। তখন তার বাড়ির লোকের থেকে চিকিৎসকই হয়ে ওঠে বেশি আপনজন। তারা রোগ সারায় না, রুগীকে সারায়।
আমাদের পেশেন্টরাই নিজেদের জীবন আমাদের কাছে মেলে ধরে আমাদের প্রকৃত শিক্ষক হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। কারণ রোগী ছাড়া আমরা একজন দক্ষ টেকনিশিয়ান মাত্র। রোগী সামনে থাকলেই আমরা ডাক্তার হয়ে উঠি। তাঁদের কপালে হাত দিয়ে আমরা শুধু জ্বর দেখি না, আশ্বাসও দিই পাশে আছি। তাঁদের সাথে কথা বলে আমরা শুধু রোগের বিবরণ জানি না, ভরসা দিই সাথে আছি। আমরা বর্ণ, ধর্ম, ধনী, দরিদ্র কিছুই দেখি না, যারা আমাদের কাছে এসেছেন তাদের সুস্থ করাই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
কিন্তু আজ এক অদৃশ্য দেওয়াল আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেছে,এক অবিশ্বাসের কুয়াশা আমাদের ঢেকে ফেলেছে। মুদ্রার এ পিঠ ভাবছে সব দোষ অন্য পিঠের।
একবার উঁকি মারুন আমাদের জীবনে। বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে আসে মধ্যবিত্ত ঘর থেকে। এরা কেউ খুব বড়লোক হবে বলে এই পেশায় আসেনি। ঠিক যেমন আপনার বাড়ির বা পাশের বাড়ির ছেলেটা ভাবে। ডাক্তারি পড়ার সময়ে দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা বা তার বেশি সময়েও পড়তে হয়। জীবনের সেরা সময়টা কেটে যায় বই আর পরীক্ষা নিয়ে। তারপর পাশ করে হাসপাতালে চলে হাড়ভাঙ্গা খাটনি। অজানা অচেনা রোগীর পরিষেবা দেওয়ার জন্য বহু রাত না ঘুমিয়ে কাটানো, কোনও রোগী মারা গেলে আত্মীয়বিয়োগের মতো কষ্ট পাওয়া, আবার যখন কোনও রোগী সংকটজনক অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন আনন্দের সীমা থাকে না। এই জায়গায় পৌঁছতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছু হারিয়ে যায়। তবুও এরা নিজের শরীর, মন সব দিয়ে পেশাকে আপন করে নেয়।
কোনো ইন্টার্নকে কখনও দেখেছেন রক্ত নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে ছুটতে? কোনো ফিজিশিয়ান রোগীকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন কিংবা কোনো এক সার্জেন সবে ধরতে পেরেছেন কোথা থেকে রোগীর রক্তপাত হচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে তা সারাতে লেগে গেছেন, একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মায়ের গর্ভে খারাপভাবে জড়িয়ে যাওয়া শিশুকে সাবধানে নিজের দক্ষতায় সুস্থভাবে বাইরে বের করে আনছেন, একজন অ্যানাস্থেশিওলজিস্ট অপারেশনের সময় ক্রিটিক্যাল রোগীকে বাঁচিয়ে রাখবেন তার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখেন কিংবা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাঁর আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীর জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছেন। এঁদেরই একজন কেউ সারারাত জেগে থাকেন রোগীর প্রস্রাব ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তার খেয়াল রাখার জন্য, কোনও বাবা তাঁর মেয়ের প্রথম জন্মদিনের কেক কাটার সেলিব্রেশন মিস করেন কোন অজানা অচেনা রোগীর প্রাণ বাঁচানোর জন্যে। এরকম অনেক কিছু তাঁরা হারিয়ে ফেলেন, যা কখনও টাকা দিয়েও ফিরিয়ে আনা যায় না। যদিও এখানে নেই কোনও প্রমোশনের হাতছানি, নেই সেরা কর্মচারির পুরষ্কার, ব্যাজ বা স্টার মার্কস। সরকারি হাসপাতালে এমন অনেক ডাক্তার আছেন, ডাক্তারের অভাবে তাঁদের প্রায় রোজই অন কল থাকতে হয় আবার আউট ডোরে ৩০০ দেখতে হয়। প্রথমদিকে হয়তো অপেক্ষা করেন কোনও কাজে সফল হওয়ার পর কারও মুখে ‘গুড জব’ শব্দটা শোনার। বরং যা শোনা যায় তা হল, এ তো ডাক্তার নয় কসাই, আমার রোগীকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল।
যাই হোক এ পেশা অন্য যে কোনো পেশার মতো, ভালো আছে মন্দ আছে। ঠিক আপনি যেমন দোষে গুনে মেশানো মানুষ। শুধু যারা আমাদের ৩৬৫ দিন এপ্রিল ফুল করে তাদের থেকে জেনে নিন দেশের স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের কতো শতাংশ বরাদ্দ? ঢাল তরোয়াল না দিলে নিধিরামরা কীভাবে যুদ্ধ করবে?