কর্মাটাঁড়ে ঈশ্বর
[তথ্যসূত্র-করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (ইন্দ্রমিত্র); বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস (শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন); বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ (বিনয় ঘোষ); পরবর্তীতে ঋণের সংখ্যা বাড়তে পারে]
বিস্তীর্ণ মালভূমি অঞ্চল। লালমাটির রুক্ষ ভূমি। উঁচু নীচু ঢেউখেলানো। মাঝে মাঝে কিছু চষাজমি। আলপথ দিয়ে খেঁটো ধুতি আর উড়নি গায়ে ঘর্মাক্ত এক খর্বাকৃতি ব্রাহ্মণ আসছেন। হাতে একটা বাটির মতো কিছু। মেথরপট্টি থেকে দেড় মাইল পথ হেঁটে ঘর্মাক্ত ঈশ্বর আসছে্ন। সেখানে এক মেথরানির কলেরা হয়েছিলো। ঈশ্বর তার শুশ্রূষা করে’ তাঁর তিন কামরার ‘নন্দনকাননে’ ফিরছেন। এক ইংরাজ রমণীর স্বামীবিয়োগ হওয়ার পর তিনি পাঁচ শত টাকায় আমবাগান সহ চৌদ্দ বিঘা জমি ও একটা ছোট বাড়ি আমার ঈশ্বরকে বিক্রয় করে’ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন (আনুমানিক ১৮৭৩)। ঈশ্বর গৃহের তিনটি কক্ষ সম্পূর্ণ করেন- একটি বৃহদাকার কক্ষ:- পাঠাগার ও বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র-একই সঙ্গে রাতের পাঠশালা এবং অন্য দুটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের নিমিত্তে। যদিও ঈশ্বরের কোনোকিছুই ব্যক্তিগত হয় না-কোনদিন হয় নি। ঈশ্বর সবাইকার। সে কথা পরে সময়ে জানানো যাবে।
উড়নি দিয়ে ঘাম মুছে’ পরিশ্রান্ত পরিতৃপ্ত ঈশ্বর স্বগতোক্তি করলেন “মেয়েটা ভালো হয়ে’ যাবে।” আমার ঈশ্বর কোথা থেকে জেনেছিলেন কলেরায় শরীর থেকে জল বেরিয়ে বেরিয়ে রোগীর মৃত্যু হয় (কলকাতা নিবাসকালে ঈশ্বরের দুই ভ্রাতা হরচন্দ্র ও হরিশচন্দ্র বিসূচিকা বা কলেরা রোগে মারা যায়; আসলে তৎকালে কলকাতার পয়ঃপ্রণালী ও জলসরবরাহ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিলো; ফলতঃ মশা, মাছি ম্যালেরিয়া ও কলেরা ছিলো মানুষের নিত্যসঙ্গী।পুত্রবিয়োগের পরে ঠাকুরদাসের নির্দেশে পৌত্র নারায়ণ ও পুত্রবধূ দীনময়ীর কলকাতা যাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়)
মালি কালী মন্ডল এসে ঈশ্বরকে জানায় “দুটো আমগাছেই মুকুল আইসেছে”- একটা কিষাণভোগ, এটা খরিদ করার সময় থেকেই ছিলো আর অন্যটা ভাগলপুরি ল্যাংড়া-ঈশ্বরের নিজের আনা।
আমার একাকী দুঃখী ঈশ্বর নির্জনবাসের জন্য প্রথমে দেওঘরে একটা বাগানবাড়ির সন্ধান করেছিলেন-যেখানে বঙ্গদেশে উচ্চশিক্ষা প্রসার এবং পুস্তকাদি প্রণয়নের যথেষ্ট অবসর পাওয়া যাবে। কিন্তু দেওঘরের বাগানবাড়ির অস্বাভাবিক দাম দাবী করায় হতাশ হয়ে’ পড়েছিল। এই সময় কর্মাটাঁড়ে এই বাড়িসহ জমিটির সন্ধান আসে।
বাদুড়বাগানে ঈশ্বরের ভাড়া বাড়িতে বইপত্র রাখার যথেষ্ট জায়গাও ছিলো না। তবু মাঝে মধ্যে ঈশ্বর কর্মাটাঁড় হ’তে রেলগাড়িতে কলকাতার বাসা বাড়িতে গিয়ে থাকতেন। জুড়িগাড়ির দুর্ঘটনায় আমার ঈশ্বরের জীবনসংশয় উপস্থিত হয়েছিল (১৮৬৬, ১৬ই ডিসেম্বর)। এমনকি ঈশ্বরের যকৃত চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে এক মর্মন্তুদ কাহিনী।
যে জাতি আমার ঈশ্বরের নামে জেলেপাড়ার সং বার করে’ তাঁর বাড়ির সামনে বিকৃত উল্লাস করেছে-আঘাতের পর আঘাত করে’ তৃপ্তি পেয়েছে-মৃত্যুতে তার সব অবদান যে ভুলে’ সে জাত যে কুনাট্যে মজবে তাতে বিষ্ময় কী! বাঙালি জাতি হিসেবে কতোটা হীন-নীচ এবং কূপমন্ডুক সে কথা যথাস্থানে উল্লেখ করা যাবে।
আমার ঈশ্বর অসুস্থ জেনে এই সময় একদিন হাইকোর্টের ব্যবহারজীবী শিবাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বাদুড়বাগানে তাঁর বাসায় দেখা করতে এলেন।ব্যথাকাতর ঈশ্বরকে তিনি বললেন “কর্মাটাঁড়ে থাকলে তো আপনি ভালো থাকেন।কিছুদিন সেখানে গিয়ে থাকুন না”
কর্মাটাঁড়ের উল্লেখে ঈশ্বরের দুচোখ জলে ভরে’ আসে।নিজেকে কোনক্রমে সংযত করে’ বলেন “আমার যদি অতুল ঐশ্বর্য থাকতো, তাহলে সেখানে গিয়ে থাকতাম। কিন্তু আমার সে ক্ষমতা কই? ওখানে গিয়ে আমি একা খাওয়া দাওয়া করবো আর দরিদ্র সাঁওতালরা না খেয়ে মরবে-একি সইতে পারি?”
কথা শেষে ঈশ্বর আর আত্মসম্বরণ করতে পারেন না। দুচোখ বেয়ে অঝোরে নেমে আসে করুণাধারা।
কর্মাটাঁড়ের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তাঁর ভারি আশ্চর্য ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে হোমিওপ্যাথি ওষুধ নিয়ে বসে’ অসুস্থ অশিক্ষিত দরিদ্র সাঁওতালদের চিকিৎসা করা। তখন রক্তমাংসের ঈশ্বর সত্যসত্যই দীনদরিদ্রের চোখে ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। তারপর তাদের বাতাসা, জল সাগু, মিছরি খাওয়ানো। এরপর শুরু হয় লেখালেখি। আরও অধ্যয়ন। এখানে বসেই শেষ হয় “বর্ণপরিচয়” তৃতীয় ভাগের কাজ-লেখা হয় “সীতার বনবাস”।
আদিতে কর্মা বলে এক সাঁওতাল মাঝির জমি ছিল এই কর্মা। জমিটি উঁচু ছিল বলে টাঁড় বলা হতো। সাঁওতাল ভাষায় টাঁড় মানে উঁচু জমি। মূলতঃ অনুর্বর, রুক্ষ ভূমি।
মাঝে কিছুদিন শম্ভুচন্দ্র (তৃতীয় ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন) এসে ঈশ্বর-সান্নিধ্যে ছিলেন (১৮৭৫)। তিনি বলেছেন দ্বিপ্রাহরিক ভোজনান্তে অপরাহ্নে ঈশ্বর যেতেন দরিদ্র, পীড়িত সাঁওতালদের পর্ণকুটিরে। আরও অনেক বিখ্যাত মণীষী এসেছেন এই কর্মাটাঁড়ে। তাঁদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগরের বন্ধুপুত্র) উল্লেখ্য। উনি লিখেছেন
একদিন সকালে এক সাঁওতাল কিছু ভুট্টা নিয়ে এসে বললো “এ নে বিদ্যাসাগর,এগুলো রেখে পাঁচ গন্ডা পয়সা দে আমায়। নৈলে আমার ছেলের চিকিৎসা হবে না।” বিদ্যাসাগর ভুট্টা নিয়ে তাকে পয়সা দিলেন। পরে আরেকজন ভুট্টা দিয়ে আটগন্ডা পয়সা নিয়ে গেল। তারপর আরও কয়েকজন ভুট্টা দিয়ে পয়সা নিয়ে গেল। বিষ্মিত হরপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করলেন
“এত ভুট্টা নিয়ে আপনি কী করবেন?”
বিদ্যাসাগর বললেন “দেখবি রে দেখবি”
তার পরে কাজ শেষ করে দলে দলে সাঁওতাল এসে’ দাবী করছে “বিদ্যাসাগর, খেতে দে”
আমার ঈশ্বর-বিদ্যাসাগর, সবাইকে ভুট্টা পরিবেশন করলেন। সাঁওতালরা পাতা জ্বালিয়ে ভুট্টা পুড়িয়ে খে’য়ে গেল।
বিস্তর সাঁওতালের বাস এই কর্মাটাঁড়ে। বিদ্যাসাগরের ভারি পছন্দের মানুষ এরা।
“সাঁওতালদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার আনন্দ হয়। ওরা গালি দিলেও আমার তৃপ্তি। ওরা অসভ্য বটে, কিন্তু সরল ও সত্যবাদী।”
এখানে আমার ঈশ্বর আত্মার শান্তি-প্রাণের আনন্দ পেয়েছিলেন। তাদের ঘটিবাটি, জামাকাপড়, ওষুধ বিষুধ, চাল ডাল, ঘুনসি, আরশি চিরুনি সব অকাতরে বিলিয়ে দিতেন।
এক সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের সামনে এক সাঁওতাল রমণী এসেছে। সঙ্গে তার আরেক রমণী “ইটা আমার বিহান [সম্ভবতঃ বিহা (বিবাহ) সম্পর্কিত আত্মীয় হয়-ননদ বা জা], তুই একে একটা কাপড় দে”
ঈশ্বর “হ্যাঁরে কাপড় কোথায় পাবো?”
-“চল তো,সিন্দুকটা খুলবি”
-“চল,দেখবি”
সিন্দুক খুলে দিলো ঈশ্বর।ভর্তি কাপড়।
-“ইয়েঃ, তুইও মিছা কথাটা শিখলি হেঃ?”
-“আর তোদের দেশে এসেই তো শিখলাম”
-“আমরা মিছা কথাটা কই না, আমরা জানতাম তুই মিছা কথাটা বলিস না” মেয়েটি খুব দুঃখ করেই বললো।
ঈশ্বর হাসেন। এদের নির্মল, প্রাণখোলা, সরল কথায় সে বড়ো ভালো থাকে।
কর্মাটাঁড়ে সাঁওতাল মজুররা সারা দিন কাজ করে’ দু আনা মজুরি পেতো।বিদ্যাসাগর বাক্যবদ্ধ হলেন চারআনা মজুরি দেওয়ার। প্রথমে মজুররা ঝুটা বাঙালি বলে প্রস্তাবটা হেসে উড়িয়ে দেয়। পরে কাজ করতে স্বীকৃত হয়।একদিন প্রবল বৃষ্টিতেও ওরা অবিরাম কাজ করছিলো-পাছে তাদের মজুরি কাটা যায়। তাহলে বাড়ির মানুষ কী খাবে? ঈশ্বর তাদের জোর করেই ঘরে নিয়ে আসে-এবং পুরো দিনের মজুরি দেন। এভাবে আমার ঈশ্বর-সকলের বিদ্যাসাগর-ঝুটা বাঙালি অপবাদমুক্ত হন।
বহু বহু মানুষ ফেরত দেওয়ার কথা দিয়েও ঋণের টাকা বিদ্যাসাগরকে ফেরত দেয় নি (ব্যতিক্রম যশোরে সাগরদাঁড়ির মাইকেল মধুসূদন। মধুকবি বসতবাড়ি বিক্রি করে’ ঈশ্বরের ঋণশোধ করেছিলো)। তাই আদিবাসীদের চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও সারল্য আর সত্যভাষণ ঈশ্বরকে কাছে টেনে নিয়ে ছিলো। বিচ্ছিন্নভাবে সতেরো বছর এই ঢেউখেলানো-শাল শিমুলের দেশে কাটিয়ে ঈশ্বর শারীরিক কারণে চলে যেতে বাধ্য হন।
কিমধিকেনেতি।
২৭/১০/২০২২
প্রথম সর্গ সমাপ্ত।