ঘোর গ্রীষ্মের দুপুর। টোটোন টুলটুলি, নীলু, সবিতা সবাই চলে গেছে।বাড়ির পেছনে সিএমওএইচের বাংলোয় দুটো আমগাছ, তার নিচে রামবেগুনের ছায়া ছায়া ঝোপ, তার তলায় শুয়ে ছিলাম। বাংলোর পরে ফরেস্টের গেস্ট হাউস-ইউক্যালিপ্টাশের গাছ-দোলনা-স্লিপ; দুটোর মধ্যে একটা পিচগলা রাস্তা। মা আসছে।গোবিন্দনগর থেকে হেঁটে হেঁটে। মাথায় কালো ছাতা। পূন্নিমামাসি আমার ভাত মেখে বসে আছে।মা এলে খাবো।
আজ বুঝি মা কেন রিকশা করে’ নি।
সদ্য তখন স্বাধীনতা। গ্রামে শহরে মধ্যরাতে পতাকা তোলা। জহরলাল, জিন্না…কেন জানি না গান্ধীজির কথা তখন আমাদের খুব মনে পড়ে না। অবশ্য স্বাধীনতার সময়ে আমরা কোথায়? বাবা ছিলো রঘুনাথপুরে। আর মা?সেই ওপার বাংলার চট্টগ্রাম। স্বাধীনতার মাশুল দিতে তারা তখন রেঙ্গুন হয়ে স্বদেশে ফেরার চেষ্টা করছে। তখন চারপাশ জুড়ে মৃত্যু হত্যা আর হানাহানি। জাহাজে সবার জায়গা হলো না। কতো সংসার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। দোদো (আমার দাদু) আর কয়েকজন এবার পায়দল। বার্মা হয়ে, বন জঙ্গল পেরিয়ে শুধু হাঁটা। মাও তো অনেকটা পথ পার করেছে- থমকে দিতে আর কেউ পারবে না। তাই বোধহয় ফর্সা, ছোট্ট মা, যখন রাস্তায় ভৈরবথানের দোকান সব বন্ধ-যখন রিকশাওয়ালা সব নিকানো দাওয়ায়-তখন রোদ্দুরে লাল হয়ে ফিরতো মেডিক্যাল কলেজ থেকে।
মা বসে বসে খেতো-আমি দৌড়ে দৌড়ে। তারপর মেঝেতে ভেজা মাদুর পেতে-জানালার পর্দা ভিজিয়ে শান বাঁধানো মেঝেতে শোওয়া।বিছানা তখন আগুন। জানালার বাতাসে আগুন। সেই লু-এর দুপুরে মা ঘুমিয়ে গেলে বাইরের ঘরের জানালা খুলে দূর আকাশে চীলের হ্রেস্বাধ্বনি শুনতাম।দুপুর গড়িয়ে যেতো-শালিক পাখিরা ঘুলঘুলিতে বসে ডাকতো কিং ক্কান্ড রোদ কাকুলি কাকুলি-গ্রিঈঈ আয় আয় আয়-বিকেল হতো। মা উঠতো। আমি কুমির ডাঙা খেলতে যেতাম। কাঁকুড়ে লাল মাটিতে হাঁটু ঘসে ছাল তুলে দূব্বাঘাস, তুলসি পাতা লাগিয়ে ফিরতাম। জানালায় জানালায় আমরা বাচ্চারা পড়তে বসতাম। মায়েরা এলআইসি কোয়াটারের মাঝের আঙ্গিনায় চেয়ার নিয়ে বসতো। কোথাও খরিশ, গোখরো হিসহিসিয়ে বেরিয়ে পড়তো। রাত বাড়তো। দারকেশ্বর নদীর তীরে, শ্মশানে শেয়াল ডাকতো। সাঁওতালদের পাড়ায় মাদল বাজতো। একঘেয়ে গান বাজতো। বাবা মাকে জীবনানন্দ পাঠ করে শোনাতো আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।
ক্রমশঃ