বাবা একখানে। আমরা আরেক খানে। এরমধ্যে আমার হলো গলায় সেলুলাইটিস।ধুম জ্বর। কোয়ার্টারের দেওয়ালগুলো সব হিজিবিজি ছবির মতো।কখনও বা দানবের মতো। কখনও ফুলের বাগান। মা’কে বললে মা ভয় পেতো। এক সন্তান এক বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।বাঁকুড়ার এক গ্রামে। বাবাকে চিঠি লিখলে উত্তর নেই। বাবার কোনও চিঠিপত্র নেই। তখন ওষুধ তো কটা মাত্র। ওরিসুল, পেনিসিলিন আর প্যারাসিটামল। রাতে যখন জ্বর বাড়তো মা তখন গল্প বলতো।মায়ের ছোটবেলার গল্প।অভাব ছিলো, অভিযোগ ছিলো না। অপ্রাপ্তির ছোঁয়া থাকতো না। কতো কম চাহিদায় কতো বেশী পাওয়া যায়-তার গল্প।
“আমি স্কুলে যাই নি। ঘরে তোর দোদো আর আমার দাদু আমাকে পড়াতো। ফএর উচ্চারণে কতোটা হাওয়া মেশালে সেটা ঠিকঠাক ইংরেজি হয় আর হাওয়া না দিলে বাংলা হয়-দাদু এই সব শেখাতো”
বাটিতে জলপটি ভিজিয়ে কপালে দিতে দিতে বলতো
“দি শব্দের উচ্চারণ কখন দি আর কখন দ্য এসব বলতো….চোখ বন্ধ করলে আর ঐসব দানবগুলো আসছে না তো? তাহলে জ্বর কমছে… .এবার একটু ঘুমো তো দেখি…”
সারাদিন হাসপাতালে কাজ করা মায়ের চোখ বন্ধ হয়ে আসতো। দিন যায় তবু জ্বর কমে না। সেই প্রথম আর সেই শেষ আমাদের বাড়িতে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারবাবু এলেন। পাড়ার মজুমদারকাকু। এসে আমার ফুলে ওঠা গলা, আর শীর্ণ চেহারা দেখে ওনার মুখের যা অবস্থা হয়েছিল তাতে আমি বুঝেছিলাম এই বিদ্যার দৌড় কতটা।
আস্তে আস্তে জ্বর কমে এলো। তখন বাড়িতে সোভিয়েত দেশ আর প্রগতি প্রকাশনীর একগুচ্ছ নতুন বই এলো।
তারপর পরই বাবা এলো। তখন আমি সুস্থ। তবে ক্লান্ত। অসুখের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত।
এরপর ছুটির দুপুরে মায়ের ডাক্তারির গল্প শুনতাম। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশের বিষয়ে কিছু বলতো না। পরে মার্কশিট দেখেছি।প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়েছে এবং আমার থেকেও ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করেছে।
“বুঝলি জুলু তো প্রথম থেকেই একটু ডাকাবুকো-পার্ক সার্কাসে তখন তোর ছোটমামা রীতিমতো নামকরা হয়ে উঠছে। বোমা বানায়, ওখানকার গুন্ডারাও ভয় পায়….দাদা তো তখন ডাক্তারি পাশ করার মুখে…বাড়ি আমিই সামলাতাম ফুলু শান্ত, নরম সরম ছিলো-প্রচুর পড়াশোনা করতো।”
“ছোটমামা বোমা বানাতো?
কি করতো বোমা দিয়ে?”
“আমি সকালে সবাইকার রান্না করে-বুঝিয়ে দিয়ে মেডিক্যাল কলেজে যেতাম…ও কী করতো জানবো কী করে?”
এই উত্তরে আমার মন ভরতো না। মনে মনে ছোটমামা আমার হীরো হয়ে উঠেছিলো।
“এই যে দেখছিস দাগগুলো? তখন আন্দোলন চলছে…খাবার নেই.. লোকের টাকা নেই…এটা পুলিশের লাঠিচার্জের ফল। হাড়টা সরে গেছিলো…আর কাঁধের দাগটা…”
সেটা আর জানা হয় না। কী যেন কাজে মা উঠে গেল। অথচ জানা উচিত ছিলো। খুব দরকার ছিলো। ওটা কোন আন্দোলনের চিহ্ন…কারা ছিলো তোমার সঙ্গে মিছিলে…কতো কী তো জানা হয় নি।শুধু স্মৃতি খুঁড়ে যতটুকু পাওয়া যায় বার করা।
ক্রমশঃ