তিয়ার সেদিন অফিস বেরতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছিল। বাস স্টপে যখন পৌঁছল তখন পিক অফিস টাইম। যা হোক করে বাসে উঠে ঠেলেঠুলে লেডিস সিটের সামনে একটা দাঁড়ানোর জায়গা করে নিল। ভিড় বাস, প্রচণ্ড চাপাচাপি, তার মধ্যে কন্ডাকটর চেঁচাচ্ছে, “পিছনের দিকে এগিয়ে যান”।
কিছুক্ষণ পরেই তিয়া একটা অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। কাঁধের ব্যাগটা পিছন দিকে রেখেও তা সামলানো যাচ্ছিল না। চোখের সামনে ওদিকে জ্বলজ্বল করছে বাসের গায়ে লেখা, “আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয়।” ওর এই অস্বস্তি কী পাশের ছেলেটা বুঝতে পারলো? যদিও ছেলেটার চক্করবক্কর ছাপ জামা, মাথার ওপর তোলা সানগ্লাস, কানে গোঁজা হেডফোন আর চুলের স্টাইল দেখে খুব একটা সম্মান জাগেনি তার। ছেলেটির সঙ্গে দু একবার চোখাচোখি হলেও তিয়ার ভালো লাগেনি। বরং অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছিল। এরমধ্যে তিয়ার কানে আসে, ওই ছেলেটি তার পিছনের লোকটিকে বলছে, “দাদা, আপনার হয়ে গেলে আমাকে জানাবেন। আমি লাইনে আছি।”
তিয়া রাগ, বিরক্তি সত্ত্বেও হেসে ফেলে। পিছনের সেই লোকটি সঙ্গে সঙ্গে গেটের দিকে পা বাড়ায়। পরের স্টপের আগেই ট্র্যাফিক সিগন্যালে নেমে যায়। ছেলেটাকে তিয়া ধন্যবাদ জানাবে কি জানাবে না ভাবতে ভাবতেই দেখে সেই ইয়ারফোন, সানগ্লাস রাস্তায় হাঁটছে। তিয়ার একরাশ ভালোবাসা তার প্রতিবাদী ভাইটাকে ভিজিয়ে দিল। অরুণ-বরুণ-কিরণমালা শুধু রূপকথা নয়।
ভাইফোঁটার কোনো দিন হয় না।
২
শ্যামল ৫টার সময় ডিউটি শেষে হাসপাতালের গেট দিয়ে বেরনোর সময় দেখলো মেয়েটা বসে আছে। হাসপাতালের আউটডোরের অত রোগীর মধ্যে কারো বিশেষ মুখ মনে রাখা সাধারণত সম্ভব হয় না। কিন্তু এই মেয়েটিকে মনে আছে। কারণ মেয়েটির ৩০ সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট। ব্লাড প্রেশার বেশি। তার ওপর যমজ সন্তান বাড়ছে ওর শরীরে। অথচ একা একা এসেছে চেক-আপের জন্য। তাই খুব বকেছিল শ্যামল। চোখ নামিয়ে মেয়েটি খুব ধীর গলায় বলেছিল, আমার শাশুড়ি খুব অসুস্থ। আর স্বামী সঙ্গে এলে একদিনের “রোজ” নষ্ট হবে। শ্যামলের মনে পড়ে গেছিলো স্যারের কথা, ‘রোগকে জানতে হলে রুগীকে চিনতে হবে।’ দিনে একশো করে লোক সত্যিই কি চেনা সম্ভব?
-এখনও বসে আছো?
-আগের বাসটায় খুব ভিড় ছেল বলে উঠতি পারিনি। আমার বর বলে দেছে, সাতটার বাসে গেলি ভিড় কম হবে।
– কোথায় থাকো?
-মোহনপুর।
-বাড়ি যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে তো?
-তা হবে।
গাড়িতে স্টার্ট দেবার সময় হঠাৎই শ্যামলের মনে হয়, ওর বাড়ি ফেরার পথেই তো মোহনপুর পড়বে। মেয়েটিকে কী ও নামিয়ে দেবে? কাজটা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই হাসপাতালের গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
-আমি তোমায় নামিয়ে দিতে পারি।
মেয়েটি চোখ নামিয়ে বলে, না ছ্যার। আমি ঠিক চইলে যেতি পারবো। আপনার অসুবিধে হবে।
-না, হবে না। তোমার শরীরের এই অবস্থায় ভিড় বাসে চড়া মুশকিল। তা ঠিকও হবে না। আর রাত করে ফেরা নিরাপদ নয়।
মেয়েটি আর কথা না বলে শ্যামলের সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়ে। কথায় কথায় শ্যামল জানতে পারে মেয়েটির নাম সাকিনা।
কী করে সিট বেল্ট বাঁধতে হয় সাকিনাকে শেখায় শ্যামল। সে তো হেসেই খুন। এই জিনিস আগে কখনো দেখেনি। পথ চলতে চলতে সাকিনা ওর বস্তির কথা, গ্রামের কথা শোনাচ্ছিল। হঠাৎ সে শ্যামলকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা ছ্যার, আপনি বাতাসা খান? আমি বাড়ি থেকে বেরনোর সময় মা কিছু মুড়ি বাতাসা দে দিছিল। কয়েক খান বাতাসা এখনও আছে।”
শ্যামল না বলতে গিয়েও হ্যাঁ বলে দেয়, পাছে মেয়েটি কষ্ট পায় তাই। আর ছোট্ট “হ্যাঁ” শুনেই সাকিনার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। সামান্য কিছু দিতে পেরে তার কী আনন্দ! বহু যুগ বাদে শ্যামল বাতাসা পেয়েছে। মনে পড়ে, ছোটোবেলায় ঠাকুমার “হরির লুটের” কথা।
টুকটাক কথা বলতে বলতে শ্যামল আর সাকিনা পথ চলছিল। এক সময় সাকিনা বলে উঠল, “দাদা, দাদা থামো। এই টপেজেই নামবো” তার পরেই জিভ কেটে বলে, “ছ্যার ভুল হয়ে গেছে। মাফ কইরে দেবেন। কন্ডাকটারকে দাদা বলি তো। তাই মুখ থেকে বেইরে গেল।”
শ্যামল মুচকি হেসে গাড়ি সাইড করলো। সাকিনা নেমে গেল। শ্যামল নিজের মনেই হাসতে হাসতে ফের গাড়িটা স্টার্ট দিলো। এক ছায়া- বন পেরিয়ে গাড়ি বাড়ির দিকে এগোতে থাকে।
ভাইফোঁটার কোনো দিন হয়না।