An Initiative of Swasthyer Britto society

  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Menu
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Swasthyer Britte Archive
Facebook Twitter Google-plus Youtube Microphone
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Search
Close
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Search
Close

বিহুঃ উত্তম দত্তের লেখা গল্প

IMG-20200125-WA0007
Doctors' Dialogue

Doctors' Dialogue

আমরা ডাক্তার। কারও কাছে আমরা ভগবান। আবার কেউ ভাবেন আমরা মৃত্যুদূত। কারও আমাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। কেউ ভাবেন সবটাই ব্যবসা।
My Other Posts
  • January 26, 2020
  • 9:02 am
  • 3 Comments

কালের কষ্টিপাথর পত্রিকা থেকে পুনঃপ্রকাশিত
★
মানুষ খুন করার অভিজ্ঞতা যাদের নেই তাদের কিছুতেই বোঝানো যাবে না কীভাবে খুন হয়ে যাওয়া একজন মানুষ প্রতি মুহূর্তে নিঃশব্দে খুন করে তার ঘাতককে।

রাজনৈতিক খুন হলেও সেটা খুনই। গরু ছাগল তো নয়, পাখি কিংবা কীট-পতঙ্গও নয়, অবিকল আমারই মতো হাত-পা-ওয়ালা, আমারই মতো বাংলাভাষায় কথা বলা একটা মানুষ চোখের সামনে একটু ছিটকে গিয়ে মাটিতে পড়ে ধর্মঠাকুরের পুজোয় বলি দেওয়া সাদা পাঁঠার মতো ছটফট করছে, এটা দেখে যে অদ্ভুত একটা দুঃসহ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা ভুলতে কতবার আমি পকেটে লুকিয়ে রেখেছি হাত।

তিন মাস পরেও মনে হতো রক্ত লেগে আছে হাতে। চারপাশ দেখে নিয়ে সবুজ ঘাসে মুছে ফেলেছি রক্তে ভেজা হাত। সৈকতের বালি দিয়ে নখ ঘষে নদীর জলে ধুয়ে ফেলেছি দুর্মোচ্য রক্তের দাগ। তবু মনে হতো মৃত মানুষটির রক্ত লেপটে আছে আমার দুই হাতের প্রতিটি কররেখায়।

আসানসোল থেকে পালিয়ে লাতেহার। সেখান থেকে কোয়েলের কাছে একটি আদিবাসী-ঝুপড়িতে কিছুদিন ঘাপটি মেরে পড়ে ছিলাম। বিহার-পুলিশের তাড়া খেয়ে মণিপুরের পথে যেতে যেতে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলাম অসমের একটা ছোট্ট পাহাড়ি টিলায়।

উদ্দেশ্যহীনভাবে একটা অচেনা তরুণকে বাজার এলাকায় ঘুরতে দেখে এক শুঁটকি মাছ-ব্যবসায়ী ইশারায় আমাকে জানায়, কোনও লাফরা থাকলে পালিয়ে যাও। পুলিশ তোমার উপর নজর রাখছে।

কথাটা যে মিথ্যে নয় ঘণ্টা দুয়েক আগে আমিও সেটা টের পেয়েছি। পকেটে মাত্র পাঁচ টাকা নিয়ে হাটের সমস্ত জিনিসের দরদাম করার মতো ভালো অভিনেতা আমি নই। সারাক্ষণ দুটো লোক দুপাশ থেকে অনুসরণ করছে আমাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে পালাব কোথায়? এখানে আমার কোনও আশ্রয় নেই।

মণিপুরের একটা ঠিকানা লেখা কাগজ রয়েছে পকেটে। প্রতিটি শব্দই উল্টো করে লেখা ইংরেজিতে। ট্রেনের টিকিট কাটার টাকা নেই। তবু যেভাবে হোক যেতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে পুলিশের চোখ এড়িয়ে যাবই বা কোথায়? অচেনা বাঙালি কোনও কম বয়সী ছেলে দেখলেই সবাই এখন ভুরু কুঁচকে তাকায়।

হাটের ঠিক পেছনেই একটা ঘিঞ্জি বস্তি। চারপাশে অদ্ভুত গন্ধ। সস্তার তেলেভাজা আর দেশি মদ নিয়ে বসে আছে খিন্ন চেহারার কিছু মানুষ। দু একটা কুকুর শুয়ে আছে ধুলোর ওপরে। সারি সারি ঘর। টিনের চালা। পুরোনো ফাটল-ধরা মেঝে।

প্রত্যেক ঘরের দরজায় রঙ বেরঙের মেখলা পরা মেয়েরা ঠোঁটে রঙ মেখে দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত সব ভঙ্গিতে। মুখে পান। পায়ে সস্তার চপ্পল। কারো কারো হাতে জ্বলন্ত মোহিনী বিড়ি অথবা নাম্বার টেন সিগারেট। ফুঁকছে। মেয়েদের নাক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া বেরোতে দেখলে আমার গা ঘিন ঘিন করে। বমি আসে।

ফুটপাথের একজন মদ-বিক্রেতার কাছে গিয়ে খুব বিনীতভাবে বললাম, দাদা একটু জল পাওয়া যাবে?

সে মাথা নেড়ে বলল, জল নেই। মদ আছে। লাগলে দিতে পারে।

তারপর কী ভেবে একটি অল্প বয়সী তরুণীর দিকে হাত তুলে ইশারায় কী যেন বলল। মেয়েটি মোহিনী সরীসৃপের মতো এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে টেনে গিয়ে গেল ওর ঘরে।

তখন সন্ধে নেমেছে। কিছু পুরুষমানুষ, কিছু সাদা পোশাক-পরা ফৌজি আর কিছু মাতাল সাজগোজ-করা মেয়েদের সঙ্গে ফিসফিস করে দরদাম করছে।

আমাকে ঘরের ভেতরে একটা তক্তপোশে বসিয়ে কুঁজো থেকে জল নিয়ে এলো মেয়েটি। আহ, কী ঠান্ডা জল। এক চুমুকে গ্লাসের সবটুকু জল শেষ করে ফেলতেই মেয়েটি জানতে চাইল, আর এক গ্লাস খাব কিনা। আমি মাথা নেড়ে বললাম, দাও।
মেয়েটি আবার ফিরে গেল বালির পাত্রে রাখা কালো কুঁজোর কাছে।

ওল্টানো চন্দ্রবোড়া সাপের পেটের মতো হলদে-সাদা তার কোমর। অল্প চর্বি আর কেমন একটা বন্য মসৃণতা। সেখান থেকে চোখ সরিয়ে ঘরের একটিমাত্র বিছানার দিকে তাকালাম। একটা কম দামি মেরুন রঙের বেডকভার। মাথার দিকে দুটি বালিশ। একপাশে শিশুকাঠের আলনা। তাতে দুটি শাড়ি, একটি মেখলা, দুটি ফিনফিনে ব্লাউজ আর তিনটি লাল রঙের ব্রা ছাল-ছাড়ানো বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে।

আলনার পেছনদিকের কাঠের রডে ঝুলছে পুরুষের ব্যবহৃত একটি জাঙিয়া, দুটি টি-শার্ট, একটা জলপাই রঙের ফুলপ্যান্ট আর একটি চামড়ার বেল্ট।

মেয়েটি জল নিয়ে ততক্ষণে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার চোখের অনাবশ্যক কৌতূহল দেখে সে জানালো, এগুলো ওর বয়ফ্রেন্ডের। যতক্ষণ ঘরে লোক থাকে সে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। নজর রাখে কে ঢুকছে কে বেরোচ্ছে।

তারপর সে সরাসরি কাজের কথায় চলে গেল। অসমীয়া ভাষাতেই দ্রুত বলে গেলঃ সবকিছু বুঝে শুনে নিন। ঘণ্টায় একশ টাকা। যতবার খুশি। মদের দাম আর ওয়াশরুমের জলের খরচ আলাদা। ওই টাকা বাড়িওয়ালিকে দিতে হয়। উল্টোপাল্টা কিছু করতে চাইলে আরও একশ টাকা বেশি লাগবে।

একটু থেমে আবার সে জানালো, ভয় পাবেন না। এখানে ভয়ের কিছু নেই। পুলিশের সঙ্গে বাড়িওয়ালির হপ্তায় বন্দোবস্ত আছে। আর প্রতিমাসে একজন ডাক্তার এসে আমাদের শরীর দেখে যায়। কোনও রোগ নেই আমার শরীরে। বিশ্বাস না হয় নিজের চোখে দেখে নিতে পারেন। সব খুলে দিচ্ছি, দেখে নিন।

সারা শরীর তখন ঘামতে শুরু করেছে আমার। গলা শুকিয়ে আখরোট। ঠোঁটের জমিতে জল নেই এক ফোঁটাও। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না এই মুহূর্তে। আমি সোজা উঠে দাঁড়ালাম। ডানহাতটা পকেটে ঢুকিয়ে খুব চাপাস্বরে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে বললামঃ ‘শোনো, পুলিশ আমার পিছনে লেগেছে। কিন্তু আমি চোর ডাকাত নই। ভদ্রঘরের ছেলে। একটা নিরীহ পুলিশকে আমি মেরে ফেলেছি। তারপর একটা খারাপ পুলিশক গুলি করেছি। সে তোমারই মতো একটি মেয়েকে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেপ করেছিল। সেই থেকে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আজ এখানে কাল অন্য কোথাও। আমার পকেটে মাত্র পাঁচটা টাকা আছে। গত চব্বিশ ঘন্টা আমার পেটে কিছু পড়েনি। এক গেলাস জল খাব বলে তোমার ঘরে ঢুকেছিলাম। তুমি জল দিয়েছ । তার জন্য কৃতজ্ঞ। এবার আমি যাই।’

আমি দরজার দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই সে বাঁ হাতে আমার জামার কলার খামচে ধরে। আর ডান হাতের এক টানে নিজের বিচিত্র বর্ণময় মেখলা খুলে ফেলে। ভেতরে একটা লাল-হলুদ ডোরা কাটা প্যান্টি। প্যান্টির দুপাশে দুটো বোতাম। সেগুলো খুলে দিয়ে সে প্যান্টিটা ছুঁড়ে মারল বিছানার এক কোণে। তারপর এক হ্যাঁচকায় আমাকে মেঝের উপরে বসিয়ে দিয়ে বললঃ ‘শোনো, আমার নাম বিহু। বেশি চালাকি কোরো না। যা করবার তাড়াতাড়ি করো। টাকা ফ্যালো, তারপর চলে যাও যেখানে খুশি। এ পাড়ায় আমার মতো সুন্দরী আর কেউ নেই। তুমি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে ঢুকতে চাইছ? সে তুমি যেতে পারো। অনেকেই সেটা করে। কিন্তু টাকা না দিয়ে এ ঘর থেকে বেরোলে পাড়ার ছেলেরা মেরে তোমার ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে।’

আমি বললাম, ‘বিশ্বাস করো, অত টাকা নেই আমার কাছে। এই দ্যাখো পকেট। মাত্র পাঁচ টাকা আছে।’

বিহু ভালো করে দেখল দোমড়ানো পাঁচ টাকার নোটটা। তারপর হিপ পকেট হাতড়ে দেখে নিল একবার। আমার ডানহাত তখনও পকেটে। সে জানতে চাইল, ‘কী ওটা?’

আমি বললাম, ‘ও কিছু না। একটা দেশি পিস্তল।’

বিহু খুব অবাক হলো না। বলল, তোমার মেশিনে দানা ভরা আছে?

—- ‘আছে’।

— ‘ পকেটে মেশিন আর পাঁচটাকা নিয়ে বেশ্যার ঘরে ফুর্তি করতে এসেছো? তুমি কি মাস্তান? নাকি স্মার্ট ভিখিরি।… শালা, কাজে নামার আগে মেজাজটাই নষ্ট করে দিল।’

বিহু এমনভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, মনে হচ্ছিল সঙ্গমে অনিচ্ছুক অর্জুনকে নগ্ন উর্বশী এই ভঙ্গিতেই একদা বৃহন্নলা-জন্মের অভিশাপ দিয়েছিল।

হঠাৎ বন্ধ দরজায় খুব আস্তে আস্তে দুবার টোকা দেবার শব্দে চমকে উঠলাম আমি। আর বিহু খুব দ্রুত হাতে মেখলাটা জড়িয়ে নিল গায়ে। তারপর দরজার কাছে গিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বলল কাউকে। বাইরে থেকে কী একটা উত্তর এলো ততোধিক দুর্বোধ্য ভাষায়। পুরুষ কণ্ঠ।

বিহু ফিরে এলো আমার সামনে। বলল, ‘তোমার বাইরে যাবার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। মহল্লা ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। তুমি যে আমার কী সর্বনাশ করলে! যাক সেসব। নষ্ট করার মতো সময় নেই হাতে। তুমি পাশের ঘরে এসো।’

আমার হাত ধরে আবার হ্যাঁচকা টান মারল মেয়েটি। এত নরম চেহারার একটি মেয়ের শরীরে যে এমন বাঘিনীর মতো শক্তি থাকতে পারে, সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। পাশের ঘরে একটা বড় টেবিলে নানা আকারের মদের বোতল আর কয়েকটি গ্লাস। একপাশে দেবী কামাখ্যার মূর্তি। কাঠের সিংহাসনে বসানো। সামনে পূজার বিভিন্ন উপকরণ। সকালে পুজো দেওয়া হয়েছে। টাটকা ফুল আর প্রায় নিভন্ত পেতলের প্রদীপ তখনও আলো ছড়াচ্ছে।

বিহু আমাকে টেবিলের উপরে উঠে দাঁড়াতে বলল। তারপর সিলিঙের একটা অংশ দেখিয়ে ঢাকনাটা সরিয়ে উপরে উঠে যেতে নির্দেশ দিল। আমি ওর কথা মতো টেবিলে উঠে পড়লাম। কিন্তু এই পাতলা লিকলিকে চেহারা নিয়েও কিছুতেই ঢুকতে পারছিলাম না আকাশ-গুহায়।

সিলিঙের উচ্চতায় আমার সমস্যা হচ্ছে বুঝে বিহু বলল, ‘শোনো, এখন মই আনার সময় নেই। আর মই দেখলে ওরা সন্দেহ করবে। তুমি আমার কাঁধে পা রাখো। তারপর আরেকবার চেষ্টা করো।’ ওই মুহূর্তেও এমন অদ্ভুত নির্দেশে আমার দ্বিধা দেখে বিহু চাপা গর্জন করে উঠলঃ ‘ন্যাকামো কোরো না। যা বলছি করো। চটপট ওঠো। পা রাখো আমার ঘাড়ে। দরকার হলে মাথাতেও রাখতে পারো।’

এবার সে দু পা অল্প ফাঁক ক’রে মেরুদন্ড সোজা আর শক্ত করে দাঁড়ালো। আর আমি এক অপদার্থ পলাতক টেররিস্ট এক কুখ্যাত বেশ্যাপল্লীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির কাঁধে ও মাথায় আমার ধুলোমাখা পা রেখে সটান ঢুকে পড়লাম সিলিঙের গোপন গুহায়।

সেই মুহূর্তেই বাইরের বন্ধ দরজায় ভারী বুটের শব্দ শোনা গেল। ওরা সশব্দে লাথি মারছে দরজায়। বিহু আমাকে ইশারা করে চুপচাপ লুকিয়ে থাকতে ব’লে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ওর নির্দেশ মতো সিলিঙের মুখের ঢাকনা বন্ধ করে দিয়ে মৃতদেহের মতো নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলাম। শীতের দুপুরে আমাদের মরিচখেতের ভিতরে এভাবেই একদিন শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম একটা অতিকায় চন্দ্রবোড়া সাপকে। প্রাণ আছে, গতি নেই।

আমার মাথার কাছে কতগুলো ছোটো ছোটো প্যাকেট। আবছা অন্ধকারে গাঁজার মৃদু গন্ধ ভেসে আসছে। মুখের সামনে দুটি কন্ডোমের বাক্স। পায়ের কাছে একটা টিনের তোরঙ্গ। তালা ঝুলছে।

এমন সময় পাশের ঘর থেকে হল্লা ভেসে এলো। খুব খারাপ খারাপ গালাগাল দিয়ে একটা লোক জিজ্ঞেস করছেঃ ‘বল, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস হারামির বাচ্চাটাকে?’

বিহু ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। সে খুব স্পষ্ট আর জোরালো গলায় বললঃ ‘ ঘর সার্চ করে দেখে নিন। খাটের নীচে, আলনার পিছনে, দরজার আড়ালে, ওঘরে ঠাকুরের সিংহাসনের পিছনে যান। সব দেখে নিন। কেউ এসেছিল কিনা ভালো করে বুঝে নিন।’

মনে হলো আট দশজন লোক বিহুর ঘর তছনছ করে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে। এঘরেও এলো। কে একজন আহ্লাদে চীৎকার করে উঠল, ‘ওরে শালা, এত মদের বোতল! এই হাজারিকা, এগুলো সব সিজ কর। গাড়িতে তোল।’

একটা লোক বললঃ ‘ কিন্তু আমাদের কাছে পাক্কা খবর আছে, জানোয়ারটা এখানেই ঢুকেছে।’

আরও কিছুক্ষণ পরে পুলিশের লোকজন চলে গেলে সমস্ত ঘরের বাতাসে স্তব্ধতা নেমে আসে। শুধু বিহুর ফিসফিস শুনতে পাচ্ছি। কাউকে কিছু একটা বলছে আত্মপক্ষ সমর্থন করে। পুরুষটি শুধু বলছে ঃ ‘ কাজটা ভালো করিসনি। ওরা আবার আসবে। এসব ঝামেলা দেখলে কোনও কাস্টমার আসবে না তোর কাছে। এ পাড়ায় লোকের আনাগোনাও কমে যাবে। সবাই তোকে দুষবে। ভালো চাস তো মালটাকে পার করে দে আজ রাতেই। নইলে ও মালটা তো মরবেই। তুইও তিন বছর জেলের ঘানি টানবি। শুনলাম দু-দুটো পুলিশকে মার্ডার করেছে।’

উত্তরে বিহু কিছু বলল ছেলেটিকে। বোঝা গেল না ওর চাপা গলার কথাবার্তা। আমাকেও কেউ ডাকল না একবারও। অমানুষিক খিদে, ক্লান্তি আর উদবেগ নিয়ে গাঁজার বান্ডিল আর কন্ডোমের ধুলোমাখা আবর্জনার মধ্যে আমার চোখে অলৌকিকভাবে ঘুম নেমে আসে। ঘুমোবার আগে টের পাচ্ছিলাম আমার গলায় আর ঠোঁটের উপরে নিশিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে গণিকা-পল্লীর রূপসী আরশোলারা। স্বপ্নের মধ্যেও মনে হলো ব্রহ্মপুত্রের আকাশ জুড়ে কোনও পাখি নেই, শুধু উড়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার বাদামি রঙের আরশোলা। তারই মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসছে বিহুগানের আশ্চর্য বিষণ্ণ সুর।

কিসের একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। চারপাশ ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। মনে হলো অনেক রাত। কোথায় শুয়ে আছি, এটা মনে করতেই সময় লাগল কিছুক্ষণ। মনে পড়তেই গুলি খাওয়া জন্তুর মতো হুড়মুড়িয়ে উঠে বসতে গেলাম। নীচু চালায় মাথা ঠুকে গেল। আবার সেই শব্দটা হচ্ছে, যেটা শুনে একটু আগে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে চাপা গলার আওয়াজ। কেউ ডাকছে আমাকে।

সিলিঙের লিড সামান্য সরাতেই দেখলাম নীচে বিহু দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ ওপরের দিকে তোলা। কেমন একটা আতঙ্ক মিশে আছে ওর সারা মুখে। হাতে একটা মাঝারি সাইজের বেতের লাঠি। সেটা দিয়েই সে সিলিঙে আওয়াজ করছিল এতক্ষণ। খুব সন্তর্পণে। যাতে আশেপাশের ঘরের মেয়েরা টের না পায়। হাতের ইশারায় আমাকে নেমে আসতে বলল। আমি দুহাতে সিলিঙের দুপাশ আঁকড়ে ধরে লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ে লাফিয়ে নামলাম মেঝের উপর।

বিহু বলল, ‘এই দু পিস পাউরুটি খেয়ে নাও। আর একমুঠো ভাজা চিড়ে আছে। খেয়ে নাও। মিঙ্কা বাইরে পাহারা দিচ্ছে। পুলিশের উপর নজর রাখছে। তুমি খেয়ে নিয়ে ওর সঙ্গে চলে যাও। সাবধানে যেও। পুলিশ দেখলে মাথা গরম কোরো না। মেশিন টেশিন চালিয়ে দিও না। দিলে ওরা তোমাকে স্পটেই ঝাঁঝরা করে দেবে।’

ততক্ষণে আমার খাওয়া হয়ে গেছে। বিহু এক গ্লাস জল এনে দিয়ে বলল, ‘এটা এক চুমুকে খেয়ে নাও। তারপর মিঙ্কা যেভাবে বলবে সেভাবে সেই রাস্তায় খুব সাবধানে চলে যাবে। ও তোমাকে একজনের বাড়িতে পৌঁছে দেবে। সেখানে কদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকো। তারপর এলাকার ভাবগতিক দেখে যেখানে যাবার সেখানে চলে যেও। আমি দুদিন বাদে তোমার সঙ্গে দেখা করব গিয়ে।’

তারপর একটু থেমে মেখলার ভিতর থেকে দুটো কুড়ি টাকার নোট আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘ এটা রাখো। তোমার কাজে লাগবে। পকেটে তো সম্বল বলতে ওই পাঁচ টাকা। আমার কাছে এই মুহূর্তে তোমাকে দেবার মতো আর কিছু নেই। দুপুরের পর থেকে আজ সারাদিন ঘরে কোনও কাস্টমার আসেনি।’

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম ওর কথা। আমার জন্যই আজ ওর এত হেনস্থা হলো। ইচ্ছে করলেই তো পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে পারত আমাকে। তা না করে এত বড় ঝুঁকি নিয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো ওকে একটা প্রণাম করি। কিংবা দুহাতে জড়িয়ে ধরে একটু কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু এসব নাটকীয়তা আমার ঠিক পছন্দ নয়। তাই শুধু ওর হাত দুটো একবার মুঠোর মধ্যে নিয়ে পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বললাম, ‘চলি’।

বাইরে থেকে শিস দিয়ে কেউ গানের সুর তুললঃ ‘ ও- ও-ও নীলে গগন কি তলেএ-এ-এ ধরতি কা প্যার পলে……

‘সেই সুর শুনে বিহু জানালো, ‘ যাও, রাস্তা পরিষ্কার এখন। মিঙ্কা ডাকছে তোমাকে।’

আমি বাইরে বেরিয়ে গেলাম। সামনে একটা মজবুত চেহারার ছেলে। আমার বয়সীই হবে। কিংবা একটু বড়। গাল ভর্তি ঘন দাড়ি। মুখে পান। হাতে তামার বালা। গলায় একটা বাঘনখ ঝোলানো। আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে বাড়ির পিছন দিকের একটা রাস্তা ধরে আকন্দ আর ফণীমনসার ঝোপঝাড় পার হয়ে একটা ফাঁকা মাঠে নেমে গেল। চারপাশে শুনশান অন্ধকার। কাছেই কোথাও শেয়াল ডাকছে। মাঠ জুড়ে জোনাকি আর মাথার উপরে কালপুরুষের রহস্যময় আলো-অন্ধকার।

আমি জানতে চাইলাম, ‘ মিঙ্কা, আমরা আসলে যাচ্ছি কোথায়? ‘

মিঙ্কা অন্ধকারে একটু হেসে বলল, ‘ লোকাল থানায় নিশ্চয়ই নয়।… তুমি আমাদের গেস্ট। একবেলার অতিথি। বিহুর কাস্টমার নও তুমি। তোমাকে একটা সেফ জায়গায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার। এই কাজটা না করতে পারলে বিহু আমাকে ছিঁড়ে খাবে। সন্ধে থেকে আমাদের খুব ঝগড়া হয়েছে তোমাকে লুকিয়ে রাখা নিয়ে। আমার আপত্তি ছিল। ফালতু উটকো ঝামেলা কে চায় বলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিহুর কথাই মেনে নিলাম। তুমি তো কাস্টমার নও। কাস্টমার হলে ও নিজেই বেচাল দেখলে লাথি মেরে ভাগিয়ে দিত। কিন্তু তুমি ওর অতিথি।… জানো, ওর মনটা খুব নরম আর সৎ। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আজ ছ বছর ওর সঙ্গে আছি। কখনও বেচাল করিনি। অন্য কোনও মেয়েছেলের কথা ভাবিনি। বিহু একাই একশ আট জন মেয়ের সমান।’

বাব্বা! এত কথা জানে মিঙ্কা! এত ভালোবাসে বিহুকে? কী একটা ফসলের মাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে আমি জানতে চাইলাম, ‘ তোমরা বিয়ে করেছ?’

মিঙ্কা বলল, ‘ দুটো মন্ত্র পড়ে সাতবার চক্কর কেটে বিয়ে করাটাই কি সব? আমরা কামাখ্যামন্দিরে দাঁড়িয়ে ছ বছর আগে শপথ নিয়েছিলাম, কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না কোনওদিন। রোগে, অসুখে, দুর্দিনে, ঝড়- বাদলে হাতে হাত চেপে একসঙ্গে থাকব।… সেই থেকে সঙ্গেই আছি। লোকে আমাকে বেশ্যার দালাল বলে। নোংরা মেয়েছেলের ভাতার বলে। কিন্তু আমরা তো জানি আমরা একে অপরের কাছে কতটা কী।’

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই আমি আচমকা জিজ্ঞেস করলাম ঃ ‘তুমি গাঁজা সেল করো?’

মিঙ্কা একটুও বিচলিত না হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ করি, তোমার কাছে লুকোব না। গাঁজার কাস্টমাররা এলে আমরা দুটো পয়সার মুখ দেখি। তার থেকে পুলিশকে হিসসা দিতে হয়। বাড়িওয়ালি মাসিকেও ভাগ দিতে হয়।…. সবসময় তো আর বিহুর কাছে হাত পাততে পারি না। তাছাড়া এ লাইনের মেয়েদের হাজার অসুখ বিসুখ আছে। তার চিকিৎসার জন্যও হাতে কিছু ক্যাশ টাকা রাখা দরকার। কত লোক কত রোগ নিয়ে আসে এ পাড়ায়। বিশ মিনিটের জন্য ফুর্তি করতে এসে মেয়েদের শরীরে বিশ হাজার রোগের পোকা মাকড় ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায় ওরা। কিছু করার নেই। যে লাইনের যা চরিত্র।’

কথা বলতে বলতে আমরা একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। অনেকগুলো খুঁটির উপরে একটা কাঠের বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না ভেতরে লোকজন আছে কিনা।

মিঙ্কা কী একটা নাম ধ’রে ডাকল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটি তরুণ বয়সী ছেলে বেরিয়ে এলো। মিঙ্কা স্থানীয় ভাষায় কিছু বলল ছেলেটিকে। একটু পরেই ছেলেটি আমাকে ঘরের ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল। মিঙ্কা আমার হাত ছুঁয়ে যাবার আগে বলে গেল, ‘ভয়ের কিছু নেই। রুমন খুব বিশ্বস্ত ছেলে। কদিন এখানে থাকো। তারপর সুবিধে মতো তোমার যেখানে যাবার সেখানে চলে যেও। আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখব।’

রুমন নামের ছেলেটি বেশ বলবান। কালো আর বলিষ্ঠ গড়ন। সে কারো উদ্দেশ্যে চেনা ভাষার অচেনা উচ্চারণে কিছু বলে পাশের ঘরে চলে গেল।এ ঘরে একজন বৃদ্ধ ছেঁড়া মশারির ফাঁক দিয়ে আমাকে একবার দেখে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। মলিন হ্যারিকেনের আলোয় এক বৃদ্ধা জানতে চাইল, ‘নাম কী তোর?’

এ অঞ্চলে এই প্রথম কেউ আমার নাম জানতে চাইল। কালি পড়া চিমনির ম্লান আলোয় মনে হলো বৃদ্ধাটি বেশ ফর্সা আর আন্তরিক। আমি তাকে আমার অনেকগুলো নামের মধ্যে আসল নামটাই বললাম। কী জানি কেন, শেষ রাত্তিরের এই নিভন্ত আলোয় এক সম্পূর্ণ অচেনা বৃদ্ধাকে আমার খুব সত্যি কথা বলতে ইচ্ছে করল। বৃদ্ধা আমাকে নাম ধরে ডেকে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তে বলল। নিজের মাথার বালিশটা আমাকে দিয়ে বলল, ‘ শুয়ে পড়। রাত শেষ হতে অনেকটা সময় বাকি এখনও। কাল সকালে তোর গল্প শুনব।’

ঘুম আসছিল না। সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ছায়াছবির মতো একে একে মনে ভেসে আসছে। মনে পড়ছে বিহুর কথা। মিঙ্কার কথা। দূর থেকে ভেসে আসছে লাতেহারের আদিবাসী বস্তিতে দেখা সেই দম্পতির কথা। তাদের সেই অলৌকিক সুরে বাঁশি বাজানো প্রতিবন্ধী ছেলেটির কথা, যে সারাদিন টিলার উপরে শুয়ে ভেড়া চরাতো আর মায়াবী সুর তুলত বাঁশিতে। বস্তিতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে দেখলে যে বাঁশিতে বেসুর বাজিয়ে আমাকে আগেভাগে সতর্ক করে দিত।

বিহার পুলিশ একদিন তার সুরের রহস্য টের পেয়ে গুলি করে মেরে ফেলে তাকে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত আমার প্রবল জ্বরের সময় যে আদিবাসী বউটি সকাল বিকেল আমার মাথায় জলপটি দিত, তাকে শুধু আমার খোঁজ না দেবার অপরাধে শাল-মহুয়ার জঙ্গলে দিন দুপুরে রেপ করেছিল এক আধা অফিসার। কোয়েলের জলে স্নান করে বস্তিতে ফেরার পথে ওই ধর্ষণ-শেষের দৃশ্য দেখে আমার মাথার ঠিক ছিল না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক গাদা রাইফেলধারী পুলিশের সামনে ওই আধা অফিসারকে একটা সামান্য দেশি পিস্তল দিয়ে গুলি করেছিলাম আমি। অফিসারটি তখন ইউনিফর্মের বোতাম লাগাচ্ছিল। আর মেয়েটির স্বামী বাঁধা ছিল একটা অর্জুন গাছের গুঁড়িতে। সেইসব স্মৃতি এসে চাকভাঙা মৌমাছির মতো ঘিরে ফেলে আমাকে।

সকাল হওয়ার আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে হয়। বৃদ্ধার ডাকে ঘুম ভাঙল। বাড়ির সবাই তখন উঠে গেছে। যে যার কাজে ব্যস্ত। বৃদ্ধটি গৃহ-সংলগ্ন বাগানে সবজির পরিচর্যা করছে। বৃদ্ধা আমাকে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে ভুট্টাপোড়া আর আখের গুড় খেয়ে নিতে ব’লে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটি কম বয়সী মেয়েকে দেখলাম বৃদ্ধাকে সাহায্য করছে ঘরের কাজে। কাল রাতে একে দেখিনি। সম্ভবত রুমনের বালিকাবধূ।

ঠিক সাতাশ দিন ছিলাম ওই বাড়িতে। দিনের বেলা ঘরের ভিতরেই বসে থাকতাম। ভোর রাত্তিরে মাঠে গিয়ে সেই যে ঘরে ঢুকতাম তারপর থেকে সন্ধে অবধি চোরের মতো ঘরেই লুকিয়ে থাকতাম। পাছে কেউ এ এলাকায় একজন অচেনা আগন্তুককে দেখে কৌতূহলী হয়। মাঝে দুদিন সন্ধ্যায় বিহু এসে খোঁজখবর নিয়ে গেছে আমার। তখন জেনেছি এ বাড়ির বালিকাবধূটি বিহুর সৎ বোন। এরা সবাই জানে বিহু এখান থেকে বেশ কিছু দূরে একটা কাপড়ের কারখানায় কাজ করে। সেই কাজে ছুটিছাটা কম। তাই বাড়ি যেতে পারে না নিয়মিত।

দুদিনই ফেরার সময় বোনকে বলে গেল সে, ‘অতিথিকে দেখিস। ঠিকমতো খেতে দিস। আর নজর রাখিস যেন পালিয়ে না যায়।’

বলেই কী এক রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে একবার দেখে নিয়ে টংঘর থেকে নীচের মাঠে নেমে যায় সে। আমি কাঠের বারান্দায় বসে দূর থেকে তার চলে যাওয়া দেখি।

একদিন রাতে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি যথারীতি সেই রাতেও বৃদ্ধার একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অন্যপাশে বৃদ্ধটি ঘুমিয়ে ছিল। রাত তখন কতো বোঝার উপায় নেই। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে সমবেতস্বরে। সেই ডাক শুনে বাড়ির পিছনের মুরগির বাসা থেকে রাজকীয় চেহারার মোরগটি অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে চুপ করে গেল। হঠাৎ মনে হলো গোটা টংঘরটা দুলছে। কাঁপছে। যেন কেউ নির্দিষ্ট মাত্রায় আর নিয়মিত শক্তিতে কাঠের পলকা ঘরটিকে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। শুনেছিলাম অসম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ভয়ে আচমকা উঠে বসলাম বিছানায়। কম্পনের রহস্য বোঝার চেষ্টায় মশারির একদিক তুলে বাইরে বেরোতে যাচ্ছি, ঠিক সেই সময় বৃদ্ধা ডান হাতে আমাকে টেনে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, ‘চুপ করক। শুই পড়ক। তেওলোকে মানুহ বনায়।’

বৃদ্ধার কথার মর্মার্থ বুঝতে না পেরেও আমি কাঠের পুতুলের মতো তার পাশে শুয়ে রইলাম। আরও কিছুক্ষণ পর সেই রোমহর্ষক কম্পন বন্ধ হলো। এতক্ষণে আমার মনে হলো ঝাঁকুনিটা আসছিল পাশের ঘর থেকে। সে ঘরে রুমন আর তার বালিকাবধূ রাত্রিবাস করে। ওদের বিয়ে হয়েছে গত ফাল্গুনে। সবে কয়েকমাস হলো। এবার আমার কাছে স্পষ্ট হলো নবদম্পতির মানুষ বানানোর রহস্য। আর ওই রহস্যময় নৈশ শব্দের উৎস। বৃদ্ধা এই শব্দ শুনতে অভ্যস্ত। তিনি হয়ত রোজ রাতে প্রত্যাশা করেন, তাঁর ভাঙা ঘরে চাঁদের আলোর মতো এক ফুটফুটে রাজপুত্র বা রাজকন্যা জন্মাবে। ওই রহস্যময় শব্দের মধ্যে তিনি যেন দেবদূতের পদধ্বনি শুনতে পান। তাঁর কাছে নবদম্পতির এই সঙ্গম যেন একটা ধ্যান। সৃষ্টিকর্মের সেই বোধনে বিঘ্ন ঘটানো এক গুরুতর পাপ। তাই আমার মতো আনাড়ি অনভিজ্ঞকে মৃদু তিরস্কার করে সচেতন করে দিলেন তিনি।

সকালবেলা মেয়েটি আমাকে ছোলা সেদ্ধ আর মুরগির ডিম ভাজা দিতে এলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাড়ির জন্য মন কেমন করে না? বাবা মা ভাই বোনদের জন্য?’

সে একটু হেসে বলল, ‘এটাই তো আমার ঘর। ওই তো আমার বুড়ো বাবা বাগানে কাজ করছে। ওই তো মা ধুনুচিতে চাল ধুচ্ছে।’

সকালবেলা একটি বাচ্চা মেয়ের মুখে এমন অপ্রত্যাশিত সুন্দর উত্তর শুনে মনটা কেমন যেন প্রসন্ন হয়ে গেল। সকালের আলোয় ভরে উঠল এই দরিদ্র টংঘর।

একদিন দুপুরে মিঙ্কার এনে দেওয়া পকেট রেডিওতে খবর শুনছিলাম। বরানগরে পুলিশ সাজানো এনকাউন্টারে এগারোজনকে মেরে ফেলেছে। চারু মজুমদারকে ওরা কুকুরের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে। সত্যনারায়ণ সিংকে গ্রেপ্তার করেছে আসানসোলের পুলিশ…

হঠাৎ বৃদ্ধার চিৎকারে তাকিয়ে দেখি রুমনের বউ বাইরের দিঘি থেকে স্নান ক’রে ভেজা শাড়ি নিয়ে ঘরে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে। তার আর্তনাদ আর বৃদ্ধার চিৎকারে রেডিও বন্ধ করে ছুটে গেলাম। মেয়েটি টংঘরের মেঝে থেকে চার ফুট নীচে পাথরের স্তূপের মধ্যে পড়ে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার ভেজা শাড়ি। রুমন বাগানের একপাশে কুড়ুল দিয়ে কাঠের গুঁড়ি কাটছিল। সেও ছুটে আসে। সবাই খুব দিশাহারা। বউটি জ্ঞান হারিয়েছে। রুমনকে বললাম, ‘এখানে হসপিটাল কোথায়? আর একটুও দেরি করা যাবে না। একখুনি নিয়ে চলো। আমিও সঙ্গে যাচ্ছি।’

কোনও যান বাহন নেই আশেপাশে। অগত্যা রুমন তার বালিকাবধূকে কোলে তুলে নিয়ে দুহাতে বুকে আঁকড়ে ধরে মাঠ-ঘাট বন-বাদাড় পেরিয়ে দিশাহারা উন্মত্তের মতো ছুটতে শুরু করল। পিছনে পিছনে আমিও।

হাসপাতাল বলতে একটা ছোটো বাড়ি। একজন মাত্র ডাক্তার আর একজন কম্পাউন্ডার। তবে বেশ পরিচ্ছন্ন সবকিছু। রুমনের বউ কঙ্কাকে ভেতরে নিয়ে গেল দুজন নার্স। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আমরা খুব সংক্ষেপে বিষয়টি জানালাম। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করে ভিতরে গেলেন। রুমন আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে যে কী অস্থিরতা আর উদবেগ! রুমনের মতো শক্ত সমর্থ যুবকও খুব ভেঙে পড়েছে। বারবার করে আমার হাত চেপে ধরে বলছে, ‘কঙ্কা বাঁচবে তো বন্ধু?’

প্রায় এক ঘন্টা পরে ডাক্তারবাবু ভিতর থেকে বাইরে এসে জানালেন, ‘পেশেন্টের অবস্থা ভালো নয়। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। মাথায় চোট লেগেছে। তাছাড়া ও প্রেগন্যান্ট ছিল। মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। ইমিডিয়েটলি ব্লাড লাগবে। ব্যবস্থা করুন। বি নেগেটিভ গ্রুপ।’

আমি কিংবা রুমন কেউ জানি না আমাদের রক্তের গোত্র কী? সন্ধের একটু আগে কীভাবে যেন খবর পেয়ে ছুটে এসেছে বিহু আর মিঙ্কা। তারাও জানে না তাদের রক্তের চরিত্র কী? কম্পাউন্ডার এসে আমাদের চারজনের রক্তের নমুনা নিয়ে গেল যাচাইয়ের জন্য। সেই মুহূর্তে আমরা চারজনেই হয়ত মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, আমাদের রক্তের গোত্র হোক বি নেগেটিভ। বেঁচে উঠুক মেয়েটি।

আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে কম্পাউন্ডার এসে আমার নাম ধরে ডাকলেন। এক আশ্চর্য উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়ে উঠলাম আমি। বিহু উঠে এসে আকস্মিক আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার বোনটাকে বাঁচাও তুমি।’

এর পর রুমন আর মিঙ্কা এসেও আমার হাত চেপে ধরল। রুমন বলল, ‘বাঁচাও বন্ধু। আমার বউটাকে ফিরিয়ে দাও তুমি।’

মিঙ্কা বলল, ‘তুমি অতিথি নও। তুমি আমাদের না চাইতে হঠাৎ দেখা পাওয়া ঈশ্বর।’

ওদের তিনজনকে বাইরে বসিয়ে রেখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মতো বৃদ্ধ কম্পাউন্ডারকে অনুসরণ করে ভিতরে ঢুকলাম আমি।

সাদা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আমি দেখছিলাম, কীভাবে আমার রক্তে একটু একটু করে ভ’রে উঠছে রক্তের আধারগুলো। এক …দুই…তিন…

আমার তখন মনে মনে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আরও নিন, আরও… যত খুশি নিন। আমাকে একেবারে নিঃশেষ করে দিন। শত্রু হোক আর মিত্র হোক এতকাল শ্রেণিশত্রু খতম করতে গিয়ে আমি শুধু প্রাণ নিয়েছি মানুষের। পথের ধুলোয় ছিটিয়ে দিয়েছি মানুষের মহার্ঘ তাজা রক্ত। মূল্য বুঝিনি প্রাণের সেইসব দুর্মূল্য শোণিতপ্রবাহের। আজ সেইসব রক্তপ্রবাহের নিরর্থক অপচয়ের শোধ নিতে চাই আমি। রাজনৈতিক হত্যার নামে, ওয়ান ইস্টু ওয়ান মৃত্যুর বদলার নামে প্রতিহিংসায় উন্মত্ত আমার শিরা ও ধমনীর রক্তে বেঁচে উঠুক কঙ্কা…. বিহু, মিঙ্কা আর রুমনের মুখে ফুটে উঠুক ব্রহ্মপুত্রের শেষ হাসি।

PrevPreviousভারতবর্ষের আর এক নাম কি হিংসা?
NextThe Art and Science of Healing Since AntiquityNext

3 Responses

  1. Belal Hossain says:
    January 26, 2020 at 11:43 am

    Excellent.
    লেখাটা দারুণ।
    একেবারে মেদবর্জিত, টানটান।

    Reply
  2. বিভাস সাহা says:
    January 27, 2020 at 12:42 am

    অসাধারন,

    Reply
  3. Amit Goswami says:
    January 27, 2020 at 6:19 pm

    Excellent writing

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সম্পর্কিত পোস্ট

মনের অসুখ, শরীরের অসুখ ৩ঃ ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার

January 27, 2021 No Comments

ডাক্তার মধুবন্তী বসু বেশ নামকরা নিউরোলজিস্ট। কলেজের বন্ধুত্বের কারণে তিনি মাঝে মাঝেই পেশেন্ট রেফার করেন ডাক্তার নন্দীর কাছে। সেই সূত্রেই তাঁর কাছে কয়েক মাস হল

বইকুণ্ঠের জার্নালঃ ক্যাসিয়াস ক্লে ও সিস্টার নিবেদিতা

January 27, 2021 No Comments

অর্বাচীন দু’টি নিরীহ প্রশ্ন করি। ক্যাসিয়াস ক্লে আর সিস্টার নিবেদিতার মধ্যে মিল কোথায়? কোথায়ই বা মিলে গেছেন আমাদের মধুকবি আর অম্বরীশ দাস? প্রথমে ক্যাসিয়াস ক্লের

সরকারী ভ্যাকসিন, দরকারী ভ্যাকসিন

January 27, 2021 No Comments

ভ্যাকসিন এল দেশে। বিস্তর উৎকণ্ঠা, আন্দাজ ও ঢাকঢাক-গুড়গুড়ের পর প্লেনে ভেসে, গাড়ীতে চেপে, সাইরেন বাজিয়ে সে ভিভিআইপি এক্কেবারে দেশের এ প্রান্তে- ও প্রান্তে পৌঁছেও গেল।

বিদায় প্রিয়তমা

January 26, 2021 No Comments

ছবিঋণ: অভিজিত সেনগুপ্ত

সার্থক জনম

January 26, 2021 No Comments

সাম্প্রতিক পোস্ট

মনের অসুখ, শরীরের অসুখ ৩ঃ ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার

Dr. Chandrima Naskar January 27, 2021

বইকুণ্ঠের জার্নালঃ ক্যাসিয়াস ক্লে ও সিস্টার নিবেদিতা

Dr. Arunachal Datta Choudhury January 27, 2021

সরকারী ভ্যাকসিন, দরকারী ভ্যাকসিন

Dr. Chinmay Nath January 27, 2021

বিদায় প্রিয়তমা

Dr. Anirban Datta January 26, 2021

সার্থক জনম

Dr. Sumit Banerjee January 26, 2021

An Initiative of Swasthyer Britto society

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

Contact Us

Editorial Committee:
Dr. Punyabrata Gun
Dr. Jayanta Das
Dr. Chinmay Nath
Dr. Indranil Saha
Dr. Aindril Bhowmik
Executive Editor: Piyali Dey Biswas

Address: 

Shramajibi Swasthya Udyog
HA 44, Salt Lake, Sector-3, Kolkata-700097

Leave an audio message

নীচে Justori র মাধ্যমে আমাদের সদস্য হন  – নিজে বলুন আপনার প্রশ্ন, মতামত – সরাসরি উত্তর পান ডাক্তারের কাছ থেকে

Total Visitor

293176
Share on facebook
Share on google
Share on twitter
Share on linkedin

Copyright © 2019 by Doctors’ Dialogue

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।