ভারতবর্ষের আর এক নাম কি হিংসা? নাকি হিংসার আর এক নাম ভারতবর্ষ?
আমি জানি এই প্রসঙ্গ উঠলে সবাই হা রে রে রে করে উঠবে। বলবে নিজের ভাল নিজে বোঝে না। ব্যাটা মহান কবি কালিদাসের মতো যে ডালে বসে আছে সেই ডাল কাটছে। যা হচ্ছে সব ঝুট হ্যায় বলে মেহের আলির মতো অন্যায় সম্বন্ধে মানুষকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বসেছে। মেহের আলিদের অবস্থা ঢিলে সে খবর রাখে না গর্দভ।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি আমি কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়। আমার সবুজ, গেরুয়া, কমলা, হলুদ কোন রং নেই। আমি একজন ছাপোষা সংসারী লোক। বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গে যার ব্লাড প্রেসার ওঠানামা করে।কাজেই আদার ব্যপারী যেমন জাহাজের খবর রাখে না, আমিও তেমন রাজনীতির খবর রাখি না। কিন্তু খবরের কাগজ পড়ি রোজ। প্রথম পাতা জুড়ে যখন নজরে পড়ে রক্তাক্ত ছাত্র ছাত্রীর ছবি তখন বুঝি আসলে কোন সামাজিক মানুষেরই অরাজনৈতিক হওয়া বোধ হয় সম্ভব নয়। সেইভাবে দেখলে আমিও রাজনীতির বাইরে নই।
যে কথা হচ্ছিল। এই যে কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে নেমে আসছে হিংস্র আঘাত এর পিছনে কি মনস্তত্ব কাজ করছে সেইটা বিশ্লেষণ করতে বসেছে এই কালিদাসের উত্তরসূরি।
আমার দেশে আজ একের পর এক হিংসার ঘটনা ঘটে চলেছে। এই হিংসাত্মক আচরণের নেপথ্যে কাজ করছে ঘৃণার মনোভাব। ঘৃণা সামাজিক দিক থেকে যুক্তিযুক্ত হতে পারে । যেমন অন্যায়কে আমি ঘৃণা করি। আবার ঘৃণার কারণ বিভিন্ন কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা হতে পারে। ওরা আলাদা, ওরা নিকৃষ্ট এই বিশ্বাস থেকেই অন্য গোষ্ঠীর মানুষ জনের ওপর ঘৃণা তৈরি হয়। সেই ঘৃণার প্রকাশ ঘটছে বিভিন্ন হিংসাত্মক ঘটনায়।
ভারতবর্ষে এক দল মানুষ অন্য এক গোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে জন সাধারণের মধ্যে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন। সচরাচর সংখ্যলঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যা গরিষ্ঠরা এমন করে থাকেন। অন্যান্য দেশে, যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু, তাঁরা মুসলিমদের হাতে লাঞ্ছিত হলে সেই উদাহরণ তুলে এখানকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনে প্রচন্ড ঘৃণার সঞ্চার করা হচ্ছে। ভাবটা এমন ওরা দাঁত উপড়ে নিলে আমরা চোখ উপড়ে নেব।
এই যে হিংসা আর ঘৃণার রাজনীতি, রাষ্ট্র-স্বীকৃত এই হিংসার নেপথ্যে কি মনস্তত্ত্ব কাজ করে আসলে? অস্তিত্ত্বের সংকটজনিত ভয়। “When one race of persons unconsciously feels fear in response to a different race group—fears that their own level of security, importance, or control is being threatened—they will develop these defensive thoughts and behaviors,” মনোবিজ্ঞানী ড: রেনে কার এমনটাই মনে করেন।
গভীরে তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে নিজের চাহিদা, আকাঙ্খা, কামনা বাসনা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো ডিফেন্স মেকানিজম আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি। সহজ উদাহরণ দিলে বোঝা যায় বিষয়টা। আমার মনে খুব হিংসা আছে। আমি প্রতিবেশিনী বৌদিকে হিংসুটে বলে মনে করি। একে প্রোজেকসন বলা হয়। সামাজিক দিক থেকেও দলগতভাবে এমন ডিফেন্স হামেশাই ব্যবহার হয়। যে দল হিংসা ও ঘৃণায় বিশ্বাসী সে দল প্রতিপক্ষকে ঘৃণা ও হিংসুটে মনে করে। বিশেষত: ধর্মান্ধ মৌলবাদী যে কোন দল এমন বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বৃহত্তর সমাজে, আম জনতার মনে হিংসার বীজ বপন করে। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রাকৃতিক চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে জনমানসে ভয়ের সঞ্চার করে নিজেদের মৌলবাদী ক্ষমতা জিইয়ে রাখতে চায়।
সাধারণ মানুষের দরবারে তাই একটাই আবেদন, হিংসার এই মনস্তত্ত্ব বুঝুন। অযথা এই সব বাজে যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত হবেন না। বাবর কবে রাম মন্দির ভেঙেছিল তার প্রতিশোধ আজ নিতে গিয়ে আমরা আসল উন্নয়নের থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। এ যেন পেট ব্যথা ছিল এক মাস, ব্যথার ওষুধ খাচ্ছি এখন। তার চেয়ে ব্যথা কেন হয়েছিল বুঝে আর যেন অমন ব্যথা না হয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখাটাই সভ্যতার মাপকাঠি।
ভারতবর্ষের জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষার মান উন্নত করতে উদ্যোগী হতে হবে। নাগরিকদের জীবনের সার্বিক উন্নতির দাবীতে, সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই দাবীতে সোচ্চার হতে হবে। তবে যদি ভারতবর্ষের আর এক নাম সভ্যতা হয়ে ওঠে।
ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ লেখা। আলোর দিশা দেখালেন। ধন্যবাদ।
অসাধারণ লেখা