এইট বি-র মোড়ে নরেনদার সাথে দেখা হল। অনেকদিন বাদে। চেহারাটা একটু শুকিয়ে গেছে। তবে চিনতে কোনো অসুবিধে হয়নি। বাস থেকে নেমেই আমায় দেখে বললেন, “দে দে একটা সিগারেট দে। এখন এখানে বাসে সিগারেট খেতে দেয় না আর ওদিকে ইংল্যান্ডে ছাদ খোলা ডাবল ডেকারের দোতলায় চড়তুম স্রেফ ধোঁয়া টানবো বলে। শিকাগোর মেলার মধ্যেও টেনেছি। তা তুই কতক্ষণ?”
সিগারেটটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “চলুন, ভিড় এড়িয়ে একটু সাইড এ যাই। মাস্ক খুলে খেতে হবে তো।” নরেনদা জমিয়ে যতক্ষণে সিগারেট ধরাচ্ছেন, আরেকবার তাকিয়ে দেখলাম। আলাসিঙ্গা-র ড্রেস সেন্সটা খারাপ নয় তবে ক্যাটক্যাটে ওই কমলা রঙের চেয়ে রংটা লাল হলে আরেকটু মানাতো ভালো।
নরেনদা ততক্ষণে লম্বা দুটো টান মেরে বললেন, “আরে যা যা, আমায় এসব মাস্ক ফাস্ক দেখাস না। সেই সে’বার যখন কলকাতায় প্লেগ হল, মুখে কাপড় বেঁধেই তো আমার গুরুভাই, শিষ্যরা তো সব সেবা করতে নেমে গেল ঠিক তোদের এই রেড ভলান্টিয়ারদের মতো।”
কি আর করা যায়, ঘাড় নেড়ে সায় দিতেই হল। দু’টান মেরে সিগারেটটা ফেলে দিয়েই নরেনদা হনহন করে হাঁটতে শুরু করেছেন। বললাম, “আরে আস্তে হাঁটুন, আপনার নাহয় পায়ে হেঁটেই ভারতের অনেকটা ঘোরার অভ্যেস আছে, আমার নেই। আর যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে যাওয়ার তাড়া কিসের।”
একটু রেগে গিয়ে চোখ বড় বড় করে নরেনদা বললেন, “কেন তুই যে বললি, আজ আমার জন্মদিনে ওখানে মানে ওই শ্রমজীবী ক্যান্টিনে স্পেশাল মেনুর ব্যবস্থা করেছিস, তা সেটা কেমন রান্না করেছে, দেখতে হবে না ? আমার নামে অখাদ্য খাইয়ে দেয় যদি।”
বলেই নরেনদা একটা হাত আমার কাঁধে তুলে দিলেন, গলাটা সামান্য ভারী শোনালো, বললেন, “জানিস আমার ভাইটা প্রথমবার ইংল্যান্ডে গিয়ে ও দেশের খাবার কিছুই প্রায় খেতে পারতো না। শেষে নিজেই আলু মরিচের তরকারি রেঁধে খাওয়ালুম, ব্যাটা খেয়ে বলে- অমৃত।” ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে চোখ দুটো সামান্য ছলছল।
কথায় কথায় কিছুটা পথ পেরিয়ে এসেছি। নরেনদা চুপচাপ। আমিও। অনেকক্ষণ মোবাইল চেক করা হয় নি। উসখুস করে বের করিয়ে ফেললাম। ও বাব্বা। ফেবুতে এক গাদা নোটি জমে গেছে। হঠাৎ দেখি নরেনদা গলার স্বরটা নামিয়ে একটু লজ্জা লজ্জা মুখে জানতে চাইলেন, “হ্যাঁ রে যেখানে নিয়ে যাচ্ছিস, সেখানে কি ওই মেয়েটা থাকবে ?”
আমি তো ঝটকা খেয়ে গেলাম। মনে মনে বল্লাম, এসব দোষ তো তোমার কোনো কালে ছিল না গুরু। ৩৯ বছর বয়েসটাকে মিড লাইফ ক্রাইসিসও বলা যায় না। গম্ভীর হয়ে হাবভাব নিয়ে বল্লাম, “কোন মেয়েটার কথা বলছেন ?”
“আরে সেই মেয়েটা রে”, নরেনদা এর উত্তর, “আরে সেই ফায়ার ব্র্যান্ড, দারুন বলে। খুব তেজ, এক্কেবারে মার্গারেটের মতো, ওর সাথে দুটো কথা বলার খুব ইচ্ছে”। এই কেলো করেছে। ফায়ারব্র্যান্ড! তেজ !! সর্বনাশ। হাত থেকে মোবাইলটাই পরে যাচ্ছিল একটু হলেই। উৎকণ্ঠা চেপেই জিজ্ঞেস করলাম, “আরে নামটা বলুন না।” “আরে ওই যে মীনাক্ষী না কি যেন নাম।”
যাক বাবা। আর টেনশন নেই। উদাস ভাবে বল্লাম, “থাকতেও পারে।”, বলেই তাড়া লাগলাম, “চলুন, চলুন। এবার সত্যিই দেরী হয়ে যাচ্ছে, এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেল।”
মানুষটার দূর্বলতা তুলে না ধরে সবল দিকগুলি তুলে ধরলে ভাল হতো। দোষে গুণে যদি মানুষ হন তবে গুণগুলোকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে বৃহত্তর সমাজের কথা ভেবে। মতামত ব্যক্তিগত।