কয়েক মাইল দূরে স্কাই কিসিং পীকে জাপানিদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছে। নর্ম্যান আহত জাপানি সৈন্যদেরও চিকিৎসা করছে।একজন ডাক্তারের কাছে রোগীর জাত একটাই। রোগী। হিন্দু মুসলমান, খৃষ্টান, চীনা, জাপানি ভেদ নেই। সেই গ্রামের একটা বড়ো মাঠে, নাট্যমঞ্চে অপারেশন করছে। আহতরা যাতে অপারেশন দেখতে না পায়, তাই একটা সাদা পর্দা টাঙানো।
একজন এসে বললো “উত্তরের পাহাড়ে একটা সন্দেহজনক গতিবিধি দেখা যাচ্ছে।” একটু পরে বোঝা গেল একটা অজ্ঞাত জনসমষ্টি, চীনের পোষাক পরে’ এগিয়ে আসছে। ইয়ো, একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা, সে বললো “এই অজ্ঞাত জনসমষ্টির পেছনে রয়েছে জাপানের পুরো বাহিনী। এরাও জাপানি যোদ্ধা, চীনা পোষাক পরে’ নামছে।” জাপানি বাহিনীর চকচকে হেলমেট গুলো রোদে ঝলসাচ্ছে। ইয়ো ঝড়ের বেগে অপারেশন টেবিলের কাছে পৌঁছলো। “বিপদঘন্টা বাজাও। জাপানিরা এসে গেছে।আহতদের সঙ্গে নিতে হবে?”
আত্মমগ্ন নর্ম্যান বললো “একটু সময় লাগবে ইয়ো। আরও কতো জনের অপারেশন বাকি, ফং?”
“দশ জনের অপারেশন বাকি।”
“তাহলে যাদের অপারেশন হয়ে গেছে, তাদের এখান থেকে সরিয়ে ফেল। আরও দুটো অপারেশন টেবিল সাজাও।একসঙ্গে তিনজনের অপারেশন হবে।”
“কিন্তু ওদের ইউনিফর্মটাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে”
“আর কতক্ষণ লাগবে আসতে?” নিরুদ্বিগ্ন নর্ম্যান।
“তাড়াতাড়ি এলেও চল্লিশ মিনিট”
“তাহলে, তিরিশ মিনিট সময় আমরা পাচ্ছি। কুলিদের বলো তৈরি থাকতে”
তুং সবাইকে উদ্দেশ করে’বলতে থাকলো “প্রয়োজন হলে আমরা সবাই থাকতে রাজি, মরতেও। কিন্তু পাই এন চু, আপনি আমাদের নেতা, মেডিক্যাল ইউনিটের প্রধান, আমাদের শিক্ষক…..”
“কিছুই এসে যায় না, আমি কি, আমি কে, তাতে। আমি চলে গেলে এই আহতদের কি হবে? সঙ্গে নিয়ে গেলে দেরি হয়ে যাবে….বড্ড দেরি। অপারেশন হবে, তারপর যাবো”
লিন একটা ফোন করলো “বিপক্ষ আর সাত লি (চীনের দূরত্বের মাপ, খুব বেশী হলে চোদ্দো কিলোমিটার) দূরে আছে। আমাদের একটা দল ওদের বাধা দিতে গেছে”
রক্ষী এসে বললো “ওরা প্রায় এসে গেছে আর আমাদের কাছে আছে মাত্র ন’টা বন্দুক”
“ভালোই তো পালাবার সময় যত হালকা থাকা যায়” নির্বিকার নর্ম্যান। কৃষকরক্ষী একজন সাধারণ কৃষক। সে ভয়ে কাঁপছে।
“ধুত্তোর” নর্ম্যান কাতরে উঠলো।
সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকালো।
“তেমন কিছু নয়, ছুরিতে হাতটা একটু কেটে গেছে। বাকিরা সবাই চলে যাও। এই ছেলেটার পা কামানের গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এটা করেই আমি চলে যাবো”।
লিন বললো “আমি আপনার নির্দেশ মানবো না। আপনাকে ছেড়ে আমরা কেউ যাবো না। আমিও অপারেশন করবো। আপনি মাও’কে জানালেও যাবো না”
আহত ছেলেটা বললো “পাই এন চু, আপনি চলে যান। দরকারে আমাকে রেখেই চলে যান। আপনি আমাদের কাছে বড্ড দামি”
বাইরে রাইফেলের শব্দ আর সেই শব্দের দিক লক্ষ্য করে জাপানি মেশিনগানের আওয়াজ। কতক্ষণ অপারেশন চলেছিলো, কেউ জানে না।বঅপারেশন হয়ে গেলে অজ্ঞান ছেলেটাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে সবাই রওয়ানা হলো। নিজের বাদামি ঘোড়ায় ডাক্তার নর্ম্যান বেথুন।
জাপানি সৈন্য গ্রাম দখল করে’ শূন্য অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছলো।
পরের দিন অপারেশন করতে গিয়ে নর্ম্যান দেখলো আঙুলটা ভীষণ ফুলে’ গেছে।
ফং, সেই ডাক্তার ফং, জায়গাটা পরিষ্কার করতে ছুরি ধরলো।কিন্তু কান্নায় তার চোখ অন্ধ।
“কাঁদছো কেন? কিছু হয়নি আমার….” সারাদিন বিকারের মধ্যে কাটালো নর্ম্যান। “গোলাগুলির শব্দ কি শুনতে পাচ্ছো তোমরা?কোথাও কি যুদ্ধ চলছে?”
সবাই দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের প্রিয় পাই এন চু অসুস্থ। নর্ম্যান আবার ঘোরের মধ্যে চলে’ যায়।
“আমি রক্ত দিয়ে ওনাকে ভালো করতে চাই” ফংয়ের কথার কেউ উত্তর দেয় না।
পরের দিন আবার অপারেশন করতে পাহাড় যাত্রা।
“তোমরা কেন এরকম করছো? আমার কিছু হয় নি। শুধু আঙুলটা পেকে গেছে। তোমাদের উচিত আমাকে মেশিনগানের মতো ব্যবহার করা। আমি ঠিক আছি”
রাতে কিছু না খেয়েই যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নর্ম্যান ঘুমিয়ে পড়লো। পরের সকালে আবার যাত্রা। লৌহমানব নর্ম্যান ঘোড়া ছোটালো। জাপানিরা একটা একটা করে সামরিক ঘাঁটি দখল নিচ্ছে। আর আহতের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু নর্ম্যান পারলো না।ওর বাদামি ঘোড়া পিঠে করে’ জ্ঞানহীন নর্ম্যানের দেহটা নিয়ে ওচিয়াঁচুয়াংয়ের সামরিক কেন্দ্রে পৌঁছলো।বপুরো হাতটা কনুই অবধি ফুলে গেছে। বিষিয়ে গেছে।
পরের দিন একজন গেরিলা একটা চিঠি নিয়ে এলো “মাও বলেছেন ওনাকে মূল সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যেতে”।
ইতিমধ্যে জাপানিরা এখানেও চলে আসছে। নর্ম্যান কিছুতেই এখান থেকে চলে যেতে রাজি নয়।
“আমি ভালো হয়ে যাবো, অনেক কাজ বাকি” কিন্তু ফিল্ড কম্যান্ডার চি যখন নিজে এসে চলে যেতে বললেন, তখন নর্ম্যান রাজি হলো।
হোসেই, উত্তর চীন নর্ম্যানের বাদামি ঘোড়া একা একা চলেছে ক্ষুরের আওয়াজ তুলে। পিঠে কেউ নেই। পাহাড়ি রাস্তায়।একটা কাংয়ে শুয়ে আছে একজন অচেতন মানুষ। পাই চু এন-ভিনদেশী। সামনে ইয়েলো স্টোন ভিলেজ। প্রাণচাঞ্চল্যে, শিশুদের কলরবে, কৃষকের ব্যস্ততায় মুখর। বাদামি ঘোড়া দেখে সবাই এগিয়ে এসেছে। জানে এই ঘোড়াটা কার। ওদের সবার চেনা।পাই চু এন, পাই চু এন। এই ঘোড়ার পিঠে উনি ঝড়ের মতো গোটা মুক্তাঞ্চল সফর করেন। কিন্তু গিয়ে এই অচৈতন্য অবস্থায় তাদের পাই চু এনকে দেখতে হবে কেউ ভাবে নি।
ফং নর্ম্যানের নাড়ি ধরে বললো “অনেক সৈন্যের থেকে ওনার অবস্থা খারাপ।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে”
নর্ম্যানের কথাবার্তা ক্রমশঃ অসংলগ্ন হয়ে পড়লো। “আহতরা এসে গেছে ফং? হাত আর পায়ের অপারেশন তুমি করবে ফং। আমি বুক আর পেটের”
এবার ওকে তোলা হলো ইয়েলো স্টোন ভিলেজে জমিদারের বাড়ি। ওটাই সব থেকে ভালো।
“এতো ঠান্ডা কেন তুং” অথচ ফায়ার প্লেসে আগুন, কম্বলে মোড়া নর্ম্যান। “……খুব শীত করছে……তুং”
ফং কাঁদতে থাকে “ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে এই পৃথিবী ভরা মানুষ আর উনি একা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন”
খবর পেয়ে বহু গেরিলা এসে তাদের প্রিয় পাই চু এন’য়ের নামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করলো। পাই চু এন’য়ের জন্য ওরা লড়বে, ওনার জন্যই মরবে। হঠাৎ জানালা দিয়ে সবাই দেখলো পাই চু এন হামাগুড়ি দিয়ে কাং থেকে নেমে টেবিলে গিয়ে কি যেন নিলেন। তারপর আবার গিয়ে শুলেন। ডান হাঁটুর ওপর কাগজ নিয়ে কি যেন লিখছেন
“জেনারেল নিয়ে
আমি ভীষণ অসুস্থ। মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে।….”
তারপর কিছুটা উইলের মতো। ক্যাম্পে কি কি ওষুধ লাগবে তার বিবরণ। তারপর ঐভাবে শুয়েই
শেষ কবিতাটা লিখছেন। কবিতার নাম
“ক্ষত”
জাপানি সৈন্য?নিয়ে এসো। জামাটা কেটে ক্ষতস্থানে সেলাই করো, ওষুধ দাও। ও তো পেশাদার নরঘাতক নয়? হাতগুলো মেহনতি মানুষের। ইউনিফর্মের ভেতরে মানুষটা কৃষক কিম্বা শ্রমিক।ওদের কি চীনাদের মেরে কোনও লাভ হবে?
লাভ হবে মানবজাতির শত্রুদের।
মানবজাতির শত্রুদের দেখতে কেমন? কোনও চিহ্ন আছে? অপরাধী বলে চেনা যায়?
না, বরঞ্চ উল্টো। ওরা নিজেদের ভদ্রলোক বলে চিহ্নিত করে। আমরাও ওদের তাই করি। ওরা সামাজিক আর ব্যক্তগত দয়া দেখায় গরীবদের। কিন্তু ওদের মুনাফা আর টাকাকড়িতে হাত পড়লেই ওরা নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করবে। ওরাই সমাজে ক্ষত সৃষ্টি করে।”
রাত কাটলো। প্রবল ঠান্ডায় তুং সারারাত জানালায় দাঁড়িয়ে। সকালে সবাই এলো সবাইকার প্রাণের পাই চু এন’য়ের খবর নিতে।
তুং বললো “উনি মারা গেছেন”
তবু শেষ কথাটা বলা হয়নি। এটাই শেষ হতে পারে না। ফ্রান্সেসকে লেখা শেষ চিঠিটাই আসল নর্ম্যান–“মাঝে মাঝে আমি দুষ্প্রাপ্য গোরুর রোস্ট,আপেল, আইসক্রিম আর কফির স্বপ্ন দেখি।স্বর্গীয় স্বপ্নের মরীচিকা। বই….বই কি এখনো লেখা হচ্ছে? সংগীত কি এখনো সৃষ্টি হয়? তোমরা কি নাচো, গাও, বিয়ার খাও,ছবি দেখ? নরম বিছানায় পরিষ্কার চাদরের ওপর শুতে কেমন অনুভূতি হয়? মেয়েরা এখনো ভালবাসা পেতে ভালবাসে?…..
বেথ
(ভালো না বাসলে কমিউনিস্ট হওয়া যায় না, তাই নর্ম্যানের জীবনের শেষ কথা হোক ভালবাসা।ক্ষত নয়। কবি নর্ম্যান, শিল্পী নর্ম্যান (সার্জারিও তো একটা শিল্প), প্রেমিক নর্ম্যান অমর রহো)
(”উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতরের কথাগুলো বেশীরভাগই নর্ম্যানের ডায়েরির অংশ।
আহা! বেথুন তারা হয়ে পড়ছেন এ লেখাটি।
আমি লিখতে লিখতে কেঁদেছি আর আপনার মন্তব্য পড়ে’ চোখ ভিজলো।বুড়ো হয়েছি, চোখের জল সামলাতে পারি না।
দারুণ। খুব সুন্দর মর্মস্পর্শী চিত্রায়ণ। এইরকম একজন দরদী মানবপ্রেমিক আমাদের পেশায় ছিলেন ভেবে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে। লাখো সেলাম।
প্রণাম স্যর।আপনারা আমাকে ডাক্তারি শিখিয়েছেন।
অসামান্য !
প্রণতঃ