তিনি ঢুকলেন, থপথপ করে কোনোমতে চেয়ারের দুটো হাতলের মাঝে সেঁধোলেন এবং…. বসলেন। চেম্বারের পলকা কুর্সী লগবগ করতে করতে অবশেষে সিধে হল। কুর্সীই। রাজ সিংহাসন তো নয়, যে ১৪২ কিলো ওজন অবলীলায় সহ্য করবে!
হ্যাঁ, যা ভেবেছেন তাই! ইদানিং আমার সৌভাগ্যক্রমে একজন সুপার হেভিওয়েট রোগী আমাকে দর্শন দিয়েছিলেন! তিনি পুরুষপ্রবর। বয়স ৩৬। সঙ্গী কোমরে এবং হাঁটুতে ব্যথা।
উপবেশন করেই তিনি তাঁর কষ্টের সাতকাহন এবং অভিযোগ বর্ণনা করতে লাগলেন। আর সেসব শুনতে শুনতে আমি ভাবছিলাম অন্য কথা।
চোরের মন যেমন বোঁচকা-র দিকে, তেমনি ডাক্তারের মনও সমসময় রোগীর দিকে থাকে। এই রোগীর যদি অপারেশন লাগে তাহলে কিভাবে অপারেশন টেবিলে একে শোয়ানো হবে! কারণ শুধু ১৪২ কিলোই নয়, সাড়ে ছ ফুটের বেশী লম্বাও বটে।
আমাকে অন্য একজন রোগী বলেছিল, ‘শুধু ওজনটাই দেখছেন স্যার, ওজনের জন্য পরিশ্রমটা দেখছেন না!’
‘ওজনের জন্য পরিশ্রম মানে?’
‘এই যে হাঁটতে, চলতে, খেতে, দৌড়ে বাস ধরতে, আরো অন্যান্য কাজে যা অতিরিক্ত পরিশ্রম হয়, তার কথা বলছি আর কি!’
‘পরিশ্রম করেন কেন ? ওজন কমিয়ে ফেললেই তো হয়!’
‘তাহলে এই ওজনের জোরে অন্য লোকেদের দিয়ে বিভিন্ন কাজ যে সহজে করিয়ে নিই- সেগুলো হবে কি করে? ‘থ্রোইং অফ ওয়েট’ বোঝেন তো, ‘থ্রোইং অফ ওয়েট?’
রোগীর ওজনের কারণে একবার হাত ভেঙে যেতে বসেছিল আমার। ব্রিসবেনের হাসপাতালে এক প্রচন্ড স্থুলকায় রোগীনীর বাঁকা মেরুদন্ডে অপারেশন করতে হবে। পিছন থেকে। ওজন প্রায় ১৫০ কিলো।
অ্যানাস্থেসিয়ার পরে তাকে অপারেশন টেবিলে উপুড় করে শোয়াতে হবে। আমার বস উইলিয়ামস আমাকে বলল, ‘তুমি ওদিকে যেও না। সারা আর ইউজিন আছে। ওরা যা করার করে দেবে।’
উলিয়ামস সার্জেনস’ রুমে বসে চুরুট টানছে আর টেলিফোনে খান্ডারনী বৌয়ের গালাগালি শুনছে। তখনকার দিনে হাসপাতালে ধূমপান করা যেত।
সারা অপারেশন থিয়েটার নার্স। পলিনেশিয়ান মেয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আদি অধিবাসীদের বিরাট চেহারা, মুখ বড় এবং চৌকো, গোধূম গাত্রবর্ণ, চুল শক্তপোক্ত ও কালো হয়। এদের অনেককেই অষ্ট্রেলিয়াতেও দেখতে পাওয়া যায়।
সারার চুল কালো, চৌকো মুখ। আমার চেয়ে প্রায় দেড়গুণ লম্বা। এবং সেইমত দৈত্যাকার চেহারা।
আমি তাকে বললাম, ‘তুমি ছেড়ে দাও। আমি পেশেন্ট পজিশন করে দিচ্ছি।’
ইউজিন-ও বলল যে, ‘ঠিক আছে। হয়ে যাবে।’
ইউজিন আইরিশ ছেলে। টেকো, হাট্টাগোট্টা চেহারা হলে কি হবে, হাইট বেশী না।
দুজনে মিলে পাকামো করতে গিয়ে আমার ডান হাত গেল পেশেন্টের দশাসই চেহারার তলায় আটকে। আমি তখন যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছি।
সারা এসে অনেক টানাহেঁচড়া করে পেশেন্ট আর টেবিলের মাঝ থেকে আমাকে আস্ত উদ্ধার করলে কি হবে, আমার ডান হাতের কব্জি গেল মচকে। তিন দিন হাত নাড়াতে পারি নি তারপর। উইলিয়ামস আমার উপর রেগে গিয়ে বলল, ‘বারণ করেছিলাম! রোগী যদি তোমার উপর পড়ত, তুমি তো চাপা পড়ে মরে যেতে!’
যাই হোক, আমার আজকের রোগীর বিষয়ে ফিরে আসি। অপারেশনের প্রয়োজন হলে একে কি করে অজ্ঞান করা হবে এবং অজ্ঞান যদি করাও যায়- তার পরে ১৪২ কিলো গ্যালিভারকে কি করে অপারেশন টেবিলে উপুড় করে শোয়ানো হবে- এসব ভেবে আমার মত অ্যাভারেজ লিলিপুটের ঘুম উড়ে গেল। এখানে তো দৈত্যাকায় সারা বা উইলিয়ামস নেই!
আমার এক্সামিনেশন কৌচে যথারীতি তিনি ধরলেন না। তবে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং এক্সরে, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদির পরে জানা গেল তাঁর হাঁটু ব্যথার কারণ অষ্টিওআর্থ্রাইটিস এবং কোমর ব্যথার কারণ স্পন্ডাইলোসিস। তবে তা থেকে নার্ভে চাপ পড়া সংক্রান্ত কোনো জটিলতা নেই। হার্ট, কিডনি, হরমোন ঘটিত কোনো অস্বাভাবিকতাও তাঁর নেই।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। সার্জারির সম্ভবত প্রয়োজন হবে না। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা কি এবং কিভাবে চলতে হবে এইসব বোঝাতে চেষ্টা করছি। আর রোগী জানতে চাইছেন, তার এরকম কেন হল। যেই বললাম, তার হাঁটু ও কোমরের এই অবস্থার জন্য দায়ী তার ওজন- ওমনি ওই ১৪২ কিলো ওজন নিয়ে মিষ্টার গ্যালিভার কুর্সি থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চেম্বার কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওজন, ওজন, ওজন। আপনারা ডাক্তাররা রোগ সারাতে না পেরে শুধু ওজনের অজুহাত দেন। আর কোনো চিকিৎসা নেই?’
এই পর্যন্ত বলে আমাকে উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়েই ব্যাগ হাতড়ে চারজন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। পড়ে দেখলাম তার প্রত্যেকটায় অন্যান্য চিকিৎসার সাথে ওজন কমানোর পরামর্শ দেওয়া আছে। একজন ডাক্তার তো রোগী কি কি খাবেন না খাবেন- তাও বিস্তারিত বিবরণসহ লিখে দিয়েছেন!
সেই প্রেসক্রিপশনটা আমার চোখের সামনে তুলে ধরে রোগী কন্ঠ উচ্চগ্রামে তুলে বললেন, ‘রোগ সারাতে পারে না, আর পেশেন্ট কি খাবে না খাবে তাই নিয়ে জ্ঞান দেয়! অপদার্থ সব। এইটুকু তো ছোট্ট জীবন- সব কিছু খাবো আমি। তারপর যা হয় হবে। ’
এই বলে, আমার ছোট্ট চেম্বারটা পদ্মবনে মত্ত হাতি-র মত দলিত মথিত করে তিনি বিদায় নিলেন।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।