কালের বিচারে পাঁচ মাস খুবই কম। কিন্তু পাঁচ মাস যদি এক দম্পতিকে তাঁদের সন্তানদের মৃত্যুর পর অপেক্ষা করতে হয় প্রকৃত অপরাধীর সন্ধানের জন্য, সঠিক বিচারের জন্য, তখন? তখন মনে হয় কবে কাটবে এই ঘোর তমসা। সময় সত্যিই আপেক্ষিক।
আমরা সকলেই জানি বিগত ৯ আগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে আমাদের এক সহকর্মীর নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে গেছে। এটা ভেবে নেওয়ার কোন কারণ নেই যে এই ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন ‘ছোট্ট’ ঘটনা। বরং এই ঘটনাটি, কেবলমাত্র আজ জি কর হাসপাতালে নয়, বিগত এক দশকের উপর পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ধরনের সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর ঘটে চলা থ্রেট কালচারের, ভয়ের অপসংস্কৃতির একটি উদাহরণ মাত্র। যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই ভয়ের অপসংস্কৃতি, ভয় দেখানোর অপসংস্কৃতি, কেবলমাত্র চিকিৎসকদের উপর যে চলে তা নয়, চলে সমস্ত ধরনের চিকিৎসক-শিক্ষক, চিকিৎসক, চিকিৎসক ছাত্র, নার্স, রোগী সহায়ক কর্মী সকলের উপরেই। এই অপসংস্কৃতি হাসপাতালের সীমানা ছাড়িয়ে এই রাজ্যের সমস্ত ধরনের সরকারী বেসরকারী কর্মক্ষেত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। কর্মক্ষেত্রের বাইরেও আপনাকে আমাকে সর্বত্রই এই ভয় দেখানো হয়। পাড়াতে, রাস্তায় ঘাটে, মাঠে ময়দানে। কথা বলতে, এমনকি চিন্তা ভাবনা করলেও ভয় দেখানো হচ্ছে। মত প্রকাশের ক্ষমতা ক্রমশঃ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। বিরূদ্ধ মত প্রকাশকে অপরাধ বলে পরিগণিত করা হচ্ছে। প্রত্যেকেই, প্রতি মূহুর্তে ভয়ের আবহে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই নৃশংস ধর্ষণ ও খুন কেন সমস্ত সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক, ছাত্র, বিভিন্ন পেশার মানুষকে রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছিল? কারণ এই ভয়ের অপসংস্কৃতি মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। মানুষের মনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ প্রকাশের একটা উপলক্ষ্যের প্রয়োজন ছিল মাত্র। মানুষ তার অসন্তোষ, ক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ দেখিয়েছে। আন্দোলনে নেমেছে পথে। তাই এই সতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদ আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এ এক জণজাগরণ।
অভয়ার নৃশংস খুন-ধর্ষণের পর, বিগত পাঁচ মাস, আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। আন্দোলনের উপর সরকারের ধেয়ে আসা ক্রমাগত বাধা অতিক্রম করে চলতে হয়েছে আমাদের। আন্দোলন তো খুনী ধর্ষকদের বিরুদ্ধে। সরকার কেন বাধা দিয়েছে? প্রশ্ন জেগেছে আমাদের মনে। সরকারের কি তাহলে কোন পক্ষ আছে? সরকার কি তবে নিরপেক্ষ নয়? সরকার কাজেকর্মে আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে, তারা অপরাধীদের আশ্রয় দিচ্ছে। প্রসাশন আমাদের বাধ্য করেছে পথে নামতে। বিভিন্ন সংগঠনকে হাতে হাত ধরে চলতে। এক সাথে জোট বাঁধতে। চিকিৎসকদের বাইরেও বিশাল এই সমাজ আজ এক সাথে জোট বেঁধেছে। তৈরী হয়েছে অভয়া মঞ্চ। প্রতিজ্ঞা করেছে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার।
থামলে চলবে না। থামলেই বিপদ। সরকার আশ্রিত শয়তানরা পরের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছে। সেই লক্ষ্য আপনার বাড়ির কোন মহিলা হতে পারে বা আমার। আমরা জানি না পরের লক্ষ্য কে। সরকার ওদের ভরসা। বেঁচে যাবে। তাই ওরা ভয় দেখাবে। খুন করবে। ধর্ষণ করবে। ধর্ষণ করবে, কারণ ধর্ষণ করলে সরকারের এই খুন তখন ধর্ষণ বলে পরিগণিত করা হবে। স্টেট স্পনসর্ড খুন তখন ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত ধর্ষণ বলে চিহ্নিত করা যাবে। সরকার তখন আপনাকে সমবেদনা জানাবার ছলে, আপনার কানে কানে বলবে, সরে আসুন। আন্দোলন করবেন না। টাকা পাবেন। নয়তো পরিবারের অন্য কেউ, আবার। সরকার ভয় দেখাবে।
রাস্তায় থাকবেন না ঘরে, আপনি ঠিক করবেন।
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবেন না নিজের শিঁরদাড়া, আপনি ঠিক করবেন।
দুর্বৃত্তদের পক্ষে থাকবেন না বিপক্ষে, আপনি ঠিক করবেন।
আমরা পথে ছিলাম। আছি। থাকবো।
বেরসিক