বাবলাতলা স্টপেজে টুপ করে বাস থেকে নেমে পড়ল শিবু। তিন দিন একটানা ডিউটি পেয়েছিল। আগামীকাল থেকে ডিউটি ধরবে রবিউল। তার হাতে ব্যাগ আর টিকিটের বান্ডিল বুঝিয়ে দিয়ে নিজের ছোট্ট ঝুলিটা নিয়ে সে প্রায় চলন্ত বাস থেকে এক লাফে নিচে রাস্তায় নেমে এল। রবিউল চিৎকার করে বলল,- শনিবার তুমি উঠো শিবুদা ।
– ঠিক আছে।
পকেটে ছোট নোকিয়া মোবাইলটা আছে তবে সেটাতে চার্জ নেই। শিবু চেষ্টা করে দেখেছিল, কিন্তু কাজ হয়নি । কিছু সমস্যা হচ্ছিল চার্জিংয়ে। সেজন্যে দিন দুই বাড়ির সাথে যোগাযোগ করা যায়নি।
অল্প কিছুটা যাওয়ার পর শিবু মাটির রাস্তায় নেমে পড়ল পিচের রাস্তা ছেড়ে। অনেকটা হেঁটে যেতে হবে তাকে। তবে আজন্ম চেনা রাস্তা। তাই আঁধার হয়ে এলেও চলতে অসুবিধা নেই। আর সারাদিন বাসে বাসে লাগাতার ছোটাছুটি আর হাঁকাহাঁকি করার শেষে এই পায়ে হাঁটা নিরিবিলি পথে কিম্বা কাজের দিনগুলোতে ডিউটির শেষে ইছামতির ঘাটে আধো-অন্ধকারে বসে থাকতে বেশ লাগে শিবুর। প্রথম ট্রিপ ধরলে পাঁচটায় গাড়ি ছাড়ে, আর শেষ ট্রিপের হিসেব পত্র নিকেশ করে থিতু হতে রাত এগারোটা হয়ে যায়।
সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে কারণ তার বাস যে রুটে চলে সেই রাস্তার কুড়ি কিলোমিটার দূরত্বের দুই প্রান্তেই দুটি নদী আছে। আসলে একটিই নদী, আর সেই নদীটির পাশ বরাবর এই পিচের বাস রাস্তা।
একপ্রান্তে নদী পেরোলে মহকুমা শহর আর অন্যদিকে আর একটা ফেরি ঘাটের ওপারে কম গুরুত্বপূর্ণ জনপদ।
আঁধার হয়ে গেলেও চলতে কোন অসুবিধা নেই । এবড়ো খেবড়ো মাটির অমসৃণ আঁকাবাঁকা রাস্তা। কখনও কোন বাড়ির আনাচ কানাচ বা কখনও বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে সরু পথ।
আজ হাটবার তাই দুই একজন সাইকেল নিয়ে হাট থেকে ফিরছে। তারা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শিবু পরিচিত অনেকের কাছে। সে বাসে কন্ডাক্টরি করে আর তাই অনেকের কাছেই শিবু বেশ কাছের লোক।
কমল নামের ছেলেটা সাইকেলে যাচ্ছিল, ঘন্টি বাজিয়ে বলল,- কেমন আছো, শিবুদা? অনেকদিন দেখিনে ।
শিবু হেসে বলল,- ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? আমার কাজটা এ হপ্তায় করে দিও গো। মাচানটা না’লে পড়ে যাবে।
তার বউ দুর্গা একটা শাড়ি আনতে বলেছিল। মহকুমা শহরের প্রান্তে এপারে বাস ঘুমটির কাছে একটা ছোটখাটো জামাকাপড়ের দোকান আছে। আর সেখানে ধার বাকিও দেয়। ছেলের একটা জামা-প্যান্ট আর বউয়ের একটা ছাপা শাড়ি নিয়েছে গতকাল। ব্যাগে হাত বুলিয়ে দেখে নিল ঠিক আছে কি না!
বাচ্চাটা তার ভারি মিষ্টি। সবে কথা বলতে শিখেছে। তাকে দেখলে ঝাঁপিয়ে তার কোলে চলে আসে। ঠাকমাকে, আম্মা আম্মা বলে।
দুর্গা বলে,- তোমাকে তো পায় না,তাই দেখো তোমাকে আর ছাড়তে চায় না।
– আর তুই যে ওকে এতো কষ্ট করে মানুষ করিস!
– সে তো সব মা-ই করে।
দুর্গা ভারি নরম স্বভাবের মেয়ে। শিবু একটু পা চালিয়ে চলল। বউ আর ছেলের কথা মনে পড়তে তার আর তর সইছে না তাদের মুখ দেখার জন্য। কিছু সব্জি বা মাছ ইত্যাদি কেনা কাটা করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাগিদে সেটুকু সম্ভব হয়নি। সেটা করতে গেলে একটা স্টপেজ আগে নামতে হত। সেখানে অনেক দোকান পাট আছে।
সন্ধ্যের শুরুতে বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। গাছগাছালির জন্য আরো নিশ্ছিদ্র মনে হচ্ছে। জোনাকিরা জ্বলছে টিপ টিপ করে জঙ্গলের আঁধারে। এসময়ে শিয়াল ভাম খট্টাস গন্ধগোকুলের আগাগোনা হয়। গৃহস্থেরা পোষা হাঁস মুরগি ঘরে তুলতে দেরি করলে সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তবে শিয়াল এ সময়ে ডাকাডাকি বিশেষ করে না। মধ্যরাতে দলবদ্ধ ভাবে সব সঙ্গীত চর্চা করে নদীর পাড়ে কাশ বনে ।
সেদিন ডিউটির শেষে নদীর পাড়ে নির্দিষ্ট স্থানে বসতে গিয়ে শিবু একটা মজার ঘটনা শোনে। শেষ খেয়াতে কোন একটি দম্পতি নাকি প্রবল ঝগড়াঝাঁটি বাধিয়ে তাদের কোলের ছেলেটাকে নদীতে ফেলে দেয়। তবে বাচ্ছাটা বেঁচে যায় মাঝিদের তৎপরতায়। শিবু নরম মনের মানুষ। তার কথা বার্তায় এবং ব্যবহারে ভদ্রোচিত ভাব আছে। হেল্পার ছেলেটা সাথে ছিল। বলল,- দিন কাল কি পড়েছে গো শিবু দা! কোলের ছেলেকে জলে ফেলে দিচ্ছে।
এ সময় তারা একটু মদ খায়। এক দুই ঢোক দিশি মদ পেটে দিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে।
– আমরা তো জানিনে ঠিক কি হয়েছিল, তবে বড়দের রাগ কেন শিশুদের ওপরে পড়বে? এটা ঠিক না।
শিবুর আবার একটুকুতেই বেশি নেশা হয়ে যায়। একগ্লাস পেটে পড়তেই সে ভাবে, আহাঃ রে বাচ্চাটা যদি সত্যি সত্যি জলে ডুবে যেত। সে কতটা গভীর অতলে তলিয়ে যেত। কত জল এই নদীর, কি তার গভীরতা ? ভাগ্যিস মাঝি মাল্লারা বাচ্চাটিকে ধরে ফেলেছিল। লোকজন যারা আশেপাশে ছিল তারা বলল যে মেয়েটির বিশেষ বয়স নয়। বাচ্ছাটা কোলের মধ্যে মাকে আঁকড়ে ছিল । লোকটিই বার বার খ্যাচোর ম্যাচোর করছিল। এই সংসারে কি যে এত ঝামেলা তা অবশ্য শিবু বিশেষ বোঝে না। সপ্তাহান্তে তার আয় থেকে সে বাড়ির জন্য বাজার হাট করে দিয়ে যায়। তিনটি লোকের খাওয়া পরা। ঝুট ঝামেলার মধ্যে যায় না।
তারা তিনজন মানে, এই তৃতীয় ব্যক্তিটি শিবুর মা। বাচ্চাটার কি আর হিসেব হয়! শিবুর মা মধ্য বয়েসি একজন মহিলা। অল্প বয়েসে স্বামী হারিয়ে সে শিবুকে একা হাতে মানুষ করে। তার নিজস্ব কিছু বাতিক আছে বাছবিচার আছে। তবুও শাশুড়ী ও বৌয়ের মধ্যে কোন চোখে পড়ার মত গরমিল শিবু দেখতে পায় না।
আকাশে কি একটু মেঘ জমেছে? হাওয়া গায়ে লাগলে ঠান্ডার অনুভূতি হচ্ছে। লম্বা একবগ্গা গাছগুলো মাথা উঁচু করে বেড়ে গেছে চাষের এবং বসত জমির সীমানা ঘেঁষে। অল্প হাওয়াতে সর্ সর্ করে পাতার আওয়াজ হচ্ছে।
শিবুর বাড়ি গাঁয়ের শেষ সীমানায়। ওখান থেকেই এই মাঠে চাষের জমির শুরু। যা দু’চার বিঘা জমি আছে শিবুর তা আর এখন নিজে হাতে চাষ করা হয় না। অবশ্য যতদিন বেঁচে ছিল তার বাবা চাষ করত। মানে চেষ্টা করে যেত সারা বছরের খাওয়ার মত চাল ডাল সব্জি ঘরে তোলার জন্য । ব্যবস্থা করত যাতে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস না কিনতে হয়। শিবু পারে না এইসব কঠিন কাজ।
আর তা-ই শিবু লেখা পড়ায় তেমন জুৎ হচ্ছে না দেখে একটা চালু রুটের বাসে হেল্পারি শুরু করেছিল। এখন সে মালিকের বিশ্বস্ত কন্ডাক্টর।
সংসারে শিবু মা’র কথা শোনে। সে স্ত্রীর যুক্তি সঙ্গত কথাও না করতে পারে না। শাশুড়ি বৌমার মধ্যে দ্বন্দ আছে বোঝে তবে সে সবের মধ্যে শিবু ঢেকে না।
এই তো সেদিন, কি নিয়ে দুই নারীর মধ্যে তুলকালাম। শিবুকে সালিসি মেনে তার মা বলল,- মা-বাবা সহবৎ শেখায়নি?
এখানে শিবুর চুপ করে থাকা ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ কি থাকে? তবে স্বাভাবিক নিয়মেই শিবুর বউ উত্তর দিতে ছাড়ে না।
– কয়েকবার গিয়ে তো ঘষা মাজা করে দেখে শুনে তো নিয়েছিলেন। বুঝতে পারেন নি?
কম কথা বললেও শিবুর বউয়ের কথায় যুক্তি থাকে বেশি। শাশুড়ি বেশি এগোতে পারে না। গুমরে গুমরে বাড়ি ছেড়ে পাড়ার লোককে বউয়ের সম্বন্ধে দুচার কথা বলে নিজের জমে থাকা রাগ হালকা করে।
এভাবেই টেনে হিঁচড়ে চলছে অকিঞ্চৎকর শিবুর জীবন । তবে দিনের শেষে যখন সে দেখে তিনটি প্রাণী খেয়ে দেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে তখন বোঝে সংসার থেমে নেই। জগৎ সংসারের মত তার ছোট সংসারও চলছে এই সব টানাপোড়েনের মধ্যেও । সংসারের নিয়মে শিবুর একটা ছেলে জন্মেছে এবং সে মা-ঠাকুমার কোলে পিঠে মানুষ হচ্ছে।
কাঁচা মাটির রাস্তাটা সোজা চলে গেছে চাষজমির মাঠের দিকে আর ডানদিকের অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তাটা গেছে গাছগাছালি ভরা একটা উঁচু জায়গার দিকে। যে জমিটায় শিবুর বাড়ি। বাড়ি বললে বাড়াবাড়ি করা হবে একটা কুঁড়ে ঘরই বলা চলে। তবে কিছুটা ইঁটের গাঁথনি বলে শিবুর বসতটাকে বাড়ি বলে সবাই। এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ এসেছে তবে প্রায় সব সময়েই বিদুৎ পরিবহনে ভোল্টেজ ভীষণ কম থাকে । সন্ধ্যে রাতের দিকে আরো কমে যায়। টিম টিম করে বাল্ব জ্বলে। মধ্য রাতে আবার একটু উজ্জ্বল হয় আলোগুলো। আজ বাড়িতে কোন আলোর রেখা দেখতে পেল না সে। বাড়ির ভিতর থেকে কোন শব্দ ও কানে আসছে না। এই সময়ে সবাই বাড়িতেই থাকে। অন্ততঃ থাকার কথা।
শিবু অবাক হলো। নিঃস্তব্ধতা এবং নিঃশব্দ তাকে শঙ্কিত করল। সাধারনত সে সারাদিন শব্দের মধ্যে থাকে। হৈ হৈ রৈ রৈ কত শব্দ। ইঞ্জিনের শব্দ, প্যাসেঞ্জারের কল কোলাহল ড্রাইভারের খিস্তি পাবলিকের জ্ঞান দেয়া । সব মিলিয়ে শব্দের হানাহানি। তাদের নিজস্ব লোক ডাকা ও ড্রাইভারকে ঈঙ্গিত করার শব্দ। পছন্দ না হলেও সহ্য করতে হয়।
আজ এই নিঃঝুম সন্ধ্যা তাকে শঙ্কিত এবং দ্বিধান্বিত করল। তিনদিন যোগাযোগ করতে পারেনি বাড়ির সাথে। সে হাঁক পাড়ে,- মা, ও মা। কোথায় সব?
তবে সচরাচর সে তো কখনও চিৎকার করে কথা বলতে পারে না। তার স্বভাবই হল একটু ধীর স্থির, কথা কম বলা, এই টাইপের। শিবু কোন উত্তর পেল না। সে আঁধারে হাতড়ে নীঁচু বারান্দায় উঠে বাঁশের খুঁঠিতে ঝোলানো আলোর সুইচটা হাতড়ে জ্বেলে দিল। যতটুকু আলো ফুটলো তাতে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হলেও বোঝা গেল এই ভর সন্ধ্যা বেলায় চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ শুয়ে আছে। মা নিশ্চয়ই। তার কি শরীর খারাপ?
– ও মা, সবাই কোথায়, তুমি এই সন্ধ্যে বেলায় শুয়ে আছো কেন?
– শরীলটা ভালো নেই।
– ওরা কোথায়?
ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল শিবুর মা,- সে তো তুই আর তোর বউ জানিস, কে একটা লোক মটর সাইকেল চড়ে এল। বললে তোর শ্বশুরের ধুম জ্বর। সব ফেলে চলে গেল। তাও তো দুই রাত্রি হয়ে গেল। তোকে তো ফোন করেছিল।
– আমার ফোন তো খারাপ!
খটকা লাগলো শিবুর। শুনেছে তার শ্বশুর বাড়ির পাশে একজন আত্মীয়ের মোটর বাইক আছে। তবে তারা দূর আত্মীয়।
নদীর ঘাটের মাঝিরাও বলছিল। যে বউটা বাচ্চা জলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল তারাও নাকি বাইকে করে ঘাট অবধি গিয়েছিল।
– তুমি বারণ করনি?
– তোর বউ কার কথা শোনে ?
শিবু আরো বেশি অস্থিরতা এবং দ্বন্দ্বে ভুগল। দুর্গা কি এতোটা নিচে নামতে পারবে? চেষ্টা তো করে শিবু তার সুখ দুঃখ বোঝার। যখন মনে করে সে দশ কিলোমিটার দূরে তার বাপের বাড়ি চলে যায়। কখন ছেলেকে নিয়ে কখনও সে একাই। সেখানে তার মা-বাবা শিবুকে সাধ্যমত যত্নআত্তি করে । জামাই বলে সে যথেষ্ট গুরুত্ব পায় দুর্গার বাবার বাড়িতে । তার কি এমন হতে পারে যে সে অন্য লোকের সাথে সংসার ভেঙে চলে যাবে।
হেল্পার ছেলেটা সেদিন বলেছিল,- মেয়েছেলের কোন বিশ্বেস নেই গো শিবুদা। দেখো না, আমার মা আমাকে আর ভাইকে ফেলে একটা বাঁশের ব্যাপারীর সাথে বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে নিকে করে নিলো।
কথাটার যে সারবত্তা আছে ছেলেটিই তার অকাট্য প্রমান। তা বলে দুর্গা! শিবু মাথায় সব ঢোকেও না।
ঘরে আলোটা জ্বালিয়ে একটু কলতলায় গেল শিবু। মোবাইলটার ওপর রাগে আছড়ে দিল মাটির মেঝেতে।
– ভাত খাবি? কাল সকালে একবার কাবিলপুরে ঘুরে আসিস।
মোবাইলের ছিটকে যাওয়া ব্যাটারি, পেছনের কভার আবার গুটিয়ে অনর্থক ভেবেও চার্জারটায় পিন ঢুকিয়ে সে স্নান করতে গেল। মা উনুন ধরিয়ে কিছু একটা বসিয়ে নিজের মনে বক বক করছে। এটা তার অভ্যেস।
শিবু মনে মনে ভাবলো দুর্গা কি সত্যি সত্যিই চলে গেল। যাওয়ার আগে কি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি? সে মাঝে মাঝে ডিউটিতে থাকলে মদ খায় বটে তবে সে তো মাতাল নয়। তার দোষ বলতে সে গরীব আর তার ঘরে কুকথা বলার জন্যে একজন মা আছে। এই তো দোষের ঝাঁপি।
সস্তা সাবানটা মাথায় ঘষতে ঘষতে শিবুর চোখে ফেনা ঢুকে গেল। রাগে তার মাথা আরো গরম হয়ে গেল আর প্রায় তখনই সাবানটা ছিটকে হাত থেকে বেরিয়ে গেল। রেগে গিয়ে পায়ের কাছে রাখা প্লাস্টিকের মগটাকে জোরে একটা লাথি কষিয়ে দিল।
দেওয়ার পরেই তার মনে হল কাজটা ঠিক হয়নি। এখন মাথায় কি ভাবে জল ঢালবে?
মা কড়াইতে কি চাপিয়েছে তার চড়বড়ানির শব্দের মধ্যে একটা কি অন্য আওয়াজ আসছে? ভারি কোন ক্রিং ক্রিং আওয়াজ , মুদির দোকানের ক্যাশবাক্সের পাশে কিম্বা পোস্ট অফিসের টেবিলে রাখা কালো টেলিফোনের রিং হওয়ার শব্দ।
– ও শিবে দেখতো তোর ফোনে কি আওয়াজ হচ্ছে?
– মগটা কোথায় দেখো তো, আমি চোখ খুলতে পারছি না।
– ঐ তো বেড়ার ধারে, ওখেনে কি করে গেল ?
কোন রকমে দু’মগ জল ঢেলে এক লাফে বারান্দায় উঠে শিবু ফোনটার কাছে গিয়ে ছোঁ মেরে যন্ত্রটা হাতে তুলে নিল। ছ্যাঁক করে উঠল হাত। মানে চার্জিং হচ্ছিল। হয়তো মরা ফোনটা বেঁচে উঠেছে । শিবু খুশি হল। অন্ততঃ যোগাযোগের ব্যবস্থা একটা ফিরে এল।
একটা মিসড কল। অচেনা নম্বর।
দুর্গার নম্বর তার নামেই সেভ করা আছে। অচেনা নম্বরে ফোন না করে সে কিছুটা নির্লজ্জ হয়েও দুর্গার চেনা নম্বরে একটা কল করল। কল হল না শুধু শুধু নির্দিষ্ট সময় পরে কল থেমে গেল। যান্ত্রিক গলায় এক নারী কন্ঠের উত্তর এল,’এই নম্বরের কোন অস্তিত্ব নেই ‘।
অবাক লাগল শিবুর। তিন দিন আগেও যার অস্তিত্ব অতিমাত্রায় ছিল। সে কি করে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল।
যতটা আনন্দিত সে হয়েছিল ফোনের কর্মক্ষমতা ফিরে পাওয়াতে, দুর্গাকে ফোনে না পেয়ে সে ততটাই বিমর্ষ হয়ে ফোনটা রেখে দিল। তবে চার্জিং হচ্ছে, এটুকুই যথেষ্ট।
তিনদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম অপর্যাপ্ত ঘুম এবং দুর্গার ছেড়ে চলে যাওয়া, সব মিলিয়ে তার শরীর আর চলছিল না। অবসন্নতায় সে আবিষ্ঠ হয়ে কোন রকমে একটু ভাত মুখে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
তখন বোধ হয় অনেক রাত, শিবু দেখল দুর্গা তার পাশে ছেলেকে নিয়ে শুয়ে আছে। তাকে ধাক্কা দিয়ে বলছে,- কি গো ডিউটিতে যাবে না?
– কি করে যাবো খোকার জন্মদিন, কাল জোগাড়-যন্ত্র করে পরশু ডিউটি ধরবো।
– শুধু ছেলে আর ছেলে আমার জন্যে তো কিছু কেনো না? আমি কি ফালতু?
– তা কেন দুর্গা ? আমি তো গরীব মানুষ। যতটুকু আয় করি সব তো তোদের জন্য খরচা করি।
– তা বলে তুমি আমার জন্যে কিছুই কিনে দেবে না?
– ঠিক দেবো, এ মাসেই তোকে কিনে দেব।
হঠাৎ খিল খিল করে দুর্গা হেসে উঠল।- আমি এমনিই বললাম, ইয়ার্কি করলাম।
অবাক হয়ে শিবু দেখল ঘন কুয়াশার মধ্যে দুর্গা তার কোলে ছেলেকে নিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। শিবু ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল।
– দুগ্গা শোন, দুগ্গা শোন, দুগ্গা…।
যতটা জোরে সম্ভব সে চিৎকার করার চেষ্টা করল।
গায়ে ধাক্কা দিয়ে কেউ ডাকছে, -শিবু, ও শিবে ওঠ। স্বপ্নের ঘোরে কি সব বলছিলি?
ধড়ফড় করে বিছানায় বসে সে মোবাইলের পর্দায় দেখল মাত্র দশটা বাজে। এমন কিছু রাত হয়নি। অথচ এই জঙ্গুলে জায়গায় মনে হচ্ছে রাত গভীর ও কষাড় হয়ে গেছে। লম্বু ইউক্যালিপটাস্ গাছের পাতায় খসখসে ঝরঝরে আওয়াজ বেড়েছে । আকাশে নিশাচর পাখির ডাক আর আরো দূরে নদীর ধারে কাশ বনে শিয়ালের গণ কোলাহল ।
সবে শিবু বোতলে রাখা জল পান করে আবার শুতে গেল।তখন মোবাইলটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর পুরোপুরি বেজে থেমে গেল। আবার বেজে উঠল। যা হোক এবার সে ধরবে, অচেনা হলেও।
– হ্যালো, হ্যালো । কি গো ফোন ধরছ না কেন?
– কে, তুমি?
– আমার গলা চিনতে পারছ না? আমি দুগ্গা । তোমার ডিউটি শেষ?
– দুর্গা, ও তাই বল! চেন চেনা লাগছে গলাটা।
– তোমার তো এ সময় ডিউটি শেষ হয়। খেয়েছ? না মদ খাচ্ছো?
শিবু চুপ করে বোঝার চেষ্টা করলো। ঘটনা তবে ঠিক কি?
– তোমাকে ফোন করে পাইনে । ভাই এসেছিল, বললে, দিদি চল বাবার জ্বর হয়েছে দেখে আসবি। ও একটা নতুন বাইক কিনেছে। মা আবার সে সময় বাড়িতে ছিল না। তাই চাবিটা পাশের বাড়ির খুড়িমার কাছে রেখে এসেছিলাম।
-হুঁ।
।- আসার পথে ভাই বলল,দিদি একটা নতুন কোম্পানির সিম নে। সিগনাল ভালো হবে। আজ বিকেলে কানেকশান এল। তোমাকে তো পাওয়াই যায় না।
বুকের ওপর কোথাও একটা পাথর চেপেছিল শিবুর। রাগ অপমানও হচ্ছিল। তবে তার সব রাগ জল হয়ে গেল। কথার মাঝখানে তার ছেলে বুঝি মোবাইলটা কেড়ে নিল । ব্যা ব্যা করে চিৎকার জুড়ে দিল।
শিবুর গলাটা ধরে এলো। দেখলো তার মা কখন ঘরে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
– এই ন্যাও বাবু ঠাম্মার সাথে কথা বল।
কি কথা তারা দুজনে বলল কে জানে। তবে ঠাকুমার মুখে বেশ হাসি ফুটলো।
ফোনটা শিবুর হাতে দিয়ে তার মা বলল,- ধর ফোনটা, শয়তান নিজেই লাইনটা কেটে দিল।
নিশ্চিন্ত হয়ে শিবু মোবাইলটা মাথার কাছে রেখে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।