১৫ই জানুয়ারী, ২০২১
দেশজুড়েই করোনা সংক্রমণের হার কমছে। নিউজ চ্যানেলগুলোতে ঘন্টায় ঘন্টায় কোভিড রোগীর সংখ্যার আপডেট দেওয়া বন্ধ হয়েছে। কিছুদিন আগেও চ্যানেলগুলো দেখলে মনে হ’ত ভোটের রেজাল্ট বেরোচ্ছে। বিভিন্ন দেশের কোভিড-তথ্য জেনারেল নলেজের হট টপিক। মুখস্থ না থাকলে স্যোশাল মিডিয়ায় পিছিয়ে পড়তে হয়। মাস্ক পরা সেলফি কিংবা মাস্ক ছাড়া জমায়েত ঘিরে নিত্যদিনের শোরগোল। পাড়ায় পাড়ায় ফিসফাস- দশ কিলোমিটারের মধ্যেই করোনা… ওপাড়ার অবিনাশবাবুর জ্বর-সর্দিকাশির পর টেস্ট করাতেই… করোনায় মৃত্যু… পিপিই কিটের অভাব…
সেসব দিন পেরিয়ে এসেছি আমরা। সেপ্টেম্বরে দৈনিক সংক্রমণ প্রায় লক্ষ ছুঁয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে কমের দিকে। আমার হাসপাতালেও দেখতে পেতাম, আগে টেস্ট করাতে দিলেই পজিটিভ! আইসোলেশন ওয়ার্ডে থিকথিকে ভিড়। রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে আতঙ্ক- আমার বাচ্চাটারও বুঝি… রোগের আতঙ্ককে বহুগুণ ছাপিয়ে গিয়েছিল সামাজিকভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য উপযুক্ত পিপিই বেশিরভাগ সময়েই অপ্রতুল। এমনিতেও পিপিই পরে ফেলা মানে সাংঘাতিক ডিহাইড্রেশন আর দমবন্ধ অবস্থা। ওভাবেই রোগী দেখার অসহ্য কষ্ট পেরিয়ে এখন আইসোলেশন ওয়ার্ডে গুটিকয়েক পেশেন্ট। জানি না, কোভিড আবার দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিনা… তবে খুব সম্ভবত ‘আশা’র দিকেই পাল্লাভারী।
এদিকে আসবে আসবে করে ভ্যাক্সিনও এসে পড়েছে। কাল থেকে দেশজুড়ে টিকাকরণ শুরু। আজ হাসপাতালে টিকাকরণ ও তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়ার ব্যাপারে ট্রেনিং ছিল। সেমিনার রুমে তিল ধারণের জায়গা নেই। হাসপাতালে ঢোকার মুখে বড় একটা চত্বর পর্দা দিয়ে ঘিরে টিকাকরণের জায়গা করা হয়েছে। ভ্যাক্সিনেশন অফিসার হিসেবে এক, দুই, তিন করে পুলিশ-সিভিক ভলান্টিয়ার, নার্সিং স্টাফ ও চিকিৎসকদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। টিকাকরণ কেন্দ্রে আপৎকালীন অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য দুজন ডাক্তার থাকবেন। পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা নিতে হবে। পেশীর মধ্যে কোভিশিল্ড ভ্যাক্সিন দেওয়া হবে। টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আর পাঁচটা টিকার থেকে খুব সাংঘাতিক বেশি কিছু নয়। টিকাকরণের জায়গায় ব্যথা, হাল্কা জ্বর, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি সাধারণ উপসর্গ থাকতে পারে। তাছাড়া যে কোনও ইঞ্জেকশনের মতোই বিরল কিছু ক্ষেত্রে অ্যালার্জিঘটিত সমস্যা হ’তে পারে। আর কিছু দীর্ঘস্থায়ী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হবে কিনা তার উত্তর মহাকালের হাতে।
ভয়, মৃত্যু, কাজ হারানো, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, শুনশান লকডাউন, মাসের পর মাস ট্রেন বন্ধ, অনন্ত খিদে, খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া… সব সামলে আরও একটা মহামারীর সামনে বুক চিতিয়ে বেঁচে নিলাম আমি, আপনি, আমরা সবাই। এবার শেষ যুদ্ধটুকু বাকি। শুধু টিকাকরণ সফল হলেই… না, সংশয় নয়। সফল হবেই- বিশ্বাস থাক।
গুটিবসন্ত, পোলিও, টিবি, হাম, ম্যালেরিয়া, কলেরা কালাজ্বর, দুটো বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দেশভাগ, কাঁটাতার, বন্যা… আমাদের ভেঙেছে, মুচড়েছে, পিষে গিয়েছে। তবু মরিনি। গাঢ় অন্ধকারেও নিভতে দিইনি জীবনের উজ্জ্বল লাল। ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে নিয়েছি পরের দিনের সূর্যটায় গোটা গোটা করে নিজের নাম লিখবো বলে। মহামারীর শেষে মানুষই জিতবে শেষমেশ। আর আমাদের প্রজন্ম একটা গল্প পাবে। জয়ের গল্প। সে গল্প অবাক বিস্ময়ে শুনবে ভাবীকালের পৃথিবী। দামী ভারী আসবাব, এসির ঠান্ডা, মৃদু নীল আলো শোভিত অত্যাধুনিক অট্টালিকাই হোক বা বস্তির স্যাঁতসেঁতে, অস্বাস্থ্যকর ত্রিপল ছাউনি… এ গল্পের রোমাঞ্চ আর শিহরণে সবার সমান অধিকার।
শেষের আগে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলে নিই। সবকিছু নির্বিঘ্নে চললে ধীরে ধীরে সবার জন্যই টিকাকরণ শুরু হবে। তবে একটা টিকা নিয়েই আনন্দে উদ্বাহু হয়ে মাস্ক খুলে ফেলবেন না। কোনও টিকাই একশো শতাংশ নিরাপত্তা দেয় না। টিকা সফল হোক বা না-হোক, মাস্কের নিরাপত্তা এখনই ভুললে চলবে না।
মাথায় রাখবেন,
মন্দির-মসজিদ-গির্জা বা অন্য কোনও উপাসনাস্থল নয়,
আর্সেনিকাম অ্যালবাম-করোনিল-ভাবিজী পাঁপড় নয়,
জড়িবুটি-তন্ত্রমন্ত্র-পাথর-তাবিজ নয়…
দিনের শেষে, একমাত্র বিজ্ঞানই ভরসা।