তখন বোধহয় স্কুলেও ঢুকিনি। এত ছোট। স্মৃতি বলতে যা বোঝায় তা ঝাড়াঝুড়ি করলে এক্কেবারে পুরোনো, হলুদ হয়ে যাওয়া যে দুয়েকটি পাতার দেখা মেলে সেখানকারই একখানা পাতা। এর আগে আর নিজস্ব, গুছিয়ে রাখা স্মৃতি বলতে কিছু নেই।
একই উঠোনে দু’খানা বাড়ি আমাদের। একটায় আমি, মা, বাবা। যতদূর মনে পড়ছে বোন তখনও হয় নি, বা হলেও এতই ছোট যে আমার স্মৃতিতে নেই। আরেকটা বাড়িতে ঠাকুমা, কাকু, তিন পিসি। মা সাতসকালে উঠে ঝড়ের গতিতে বাড়ির একগাদা কাজ করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেত ডিউটিতে। ফিরতে ফিরতে সাড়ে বারোটা- একটা। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। ফলে আমার সকালবেলাটা কাটত পিসিদের কাছেই। মানে ওই খাওয়া বা মাঝে মাঝে স্নানের পার্ট টুকুই। চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করলেও পিসিদের গাভাসকারীয় দৈনন্দিন আর আমার আখতারীয় চালচলনের জন্য সেটা আর সম্ভব হত না। আমগাছের গুঁড়িতে কাঠপিঁপড়েরা ঠিক কী করতে চাইছে সেটা বোঝা, বা কতটা মাটি খুঁড়লে জল বেরোবে দেখার জন্য একটা কাটারি নিয়ে উঠোনের সবচেয়ে নরম জায়গাটায় মাটি খোঁড়া। এসব আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। থিয়োরি, প্র্যাক্টিক্যাল সবদিকই বজায় রাখতে হবে কিনা।
যাইহোক সেই সময়েরই গল্প। ট্র্যাজেডি।
বাড়িতে একটা মুরগী ছিল। একটাই। খুব ছোট। মানে বাচ্চা মুরগী আর কি। সে কীভাবে আমাদের বাড়িতে এল বা তার মা- বাবা- ভাইবোনেরা কোথায় ছিল আমি বলতে পারব না। বানিয়ে বললে হয়ত পারতাম, কিন্তু যেহেতু সেটুকুই বলছি যা আমার স্মৃতিতে আছে তাই পারব না। তাকে যে কী প্রচন্ড ভালোবাসতাম তা আমিই জানি। এবং সেই ভালোবাসাটুকু আমার স্মৃতি ব্যাপ্তিতে হোক বা গভীরতায়, এতদিন ধরে যে ধরে রেখেছে সেটাই ভীষন আশ্চর্যের। মাঝেমাঝে ভাবি, আমাদের জীবনের সমস্ত সমঅস্ত ভালোবাসা, যারা যে যে ভাবে এসেছিল, আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, যদি স্মৃতিতে সাজানো থাকত সেই অনুভবেই তাহলে কী চমৎকারই না হ’ত। ক্লাস নাইনের বর্ষায় এক বিকেলে একটি ফুটবল মাঠকে যেভাবে ভালোবেসেছিলাম; বা শারজার ঘুমে জড়িয়ে আসা রাতে সচিনকে যেভাবে… সেই আবেগ, সেই তীব্রতাকে স্মৃতি যদি হুকুম করলেই এনে পায়ের কাছে জড়ো করে রাখত! কী উজ্জ্বল হ’ত প্রতিটা দিন।
মুরগীটার সাথে চেষ্টা করেও সবসময় থাকতে পারতাম না। কোথায় যে পালিয়ে যেত কে জানে! তাছাড়া আমার আরও অনেক ভালোবাসার জন ছিল তো– পিঁপড়ে, মাটি, লাল কেন্নো– ফলে তাকে যে খুব সময় দিতে পারতাম তাও নয়। তবে মনে মনে জানতাম ওকে খুব ভালোবাসি। একটা খাঁচা ছিল। রোজ সন্ধ্যায় মা বা পিসিদের মধ্যে কেউ মুরগীটাকে খুঁজে এনে ঢুকিয়ে রাখত, পরেরদিন সকাল হলে ছাড়া হত। স্মৃতি বলছে, ওকে একদিনও যদি খাঁচায় ঢোকাতে দেরি হত তাহলে আমার আর চিন্তার শেষ থাকত না। চিৎকার করে, কেঁদে কেটে বাড়ি মাথায় করতাম। একটা মুরগীর জন্য কেউ এরকম করতে পারে এখন ভাবতে পারি কি? বড় হলে কী যে হয় আমাদের!
এরকমভাবে বোধহয় এক কি দেড় বছর চলেছিল, ঠিক বলতে পারব না। তবে এর মধ্যে আমি বোধহয় স্কুলেও ঢুকে পড়েছিলাম, কারণ যে দিনের কথা বলতে যাচ্ছি সেদিন স্কুল থেকে ফেরার একটি দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। এসে চান টান করে যখন ভালোবাসাদের খোঁজ খবর নিতে বেরোলাম তখন দুপুর। সবারই খোঁজ পাওয়া গেল কিন্তু আমার মুরগীটার আর খোঁজ পাওয়া গেল না। এমনিতে এক দু’বার খুঁজে না পাওয়া গেলেও সচরাচর তিন বা চার নম্বর বারে পাওয়া যেতই। আমাকে বেশি কষ্ট দিত না, নিজেই ঝোপঝাড় থেকে বা রান্নাঘরের চাল থেকে বেরিয়ে আসত। আজ কিন্তু এল না। সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম। মা, পিসি, ঠাকুমা। কেউ দেখেনি বলল। কাঁদতে কাঁদতে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হল। বিকেল হল, সন্ধ্যে হল। মুরগীটাকে পাওয়া গেল না। সন্ধ্যায় পড়তে বসাতে পারল না আমাকে কেউ। রাতেও বোধহয় কান্নাকাটি করেছিলাম বেশ।
পরের দিন গেল। তার পরের দিনও। মা, পিসিরা আমাকে বলল মুরগীটা চলে গেছে। মেনে নিতে পারছিলাম না। পরেও যেমন সারাজীবন মেনে নিতে পারিনি। আরে আমি যাকে ভালোবাসছি সে চলে গেছে মানে টা কী! আমি খারাপ কথা বলব, রোয়াব দেখাব, রাগ করব, এমন ব্যবহার করব যাতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু চলে যাবে কেন? আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসি না নাকি? তখন তো এত ছোট, ফলে অভিমান আরও বেশি। আরও মারাত্মক। মনে পড়ে, মা পিসিদের ওপর প্রচন্ড অভিমান করেছিলাম। আমি স্কুলে গেলাম এইটুকু টাইম আর তোমরা একটু খেয়াল রাখতে পারলে না আমার মুরগীটাকে! চলে গেল! যাইহোক, সমস্ত আগুন-অনুভূতিকেই যে নিভিয়ে দেয় তার নাম সময়। সময় গড়ালো, কষ্টের হু হু আগুন নিভে এল নিজের মত করে। তবে আমার জীবনে একখানা অভিশাপ আছে। বয়ে বেড়াচ্ছি। বেড়াবও। তা হ’ল স্মৃতিতে যেটুকু দাগ কেটে যায় সেটুকু গভীরতায় বা ব্যপ্তিতে একেবারে একইরকম না হলেও অন্তত বিষয়গতভাবে একেবারে অবিকৃত অবস্থায় রয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। মুরগীটাও যে ছিল সেটা কেউই বুঝতে পারেনি। তার একটা কারণ যদি হয় আমার স্মৃতি বিষয়ক এই অভিশাপটার কথা যেমন কেউ জানত না তেমনই, কেউই জানত না যে আমি মুরগীটাকে কী প্রচন্ড ভালোবাসতাম।
ফলে এর প্রায় বছর দশেক বাদে, আমি তখন ক্লাস সেভেন কি এইট, আরেকটি কষ্টকর সন্ধ্যা এল আমার জীবনে। পিসিদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। মা যদিও একইরকমভাবে সাত সকালে বেরিয়ে দুপুর একটায় বাড়ি ঢোকে। তা সেই সন্ধ্যায় কোনও এক পিসি আমাদের বাড়িতে এসেছে, খুব গল্প চলছে মা আর পিসির মধ্যে। হঠাৎ, কেন যে তারা সেই মুরগীটার কথা তুলল তা ভগবান জানে। আমি কেমন পাগল ছিলাম সেসব স্মৃতিচারণের পর পিসি হাসতে হাসতে বলে উঠল ‘আর আমরা যে কত কষ্ট করে তোর চোখ এড়িয়ে সেই মুরগীটাকে কেটেছিলাম তা আমরাই জানি। বাপরে বাপ। ছেলে একখানা!’
সেই সন্ধ্যায় আমি কী করেছিলাম বা পিসি কে কী বলেছিলাম তা আর আমার স্মৃতিতে ধরা নেই আজ। মানে ইচ্ছে করেই হয়ত রাখিনি। কারণ মনে পড়ে গেছিল, বাড়িতে বহু, বহুদিন পরে মাংস রান্না হয়েছিল সেই দশ বছর আগের দিনটিতে। সেই অসহায় দুপুরে আমাকে মাংসের ঝোল মেখে ভাত খাইয়ে দিয়েছিল মা।
এই ঘটনাটা আজ বলে ফেললাম তার দুটো কারণ। এক, নিজেও হয়ত সবটা বুঝিনা, কিন্তু এই যে বারবার বলি আমি কাউকেই ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারিনা, কাউকে না, তার পেছনে হয়ত এই আঘাতটার একটা বড় অবদান আছে।
আর দুই, যখন আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি, কিছুতেই খুঁজে পাইনা, তখন প্রচন্ড ভয়ে থাকি সারাটাদিন। কে জানে, ভাতের সাথে নিজেকে মেখে খাচ্ছি না তো অসহায় দুপুরে?…
আমার এত কষ্ট হলো সেই ছেলেটির জন্য যে এক সন্ধ্যায় সে জেনেগিয়েছিল তারই আত্মজনেরা এমনকি তার মা ও অবলীলায় তার বিশ্বাসকে হত্যা করতে পারে!
ইচ্ছে করছে সেই ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে হুহু করে নেমে আসা চোখের জলে তার কষ্ট ধুয়ে ফেলি