শরতের রাত। ডাক্তার সম্রাট চক্রবর্তী বসে আছে বারান্দায়। দেশের বাড়িতে। হাস্নুহানা, যুঁই, মাধবীলতার গন্ধ আসছে। হাওয়া দিলে দূর নারকেল পাতার ঝরঝর শব্দ আসছে। কিছু স্মৃতিও আসছে। শব্দে, গন্ধে, শিরশিরানো হাওয়ায় শরীরে কাঁটা দিচ্ছে।
ক’বছর আগের গরমকাল। পিচগলা রোদ্দুরে, শহরের উষ্ণতম দিনে ওষুধের দোকান সবে রুগীশূন্য হয়ে এসেছে। শেষ রুগী। কাঁধে ব্যথা, ঘাম, ঘামে পোষাক ভেজা, মনে হচ্ছে চান করেছেন, বমির ভাব। চোখ ঘোলাটে। সহজ ভাষায় হার্ট অ্যাটাক। ইসিজি রোগ নিশ্চিত করেছে।
বাড়ির লোক মানে বুড়ি। তেত্রিশ কুলে কেউ নেই। আছে শুধু চোখের জল। সম্রাট মধ্যচিত্ত ঘরের ছেলে। পৌরাণিক সব ভ্যালুজ এখনও চোখে জল নিয়ে আসে। “দিদিমণি আপনি অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করুন। নিয়ে যান পিয়ারলেস বা পিজি, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনার বুড়ো ফিরে আসবে”
বুড়ির চোখের জল অর্থনৈতিক দারিদ্র্য আর বয়সের অক্ষমতার প্রমাণ হয়ে ঝরে পড়ে যায়।
“মেডিক্লেম?”
বুড়ো নেতিয়ে আসছে। বোধহয় হার্টের পাম্প করার ক্ষমতা কমছে। সময় সব ক্ষমতা কেড়ে নেয়। তবে ঠিক সময়ে এরা সম্রাটের কাছে এসেছে। সম্রাট জীবন ফিরিয়ে দেবে। বুড়ো বাড়ি ফিরবে। সম্রাটের চোয়াল শক্ত হয়। মেডিক্লেম যখন নেই তখন ওষুধ দিয়েই লড়াই হবে। সম্রাট ফীজ নেবে না। ডাক্তার-ও ডাক্তার। জীবন মৃত্যুর অধীশ্বর। ফিরে যাবে মৃত্যুর কালো হাত।
অ্যাম্বুলেন্স আসে। অ্যাস্পিরিন, ক্লোপিডোগ্রেল, অ্যাটোর্ভাস্ট্যাটিন, র্যামিপ্রিল খাইয়ে বুড়োকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে সম্রাট চক্রবর্তী। চেম্বার থেকে ব্যাগ নেবে তারপর গলি থেকে মারুতি ওম্নি চালিয়ে সাউথ হরাইজন নার্সিং হোম। চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে নার্সিং হোমের অন ডিউটির ডাক্তার জহরদাকে ফোনে কী কী করতে হবে বলে দেয়।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আবার দুজন রুগী এসে হাজির-ক্যানিং থেকে। এদেরও শুকনো মুখ,ভুখা পেট- কী করে ফেরাবে এদের আবার সুদূর সেই গ্রামে। ট্রেন, ভ্যান রিকশা, ভটভটি নৌকো আর পায়দল? সম্রাট দ্রুত দেখতে থাকে। কুড়িটা মিনিট শেষ। কুড়িটা মূল্যবান মিনিট। গাড়ি পেয়ারাবাগান পেরোতে পেরোতেই জহরদার ফোন। ব্লু টুথে হাত দেয়। “স্ট্রেপ্টোকাইনেজ দিয়েও বিপি ফল করছে”
“আধ ঘন্টা জহরদা আমি আসছি”
ভীড়ের ভেতর স্পীড বাড়ানোর প্রশ্ন নেই। একটু এগোতেই সব গাড়ি স্তব্ধ হয়ে যায়। গান বাজছে ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা’-ওর কলেজ জীবনের গান। হ্যান্ড ব্রেক দিয়ে দৌড়ে যায় মিছিলের শেষে। “ভাই একটা খারাপ রুগী দেখতে যাচ্ছি একটু বেরিয়ে যাই?”
বহু বার, বহু বার প্রতিধ্বনিত হয় “ভাই একটু বেরিয়ে যাই?”
সম্রাট এদের চেনে না। এরা কারা? মিছিল কাদের বাঁচার মিছিল? সম্রাট ডানদিকে গাড়ি ঘোরায়। এদিকে গলির শেষে একটা ফ্লাই ওভার আছে।
সাদা পোশাকের সার্জেন্ট হাত তোলে। “এটা নো এন্ট্রি, গাড়ি থামান”
গাড়ি থামে, চালান কাটা হয়, টাকা মিটিয়ে আবার এগোনো। একটি ঘন্টা চলে গেল। জহরদার ফোন বেজে যায়। কী হবে? অনন্ত পথ বাকি। তবে এবার রাস্তা ফাঁকা।ঐ তো জনশূন্য ফ্লাই ওভার। অ্যাক্সিলারেটরে চাপ বাড়াও সম্রাট- তোমাকে পৌঁছতেই হবে। পুরোনো মারুতি গল্পের সেই ব্রাগাঞ্জা ঘোড়াটার মতো বা শিবাজীর চেতকের মতো কাঁপতে কাঁপতে দৌড়তে থাকে। সম্রাটের পথ নিবদ্ধ দৃষ্টি আশেপাশের কিচ্ছু ফিরে দেখে না।
আবার পুলিশ! আবার কী হলো? অফিসার জানালায় নেমে আসতে ইশারা করেন।
“কী হলো অফিসার? আমি ডাক্তার সম্রাট চক্রবর্তী…. এখন সাউথ হরাইজন নার্সিং হোমে যাচ্ছি….দেখুন ফোন বাজছে…এমও জহরদার…খুব খারাপ পেশেন্ট….”
“ওভার স্পিডিং, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্লিজ”
মানি ব্যাগ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স বেরোয়। দেখে পুলিশ অফিসার লাইসেন্স ফেরৎ দিলেন। এটা জেরক্স…অরিজিনাল দেখি”
পরাজিত সম্রাট লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরায়।
“লগ্না খুব বিপদে পড়েছি…আমার ওরিজিন্যাল ড্রাইভিং লাইসেন্স কোথায়? এটা তো ল্যামিনেট করা কালার জেরক্স…”
“নীল ব্যাগ? কোন নীল ব্যাগ?”
“ওবাবা ওটা তো বাড়ির ব্যাগে!”
জহরদার ফোন বেজে যায়। ফোন বেজে যায়। ছায়া দীর্ঘতর হয়। লগ্না ট্যাক্সি করে এসে পৌঁছয়। পুলিশ লাইসেন্স জমা নেয়। চালান লেখে।
“ওরা গাড়ি সীজ না করে অপেক্ষা করেছে এটাই যথেষ্ট”
লগ্নাকে পাশে বসিয়ে সম্রাট নার্সিং হোমে ঢোকে। বুড়ি বসে আছে লাউঞ্জে। মাথা দুহাতে গোঁজা। দেখা যাচ্ছে শুধু সাদা চুল সব। সাদা চুল। লাল সিঁথি। রিসেপশন থেকে হাতের ঈঙ্গিতে মহাশূন্য দেখায়। মুখে হয়তো ক্ষোভ- স্যর বৌ নিয়ে এলেন, একটু আগে এলেন না?
লিফ্টে উঠতে উঠতে শুনতে পায় সি আর্ম পর্যন্ত রেডি ছিলো। বিষণ্ণ সম্রাট ভুলে যায় ক’তলায় আইসিসিইউ। থেমে থাকা লিফ্টে একা দাঁড়িয়ে মুখের ঘাম মোছে।
অসম্ভব ভালো।