কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার পূর্বরাত্রে হুতোমপেঁচি গাঙের কেল্লার নিকটস্থ রাজপথে বাৎসরিক কার্নিভাল মহামোচ্ছব অবলোকন করিবার নিমিত্ত যাত্রা করিল। একে তো সেই স্থান তাহার দুর্গম হোগলাবনের বাসা হইতে বহুদূর, তাহার উপর বয়সের ভারে পেঁচি কিঞ্চিৎ অলসমন্থর হইয়া পড়িয়াছে — নিজ কোটর এবং পার্শ্বস্থ আমগাছ ব্যতীত অন্য কোথাও যাইবার প্রয়াস পায় না। তথাপি দুর্জয় কৌতূহল নিবৃত্ত করিবার হেতু সে নির্দিষ্ট ক্ষণে গড়ের মাঠ অভিমুখে যাত্রারম্ভ করিল।
অকুস্থলে পৌঁছাইয়া হুতোমপেঁচি যেন দিশাহারা হইয়া গেল। তাহার হিসাবমতো এখন রাত্রিকাল (পক্ষধৃত প্রাচীন ‘স্মার্টফোন’খানি সেই সাক্ষ্য দিতেছে), কিন্তু ইহাকে কি রাত্রি কয়?
রাবণতুল্য মহাশক্তিধর বিজলিবাতিদের কল্যাণে রাজপথ দিবসের ন্যায় আলোকিত। বিজ্ঞ বায়সকুল গৃহচ্যুত হইয়া মহা শোরগোল করিতেছে। শ্যামা, গান্ধী(মহাত্মা ক্ষমা করিবেন), দেওয়ালি প্রমুখ পতঙ্গবাহিনী মারাত্মক তান্ডব আরম্ভ করিয়া দিয়াছে — পথপার্শ্বস্থ জনগণের নৃত্যপর ভঙ্গিমা কেবলই মোচ্ছবজনিত উল্লাস নহে তাহা বেশ প্রতীতি হইতেছে — ফ্যাশনদুরস্ত স্বল্পবাস নরনারীশিশুর দেহপটের উন্মুক্ত লোভনীয় স্থানে তাহারা মহানন্দে অবাধে বিচরণ করিতেছে।
বঙ্গজননীর নজর সর্বগামী, কিন্তু নবমীর বৃষ্টির পরে গড়ের মাঠের জমা জল সম্ভবত মানবীদেবী এবং তাঁহার অনুচরবর্গের দৃষ্টি এড়াইয়া গিয়াছে। ফলে, গন্ডের উপর পিন্ডের ন্যায় এডিস ইজিপ্টাই-এর সেনানীরা ব্যুফে ডিনারে বসিয়া গিয়াছে — এমন ভোজের সুযোগ কি ছাড়িতে আছে?
পথপার্শ্বের একটি ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের মধ্যাবস্থিত শাখায় পেঁচি পত্রগুচ্ছের অন্তরালে আত্মগোপন করিল। অধিক উচ্চশাখায় যাইবার সাহস হইল না —- আলোকশলাকায় এমনিতেই দৃষ্টি অস্বচ্ছ হইয়াছে, উচ্চতর শাখায় উপবেশন করিলে অন্ধকার ব্যতীত কিছুই দৃষ্টিগোচর হইবে না।
অবশ্য এই বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহ, মানবনিগ্রহ, অস্থিরতা আর হাহাকারের কালে অন্ধকার ব্যতীত অবলোকন করার আর কিছু আছে কি? দুর্বোধ্য সঙ্গীত সহযোগে কর্ণপটাহবিদারক নাকাড়ার শব্দে হুতোমপেঁচির দিব্যচিন্তা ভয়ানক ব্যথিত এবং ব্যাহত হইল। পেঁচি বিরক্ত হইয়া প্রাকৃতভাষায় ভাবিল –“ইঃ, মনের ভিতরের এঁড়ে দার্শনিকটা বিটকেল ডেঁপোমি শুরু করে দিল দেকচি। রোসো, বাসায় ফিরেই কড়কাতে হচ্ছে ব্যাটাকে!”
কৃষ্ণচূড়ার আদি বাসিন্দে খদ্যোতকুল পেঁচির চক্ষের সুমুখ দিয়া সবেগে গৃহত্যাগ করিয়া গঙ্গাতীর বাহিয়া ডায়মন্ড হারবার অভিমুখে উধাও হইয়া গেল —- একেবারে কেঁদোদের ডেরায় গিয়া ক্ষান্ত দিবে বোধ হয়।
যাহা হউক, পেঁচি এক্ষণে কার্নিভাল নামক মহানুষ্ঠানপর্বে নিষ্ঠাসহকারে মনোনিবেশ করিল।
ক্রমশ গীতবাদ্য, আদিম তথা আধুনিক নৃত্য, প্রমুখ ‘ইনট্যানজিবল কালচরাল’ উৎকৃষ্টতা ছাপাইয়া বিভিন্ন রূপের জগজ্জননীদের উপর তাহার দৃষ্টি গিয়া পড়িল।
বিভিন্ন ‘ক্লাব’ নামধারী সংগঠনগুলির দেবীপুত্তলিকার প্রতি প্রথম দৃষ্টিপাতেই পেঁচির কলসতুল্য উদরাভ্যন্তর গুড়গুড় করিয়া উঠিল, প্লীহা চমকিয়া কণ্ঠের নিকটে আসিয়া শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম হইল, পৃষ্ঠদেশের ছেয়েরঙ পালকগুলা রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। কোথাও নৃত্যপটিয়সী দেবী বলিউডের নায়িকাসম লাস্যে, বঙ্কিম শরীরী বিভঙ্গে অসুরনাশ করিতেছেন, তো কোথাও কঙ্কালসার প্রতিমা চালচিত্রে ঊর্ণনাভতুল্য হস্ত বিছাইয়া পিকাসোর চিত্রসম খাড়াইয়া রহিয়াছেন। হালে বোধকরি দেবীমস্তিষ্কের আয়তনের প্রসার ঘটিয়াছে, কারণ ম্লেচ্ছ হলিউডি অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের কুচক্রী রেড কুইনের ন্যায় বেঢপ মস্তক এবং শীর্ণ দেহধারিণী দেবী বিংশতিচক্র ট্রেলার আলো করিয়া বসিয়া আছেন দেখা গেল। মাতার যে স্থানে এরূপ আকৃতি, সেখানে সন্তানগণের দুরবস্থা চক্ষুগোচর করাও দুঃসাধ্য। কোথাও লক্ষ্মী সরস্বতী কন্যাগণ মাতাকে ঘেরিয়া গৌর নিতাই ‘পোজে’ দন্ডায়মান, তো কোথাও বিশাল দুর্গামূর্তির পাদদেশে লিলিপুটের ন্যায় অসহায় অস্তিত্বে বর্তমান। কার্তিক গণেশ পুত্রগণের অবস্থা অধিক সঙ্গিন। তাহাদের সনাতন রূপে বৈচিত্র্য আনিবার উপায় নাই, অর্থাৎ সিদ্ধিবিনায়কের হস্তীর পরিবর্তে গন্ডারের মুন্ড, কিংবা বাবরিকেশের পরিবর্তে ফ্রেঞ্চকাট কার্তিকেয় জনগণ মানিবে না, তাই উঁহারা নিতান্ত ব্রাত্যের ন্যায় একপার্শ্বে পড়িয়া রহিয়াছেন।
সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া হুতোমের আক্কেল বরাবর গুড়ুম হইয়া গেল।
অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে সে আপন কোটর অভিমুখে পুনরায় যাত্রা করিল। কেল্লার মাঠের কুনাট্যরঙ্গে যবনিকা পড়িতে আর বিলম্ব নাই।
তবে কি বঙ্গভূমির অর্বাচীন বারোয়ারি দুর্গাপূজা এই ভাবে সার্বজনীন উৎসবের হাঁড়িকাঠে বলিপ্রদত্ত হইয়া গেল? শারদীয়া পূজার নির্ভেজাল আনন্দ কেবল বৈভবের নির্লজ্জ আড়ম্বর, প্রতিযোগিতার রক্তচক্ষু আর রাজনৈতিক বাহুবলীগণের আস্ফালনে পর্যবসিত হইয়া গেল? ঘরোয়া বাঙালিয়ানা তবে বাণিজ্যীকরণের পদতলে পরাভব স্বীকার করিয়া লইল?
আপন স্মার্টফোনটি ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে কোটরগত পেঁচি সক্ষোভে এইসব উচ্চমার্গীয় চিন্তা করিতেছিল। অকস্মাৎ ফেসবুক নামক বায়বীয় সমাজে জনৈক খ্যাতনামা ব্যক্তির প্রাচীরগাত্রে ‘খাপ পঞ্চায়েত’ বসিয়াছে দেখিয়া কৌতূহলবশত ‘কমেন্ট সেকশনে’ অনুপ্রবেশ করিল। ইকি রে, বাপ রে এইসব কি লিখিতেছে গুণীজনে? দুর্গাপূজা হইল মাতৃ আরাধনা, সেই স্থলে নাস্তিক, যবনমনোভাবী ‘বঙ্গালি’-র মনে ভক্তিশ্রদ্ধা নাই, নয়টি রাত্রির কৃচ্ছ্রসাধন নাই, নিরামিষ ভক্ষণ নাই, কেবল নিষিদ্ধ রামপক্ষীর কাটলেট খাইয়া গঙ্গাফড়িঙের ন্যায় মন্ডপ হইতে মন্ডপে উল্লম্ফন করিয়া বেড়ানো রহিয়াছে?
রাম রাম! কৃত্তিবাসী অকালবোধনের পূজায় দশরথপুত্রই নাই? মন্ডপে এতরকম সম্ভব অসম্ভব মূর্তি রহিয়াছে — মহিষ, সিংহ ও অন্যান্য বাহনাদি মায় মহেশ্বরের ষণ্ডটি পর্যন্ত বিরাজমান অথচ পরমভক্ত পবনপুত্রের ঠাঁই হয় নাই! হায় রাম!
অতএব, পাপস্খালন প্রয়োজন! শুনা যাইতেছে, আগামী বৎসর হইতে কেন্দ্রীয় সরকারী নিষেধাজ্ঞাবলে থিম পূজা বন্ধ হইবে। মন্ডপে সিয়ারামের মূর্তি থাকা আবশ্যিক করা হইবে, দুর্গামূর্তি ঐচ্ছিক, তবে থাকিলে, সনাতনী ব্যাঘ্রবাহিনী শেরাওয়ালি মাতা রূপে পূজিতা হইবেন, কোনো ফিদা হুসেনীয়, পিকাসীয়, নিদেন ভবতোষ সুতারীয় মূর্তি চলিবে না। পুংকেশরী ভারতসিংহ কেবল সৌরাষ্ট্র আলো করিয়া থাকিবেন, পুঁয়ে পাওয়া বঙ্গদেশ তাঁহাকে আবাহন করার চিন্তা করে কোন সাহসে?
এই অবধি পড়িয়াছে, এমতাবস্থায় হুতোমপেঁচির স্মার্টফোন আত্মঘাতী হইল, অর্থাৎ ‘হ্যাং’ হইয়া গেল।
পেঁচি দুর্দম দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া ভাবিতে বসিল — আসন্ন পূজায় কি তবে অযোধ্যাপতির অর্চনা করিতে হইবে? মন্ডপে মন্ডপে ‘অয়ি গিরিনন্দিনী’র পরিবর্তে ‘জ্যায় শ্রীরাম’ ধ্বনিত হইবে? নারীপাচার, আবোলতাবোল, ডিজনিল্যান্ড প্রমুখ গণমনোরঞ্জক থিমের মৃত্যুঘন্টা বাজাইয়া বাধ্যতামূলক রামমন্দিরস্বরূপ মন্ডপে গদাধারী বজ্রাঙ্গবলীর রুদ্রমূর্তি শোভা পাইবে?
উঃ, ইহার চাইতে মার্জারসরণী হন্টনকারিণী ‘ডিভা’ দশভুজা যে শতগুণে ভাল! মিনিস্কার্ট পরিহিতা দেবীমূর্তি হোক বা সনাতনী বারাণসী চেলী পরিহিতা— বাঙালির চিরপরিচিত দুর্গামূর্তি ব্যতীত শারদোৎসব যে অসিদ্ধ হইবে! উত্তেজনায় পেঁচি রাত্রিকালীন টেলমিসার্টান গলাধঃকরণ করিতে বেবাক ভুলিয়া গেল।
রাত্রি গভীর হইল। নিদ্রাহীন পেচক অক্ষিপটল মুদিয়া, দুই পক্ষ জোড় করিয়া প্রার্থনায় বসিল—“হেই মা দুগগা, দিব্যি গেলে বলছি মা গো, আমার আর কোনো ছুঁচিবাই নেই কো! ন্যাকা ঠাকুর, ব্যাঁকা ঠাকুর, টেরাকোটার স্যাঁকা ঠাকুর, যেমন রূপেই আসো মা, প্যান্ডেল আলো করে তুমিই এসো। ছেলেপুলে নন্দীভৃঙ্গী যাকে ইচ্ছে নিয়ে এসো মা, কিন্তু তুমিই এসো। জাঙিয়া পরা মহিষাসুরও সহ্য হবে মা, ন্যাজ দুলোনো হনুবাবাজি মাথায় থাকুন, তেনাকে পুজো কত্তে পারব না মোটেও। মার্চ মাসে ইএল স্যাংশন হলে বৈষ্ণোদেবী গিয়ে নিখাদ নিরিমিষ খাবো মাগো, কথা দিলুম — তবে আসছে পুজোয় ছাপ্পান্ন ইঞ্চির এসব ন্যাকার কোনো গতিকে আটকে দাও মা, এগচিকেন রোল ছাড়া ম্যাডক্স স্কোয়ারের আড্ডা জমে, তুমিই বুকে হাত দিয়ে বলো তো মা?”