দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ২৩
“দাদা আপনার কী সমস্যা?” মেয়ে একটু দূরে যেতেই নিতাই বাবু প্রশ্নটা করেই ফেললেন। আসলে তিনি কথা না বলে থাকতে পারেন না। অচেনা লোক হলেও আলাপ জমাতে বেশি সময় নেন না। কিন্তু তাঁর মেয়ে ওই জন্য খুব বকাবকি করে। এখন যা দিনকাল, কার যে কী মতলব!
“ওই দাদার অসুখই…”, পাশে বসা লোকটি খুব চিন্তিত গলায় আস্তে করে কথাটা বললেন।
“মানে?” কিছু বুঝতে না পেরে নিতাই বাবু বলে উঠলেন।
–“আরে দাদার অসুখ…দাদার অসুখ..”
–“ধূর মশাই! আপনার দাদার কী হয়েছে…আমি কী করে জানবো?”
–“আরে দাদা কি শুধু আমার? ও তো সবার দাদা!”
–“সবার দাদা!”
–“হ্যাঁ… বাংলার সবার…শুধু বাংলা কেনো? ভারত ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বের…”
–“গোটা বিশ্বের দাদা!”
–“হ্যাঁ…এখন ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট আছে, কদিন পর আই সি সি’র প্রেসিডেন্ট হবে…আমি তো তাই মনে করি..”
–“ওহ্, তাই বলুন। আগে তো সবাই ‘গাঙ্গুলি বা মহারাজ’ বলেই চিনতো, কিন্তু ওই গ্রেগ চ্যাপেল কেসের পর সবাই কেমন ‘দাদা’ বলতে লাগলো। আমিও কি খেলার খবর কম রাখি? সকালে খবরের কাগজ আসলেই খেলার পাতাটা আগে পড়ি। এ আমার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। সৌরভ কোথায় কবে কার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছে, সব আমি বলে দিতে পারি। ওই যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওর টেনথ ওডিআই সেঞ্চুরি, আর তারপর বিচ্ছিরি রান আউট… ”
–“ধূর মশাই…আপনি হচ্ছেন কাগুজে বাঘ! আমরা মাঠে গিয়ে খেলা দেখা পাবলিক, দাদার সেই রঞ্জি ফাইনালে ডেবিউ থেকে দেখছি…আর ওই স্টেপ আউট করে স্পিনারকে বাপি বাড়ি যা শর্ট… ওহ্ ওইসব কি কাগজ পড়ে হয়!”
নিতাই বাবু এবার একটু দমে গিয়ে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন, “কিন্তু আপনার রোগটা কী?”
–“ওই বুকে ব্যথা। দাদারও তো ওই একই কেস কিনা। আর হবে নাই বা কেন? আমার মত ফ্যান কজন আছে? বছরে দুবার কেক কাটি… মানে ক্লাবের সবাই জোর করে, আর কি…”
–“একটা তো আপনার জন্মদিন, আরেকটা কি বিবাহবার্ষিকী?”
–“আরে না না…বিয়েটাই তো করা হল না! দুটোই জন্মদিন…একটা আমার, আরেকটা দাদার। আসলে পাড়ায় একমাত্র আমিই তো বাঁহাতে ব্যাট করতাম, তাই আমাকে দিয়েই সবাই…”
–“সৌরভের তো হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। আপনি তাহলে হার্টের ডাক্তার দেখান।”
–“আরে গিয়েছিলাম তো…ওই ডা. মন্ডলের কাছেই গিয়ে বললাম আমারও অ্যাঞ্জিও টা করিয়েই নিন…কিন্তু উনি তো এই ডাক্তারবাবুর কাছেই পাঠালেন।”
“গৌরব দত্ত… গৌরব দত্ত..”
অ্যাটেনডেন্টের কথা কানে আসতেই ভদ্রলোক উঠে ভিতরে ঢুকলেন। নিতাইবাবু ভাবলেন তিনি কি শেষে পাগলের ডাক্তারের কাছে এলেন! শেষে কৌতূহলবশত এগিয়ে গিয়ে বন্ধ দরজাতে কান পেতে ভিতরের কথা শোনার চেষ্টা করলেন।
সব শুনে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ঘাড়ে বা পিঠের দিকে ব্যথা হয়?”
–“সে তো আমার ঘাড়ে স্পন্ডাইলোসিস আছে। সেজন্য চিন্তা নেই, শুধু এই বুকের ব্যথাটা নিয়েই যত চিন্তা!”
অনেকক্ষণ পরীক্ষা করে ডাক্তার বাবু বললেন, “এই ব্যথাটা ঘাড়ের থেকেই হচ্ছে। কিন্তু এই বয়সে এই রোগ…..আচ্ছা ঘাড়ের কোনো ছবি করা আছে?”
–“হ্যাঁ সে অনেকদিন আগে একবার করা হয়েছিল… হাড় ক্ষয়ে গেছে বলেছিল। সামনে ঝুঁকতে বারণ করেছিল। তাই তো আমি দেওয়ালে রং করার কাজ নিয়েছি। আর এখন তো সারাদিনে দশ বারোটা বাড়ি ভিজিটে যেতে হয়, একা হাতে তো সব করতে পারি না…”
–“ওহ্…তাহলে সারাদিনে আর মাটির দিকে তাকানো হয় না…এই জন্যই অল্প বয়সে এই রোগ!”
–“না, তা হয় না!…সেটা তো ঘাড়ের পক্ষে ভালোই জানতাম। কিন্তু রোগটা কী?”
–“সার্ভাইক্যাল ফ্যাসেট আর্থ্রোপ্যাথি অ্যাট লেফট সি ফাইভ – সি সিক্স লেভেল।”
–“একটু যদি সহজ করে বলেন…”
–“আমাদের শিরদাঁড়ার হাড়গুলো মানে যাদের ভার্টিব্রা বলে, তাদের সামনের অংশগুলো পরস্পরের সাথে ডিস্ক দিয়ে জুড়ে থাকে…যেমন দেওয়ালে একটা ইটের ওপর আরেকটা ইট সিমেন্ট-বালি দিয়ে গাঁথা হয়। এই ভার্টিব্রার মাঝের ফাঁপা অংশের মধ্যে দিয়ে স্পাইনাল কর্ড ব্রেন থেকে নিচের দিকে নেমে যায়। আর ভার্টিব্রার পিছনের অংশ ওপর ও নিচের ভার্টিব্রার সাথে জুড়ে থাকে এই ফ্যাসেট জয়েন্টের সাথে। অত্যধিক সামনে ঝুঁকলে যেমন ওই ডিস্কের ওপর চাপ পড়ে ডিস্ক প্রলাপ্সড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তেমনি ওপরের দিকে অত্যধিক তাকিয়ে থাকলে ফ্যাসেট জয়েন্টের সমস্যা হয়।”
–“কিন্তু ঘাড়ের সমস্যার জন্য কি বুকে ব্যথা হবে?”
–“হ্যাঁ, সি ফাইভ – সি সিক্স লেভেলে ফ্যাসেটের যন্ত্রণা বুক ও পিঠের উপরিভাগে অনুভূত হয়। আপনার তো শুধু বুক না পিঠেও ব্যথা হত তো?”
–“হ্যাঁ…কিন্তু আমি তো বাম দিকে বুকে ব্যথা মানে হার্টের রোগই ভেবে নিয়েছিলাম…আসলে দাদারও হল তো!”
–“ওটাই তো আপনাদের ভুল! ডাক্তার তো শুধু চিকিৎসা না, আগে রোগটা ডায়াগ্নোসিসও করবে…তার জায়গায় আপনারাই এর ওর মুখে কথা শুনে ডায়াগ্নোসিস করে ফেলছেন! বুকে ব্যথা হলে ডাক্তাররা সবার আগে কার্ডিয়াক পেইন নাকি সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখবেন, কারণ সেটাতে জীবনহানি হতে পারে, তারপর নন কার্ডিয়াক পেইন নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। কিন্তু সেই রোগ নির্ণয় তো ডাক্তারদেরই করতে দিতে হবে।”
–“কিন্তু এর চিকিৎসা কী?”
–“চিকিৎসা স্টেপ বাই স্টেপ করতে হবে। প্রথমে আপনার কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশাপাশি খাবার ওষুধ, ব্যায়াম, হিট থেরাপি, প্রপার পজিশনিং ও লাইফস্টাইল…এগুলো চলবে। তারপরও ব্যথা না কমলে প্রয়োজন মত বিভিন্ন ইন্টারভেনশন করা হবে। ইউএসজি বা সি-আর্ম মেশিনের সাহায্যে ফ্যাসেট জয়েন্টের ভিতরে ইনজেকশন করা হবে বা ফ্যাসেট জয়েন্টের ব্যথা বহনকারী নার্ভটিকে অসাড় করা হবে। তারপরও ব্যথা যদি ফিরে আসে, তাহলে রেডিও ফ্রিকয়েন্সি অ্যাব্লেশন মেশিনের দ্বারা নার্ভটিকে দীর্ঘমেয়াদি ভাবে নিষ্ক্রিয় করা হবে।”
নিতাইবাবু এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। নাহ্ তিনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন! ধন্যবাদ জানালেন ডক্টরস ডায়লগকে… ওখান থেকেই তিনি জেনেছেন তাঁর রোগ এবং সঠিক চিকিৎসার ঠিকানা সম্পর্কে। ভাগ্যিস পত্র-পত্রিকা পড়ার অভ্যেসটা এখনও ধরে রেখেছেন! নাহ অনেকক্ষণ এরকম অভদ্রের মত দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সবাই তাঁর দিকে তাকাচ্ছে…এবার মেয়েও দেখে ফেললে মুশকিল! তাই নিজের বসার জায়গায় ফিরে যেতে যেতে মনে মনে শুধু বললেন, “ভক্ত অনেক দেখেছি, কিন্তু গৌরববাবুর মত অন্ধ ভক্ত আজ প্রথম দেখলাম!”
Doctor’s Dialogue-এর জন্মদিন উপলক্ষে লেখা
DARUN 🌹