সপ্তাহটা শুরু হোক একটা মিঠি মিঠি লেখা দিয়ে। এটাও পুনর্মুদ্রণ যদিও। এখন এই বয়স ব্যালান্স ভেঙেই খাবার বয়স।
______
বাগনান-কাশমলি অটোতে চাঁপা বসে আছে।
শীতের সন্ধ্যে। ছ’টাতেই অন্ধকার নেমে এসেছে। অটোচালক গাড়িটা দু’পা এগিয়ে আবার থামিয়ে রেখেছে। তার আরও এক, দুজন আরোহী চাই।
ব্যাগের মধ্যে চাঁপার ফোনটা বেজে উঠল। একটু মাঝারি সাইজের ব্যাগ। অন্যান্য জিনিসের সাথে একটা চাদরও অনায়াসে রাখা যায়। এইরকম ব্যাগগুলো থেকে মোবাইল ফোন বার করতে মহিলাকুলের খানিক অনীহা থাকে, বিশেষতঃ সেটা যদি কোন যানবাহনের মধ্যে হয়। প্রথমে ধরবেনা ঠিক করলেও কী ভেবে ব্যাগটা সোজা করে ধরে চেন টেনে খুলতে খুলতে ফোনটা থেমে গেল। তাও, না থেমে, চাঁপা ফোনটা বার করতে করতে আবার বেজে উঠল। যা আন্দাজ করেছিল, তাইই। স্বপনের ফোন। অন করে ধরলো কোনমতে। অটোটা ঠিক তখনই ছাড়ল।
–কী ব্যাপার? কোথায় তুমি?
–অটোতে। ফিরছি। এই ছাড়ল।
–ডাক্তার দেখিয়েছো?
–হ্যাঁ, এখন রেখে দাও।
–ডাক্তার খচে যায়নি?
–আমিই খচে যাচ্ছি আপাতত। ছাড়ো এখন। ঘরে গিয়ে বলবো।
–আরে, দুমিনিট বলইনা।
–টাল সামলাতে দায়। তুমি চাও দুজনেই শেষ হয়ে যাই?
এই কথায় কাজ হল। স্বপন ফোনটা কেটে দিল।
———
ডাক্তারটা আজ প্রথমে খানিক খচে গেছল। আড়াইটায় টাইম দিয়েছিল। পৌঁছাতে পৌঁছাতে ছ’টা বেজে যায়। সে তখন ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে উঠবো উঠবো করছে, চাঁপা গিয়ে পৌঁছায়। তার সহকারীটারই কি দেমাগ। ঢুকতে দেয়নি । জোর করেই ঢুকে পড়ি। সে তখন পরীক্ষার লাস্ট মিনিট সাজেশনের মতো করে ফেসবুক খুলে দেখছে! আমার দিকে চোখ তুলে হাঁ করে দেখতে লাগল। যেন, কারো প্রোপিক দেখছে!
–স্যার, আমি চাষীবাড়ির বৌ। অনেক ইন্টিরিয়রে থাকি। মাঠে জন লেগেছে। এগারো জনের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। যদি দেখে দেন!
–আমার যাবার সময় হয়ে গেছে। পরশু এসো।
–পাঁচমাস হয়ে গেছে স্যার, রোজ রোজ আসাটা কি ঠিক হবে স্যার?
–তুমি চাষীবাড়ির বৌ?
–হ্যাঁ, স্যার। জমিতে জোয়ারের জল লেগেছে। তাই কত্তা জন মুনিষ জোগাড় করে রুইতে গেছে। সকাল থেকে ওদের চা টিফিন, দুপুরের ভাত, ডিম, আলু করতে বেলা হয়ে গেল। যদি দয়া করেন।
আমার চাকচিক্য দেখে তার বিশ্বাসই হয়না আমার কোন কথা।
–চাষীটা কই?
–সে আসার সময় পায়নি স্যার। ওদের পেমেন্ট টেমেন্ট দিতে হবে। তাই বলল, এবারটা তুমিই যাও।
–চাষীটাও হিরো নাকি? আর, আমিতো একা কোন পেসেন্ট এলে দেখিনা।
একটু রাগ হয়ে গেল আমার। খুশিও হলাম। বললাম– হ্যাঁ, ঐ আর কি।
জিনসের প্যান্ট টি শার্ট পরলে সেরকমই মনে হয়। পরের বার আসবে বলেছে। এবারের মতো প্লীজ দেখে দিন ডাক্তারবাবু। পরের বার অবশ্যই সে সঙ্গে আসবে।
কী ভেবে, ডাক্তার আমায় দেখে দিল। ওষুধ লিখতে লিখতে বলল, –তুমি সত্যিই চাষী ঘরের বৌ কিনা জানিনা। তবে তোমায় সম্মান করেই দেখে দিলাম। তোমার তো দেখছি, আগে একটা সিজার আছে। তা, তুমিও কি চাষে খাটাখাটি করো?
–হ্যাঁ করি। ঐ ধান টান উঠলে, ঘরে মেলা কাজ বেড়ে যায়।
–আজকাল মেয়েরা অত খাটতে চায়না। আসলে, মানসিকতাটাই সব, বুঝলে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, সবাই যদি শহুরে হয়ে যাচ্ছে, তাহলে, খাটছে কারা? এইযে আমাদের দেশে এত লোক, অথচ দেশটা খাদ্যে স্বয়ম্ভর, কী করে হচ্ছে! আজ তোমাকে দেখে চোখ খুলে গেল।
–ও যে একলা সন্তান। আমাদের চাষজমি অনেক। নদীর চড়াতেও জমি আছে। মরসুমি ফসল সব্জী চাষও হয়। কৃষি দপ্তরের বাবুরাও যায়। হেল্প করে। না করে উপায় কি?
–তুমি বেশ শিক্ষিত টাইপ। এবার থেকে তুমি তোমার সময় মতোই আসবে।
আমি অ্যাসিসট্যান্টকে বলে রাখবো। তোমাদেরকেই সম্মান করা উচিৎ মানুষের।
——-
চটক ভাঙে চাঁপার। কাশমলি স্টপেজ এসে গেছে। অটো থেকে নামতেই স্বপনকে দেখতে পেল। দুজনে, সাইকেল ঠেলে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একটা জেরক্স দোকানে ঢুকে ডাক্তারের প্রেশক্রিপশন ফটোকপি করিয়ে তারপর হাসানের ওষুধ দোকানে ঢুকল।
———
রাতে,
–জানো, ডাক্তারটা আমারই ফ্যান হয়ে গেছে।
–তোমাকে দেখে?
–আরে না, না। আমি যে চাষী ঘরের বৌ, সেটা সে বিশ্বাসই করতে পারেনি। পরে, কী ভেবে আমাকে বলে দিল, তোমার জন্য এনিটাইম ফ্রি।
–এইরে, আর তোমাকে একলা ছাড়া ঠিক হবেনাতো!
–তোমাকে হিরো বলছিল। তুমি পরের বারে কিন্ত হিরোর মতোই যেও সঙ্গে।
——–
রাতে, হাসপাতালের ওটিতে,
–জানেন, ডাঃ চ্যাটার্জি, আজ একটা এত স্মার্ট পেসেন্ট দেখলাম, ভাবতে পারবেননা !
–সে তো আপনি প্রায়ই দেখেন। জীনস্ টপ, মাথায় হেডফোন, হাতে অ্যানড্রয়েভ, মুখে ইংরেজী, নেটিজেন, আপনি প্রায়ই বলেন, ওরা গু-গু-ল-য়ে-ড !
–সেরকম নয় মোটেই। আসলে আপনি অ্যানেস্থেটিস্ট বলে, রোগীদের এই ইনটারঅ্যাকশনটা খুব মিস করেন। দেশটা কতটা পাল্টেছে, সেটা একটা চৌখুপিতে বসেই টের পাই, বুঝলেন। একটা চাষীঘরের বৌ, ড্যাম্ স্মার্ট, কিন্তু খুব খাটে, স্বামীর সঙ্গে সমানে পাল্লা দেয়। আনন্দে আছে।
–এরা আছে বলে আমরা খেতে পাচ্ছি।
________
PC Google.