দীর্ঘ দুবছরের বেশি সময় ভাইরাসের প্রকোপে আমরা মানসিক-সাংস্কৃতিক-দৈনন্দিনতার জগতে ধ্বস্ত, ধ্বস্ত অর্থনীতিতে, শিক্ষার উজ্জ্বল দুনিয়ায়। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাইছি। এরকম শূণ্যতার মাঝেই বিভিন্ন বুজরুকি, ওষুধের অপবিজ্ঞান, রাজনৈতিক জগতে অবিবেচকের মতো মন্তব্য চলতে থাকে। আমজনতা যাহোক কিছু একটা আঁকড়ে ধরে এর থেকে পরিত্রাণ চায়। আবার বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকের চিন্তা, ব্যবসায়ী বা রাজনীতির চিন্তা, রাষ্ট্র কিংবা আমজনতার ভাবনা একইরকম ধারায় চলেনা। হামেশাই বিজ্ঞানীদের সাথে রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তার বিরোধ ঘটে।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্ট (৬ ডিসেম্বর, ২০২১) জানাচ্ছে, “লার্নিং লসেস ফ্রম কোভিড-১৯ কুড কস্ট দিস জেনারেশন অফ স্টুডেন্টস ক্লোজ টু ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার ইন লাইফটাইম আর্নিংস”। ক্ষতির পরিমাণ অকল্পনীয়। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে ১৬০ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীর পড়াশুনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ডেটাবেস (২০২১) অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনীদের হাতে বিশ্বের মোট সম্পদের ৩৮% রয়েছে। ভারতে অতিমারির কারণে ২৩ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, মে ৬, ২০২১)। এজন্য তিক্তস্বরে বলা হয়েছে দারিদ্র্য হয়ে উঠেছে অতিমারি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার “টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসরি গ্রুপ অন সার্স-কোভ-২ ভাইরাস এভোল্যুশন” গত ২৬ নভেম্বর সার্স-কোভ-২-এর যে নতুন প্রজাতি “ওমিক্রন” (গ্রিক অ্যালফাবেট অনুযায়ী নামকরণে ইংরেজির O) আফ্রিকায় উদ্বেগ বাড়িয়েছে তাকে VOC (ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন) বলে অভিহিত করেছে।
পৃথিবীর সমস্ত সাধারণ মানুষ, ঘরপোড়া গরু। তাই সিঁদুরে মেঘে ডরায়। যতই “নিউ নর্ম্যাল”-এর মতো আদুরে নামে ডেকে একে স্বাভাবিক বানানোর চেষ্টা হোক না কেন, আমাদের এ জীবন পূর্ণত অ-স্বাভাবিক।
নতুন চেহারার মিউটেশনের বৈজ্ঞানিকদের কাছে পরিচিতি B.1.1.529 ভ্যারিয়েন্ট তথা ওমিক্রন নামে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হয় ২৪ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২৬ নভেম্বর, ২০২১-এ পৃথিবীর সমস্ত দেশের কাছে জেনোমিক সার্ভেলেন্স এবং “অ্যাসোসিয়েটেড মেটাডেটা” সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। আমাদের মতো যেসব দেশে জেনোমিক স্টাডি এবং সেরো-সার্ভেলেন্স-এর ব্যবস্থা দুর্বল, পাবলিক হেলথ সিস্টেম ভঙ্গুর এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেহাল সেসব দেশে “অ্যাসোসিয়েটেড মেটাডেটা” বিশ্বাসযোগ্যভাবে সংগৃহীত হবে কিভাবে সেটা বাস্তবিকই চিন্তার বিষয়।
নতুন ভ্যারিয়েন্টের চেহারা সার্স-কোভ-২-এর মতো একইরকম, পরিবর্তন ঘটে শুধু জেনোমিক সিকোয়েন্সে। সার্স-কোভ-২ ভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস এবং এতে ২৯,৯০৩টি অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। আরএনএ ভাইরাস হবার জন্য চরিত্রগতভাবে “এরর-প্রোন”। একটি ভাইরাস থেকে আরও অনেক ভাইরাসের জন্ম যখন হচ্ছে তখন এর আরএনএ-র অ্যামিনো অ্যাসিডের সজ্জা পরিবর্তিত হয়ে যায় যাকে মিউটেশন বলে। মিউটেশন যত বেশি হবে ভাইরাসের চরিত্রেরও তত বদল হবে। এর মধ্যে কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট বিপজ্জনক হয়, কিছু বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনা। আরেকটি বিষয় ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ – যাকে বলা হয় R0 (রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার)। করোনাভাইরাসের প্রথম যে জ্ঞাতি তার R0 কমবেশি ২-এর আশেপাশে ছিল। অর্থাৎ একজন মানুষ ২ জনকে সংক্রমিত করতে পারবে। তারা আবার ক্রমাগত জ্যামিতিক হারে সংক্রমণ ঘটাবে
এর আগে ডেল্টা-প্লাস ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে যে মৃত্যুমিছিল দেখেছি সেটার R0 ৬ থেকে ৮-এর মধ্যে ছিল। ওমিক্রনের ক্ষেত্রে অনুমান করা যায় কি বিপুল পরিমাণ মানুষ অল্পসময়ের মধ্যে আক্রান্ত হবে। একদিকে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা, অন্যদিকে সংক্রমণের ক্ষমতা ওমিক্রনের ক্ষেত্রে দুটিই বিপুল। নেচার–এ ২৭ নভেম্বর, ২০২১-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন জানাচ্ছে “হেভিলি মিউটেটেড ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট পুটস সায়েন্টিস্টস অন অ্যালার্ট”। এ প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, যে স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করে ভ্যাক্সিন তৈরি হচ্ছে সে স্পাইক প্রোটিনের যদি ৩০টির বেশি পরিবর্তন ঘটে তাহলে ভ্যাক্সিন কোন স্পাইক প্রোটিনকে রিসেপ্টরের সাথে জোড় বাঁধাকে আটকাবে?
একাধিক বিপত্তি সম্ভব – (১) মানুষের দেহ বহিরাগত ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ফাংগাস বা অন্য যে কিছু দিয়ে আক্রান্ত হলে শরীরের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম একটি তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে শরীরের রক্তে প্রবাহিত নিট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির সাহায্যে। যদি ভাইরাসটি একটি প্রোটিনের চাদর তৈরি করে চোরের মতো এর হাত থেকে পালিয়ে যেতে পারে (evade) তাহলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর কার্যকরী হবেনা, এবং (২) যদি ইমিউন সিস্টেম ঠিকমতো উদ্দীপিত না হয় তাহলে মেমরি সেল কাজ করবেনা। পরিণতিতে আমাদের ইমিউনিটি আমাদের দেহকে ভাইরাসমুক্ত করতে পারবে না।
এ ধারণা নেচার-এ প্রকাশিত “Beyond Omicron: what’s next for SARS-CoV-2 evolution”-এ (৯ ডিসেম্বর, ২০২১) প্রাঞ্জলভাবে বলা হয়েছে – “আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর সাথে তুলনা করলে ওমিক্রনে অনেকগুণ বেশি মিউটেশন থাকছে, বিশেষ করে স্পাইক প্রোটিন অঞ্চলে যে অঞ্চল দেহকোষকে চিনতে পারে। ব্লুমের প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে এই মিউটেশনগুলোর ফলে স্পাইকের কিছু অংশকে শরীরের অ্যান্টবডি আর চিনে উঠতে পারেনা, যে অ্যান্টিবডি ভ্যাক্সিন নেবার ফলে কিংবা আগের কোন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের দরুন তৈরি। কিন্তু এসমস্ত মিউটেশনগুলোকে ভালোভাবে বোঝার জন্য ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষানিরীক্ষা এবং এপিডেমিওলজিকাল স্টাডির বিশেষ প্রয়োজন পড়বে।”
এখানেই বিজ্ঞান ও তার ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ধারণার গুরুত্ব। আজ যতটুকু জানা যাচ্ছে সেটুকু সবার কাছে প্রকাশ করা হবে। আবার নতুন তথ্যের ভিত্তিতে যখন নতুন তত্ত্বায়ন হবে তখন বিজ্ঞানের পুরনো ধারণার পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এখানে কোন গুরুঠাকুরের মতো বলে দেওয়া নেই – “দ্যাখো, আমি আগেই বলেছিলুম না!” না, এতটা প্রজ্ঞার অধিকারী সৎ বিজ্ঞানচর্চা নয়। সে ক্রমাগত এবং ধীরে ধীরে জ্ঞান সংগ্রহ করে চলে সম্ভাব্য সমস্ত অঞ্চল থেকে, উৎস থেকে।সেল-এর মতো মান্য জার্নালে গত ২৪ ডিসেমবর, ২০২১ গবেষণার গুরুত্ব বিচার করে ১৫ জন গবেষকের গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে একটি প্রি-প্রিন্ট গবেষণপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে – (১) যারা ইতিমধ্যেই কোভিড-আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছে তাদের দেহে তৈরি নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের ক্ষেত্রে ৩০টির বেশি মিউটেশন ঘটার ফলে এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করবেনা, (২) পুনঃসংক্রমণ ঘটাতে পারে, এবং (৩) বিভিন্ন ধরনের ভ্যাক্সিনকে পরিমিতভাবে এড়িয়ে যেতে পারে ওমিক্রন (“ভ্যাক্সিন এসকেপ”)।
“ভ্যাক্সিন জাতীয়তাবাদ” এবং “ভ্যাক্সিন অসাম্য” ভাইরাসের নতুন নতুন স্ট্রেইন তৈরি হবার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। টিকাকরণ যত কম হবে তত বেশি সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে। আবার যত বেশি সংক্রমণ হবে ভাইরাসের রেপ্লিকেশন তত বেশি হবে। রেপ্লিকেশন বেশি হওয়া মানেই মিউটেশনের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত দেশের ক্ষেত্রে অন্তত ১০% জনসংখ্যাকে ভ্যাক্সিন দেবার কথা বলেছিল। ৫০টির বেশি দেশ এই টার্গেট মিস করেছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই আফ্রিকা মহাদেশে।
নেচার-এ একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে “কোভিড-১৯ঃ এনডেমিক ডাজ নট মিন হার্মলেস” শিরোনামে (২৭ জানুয়ারি, ২০২২)। এখানে জোর দিয়ে বলা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে আমাদের মনোযোগ প্রয়োজন – (ক) একটি ইনফেকশন এনডেমিক, এপিডেমিক এবং প্যানডেমিক সব চরিত্রের হতে পারে। ২০২০ সালে পৃথিবীতে ৬০০,০০০-র বেশি মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে। অথচ ম্যালেরিয়াকে আমরা এনডেমিক বলি। একই বছরে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে ১০,০০০,০০০ মানুষ, মারা গেছে ১৫ লক্ষ। (খ) হেলথ পলিসি এবং ব্যক্তি মানুষের আচরণ নির্ধারণ করবে বিভিন্ন সম্ভাবনার মধ্যে কোন ধরনটি “এনডেমিক ওমিক্রন”-এ দেখা যাবে। (গ) সর্বব্যাপী একটি কুহকী ধারণা রয়েছে যে বিবর্তনের ফলে ভাইরাস ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯১৮ সালের দ্বিতীয়বারের ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারি এ ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। (গ) এজন্য আমরা (রাষ্ট্রনেতারা এবং আমজনতা) অলস আশাবাদকে দূরে সরিয়ে রাখবো। (ঘ) কি পরিমাণ মৃত্যু ঘটতে পারে এ ব্যাপারে আমাদের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী দরকার এবং সে অনুযায়ী পাবলিক হেলথ পলিসি তৈরি হবে। (ঙ) আমাদের ভাঁড়ারের সমস্ত হাতিয়ারের (সার্বজনীন টিকাকরণ, মাস্কের ব্যবহার, দূরত্ব রক্ষা করা, কার্যকরী অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, বেশি সংখ্যক টেস্ট এবং ঘরে যথেষ্ট পরিমাণে আলো-বাতাস খেলা) উপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। (চ) ভ্যাক্সিন সাম্য চাই। (ছ) এনডেমিক হলে ভাইরাস দুর্বল হবে এ ভ্রান্ত ধারণার অবসান হতে হবে।
এ প্রবন্ধের উপসংহারে বলা হল – “Thinking that endemicity is both mild and inevitable is more than wrong, it is dangerous: it sets humanity up for many more years of disease, including unpredictable waves of outbreaks. It is more productive to consider how bad things could get if we keep giving the virus opportunities to outwit us. Then we might do more to ensure that this does not happen.”
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত “ফ্রম ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজম টু ভ্যাক্সিন ইক্যুইট – ফাইন্ডিং এ পাথ ফরওয়ার্ড’ শিরোনামের প্রবন্ধে (৮.০৪.২০২১) বলা হয়েছে – যা পাবলিক গুডস হবার কথা সেগুলোকে হাঁ-মুখ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নিত্যনতুন পণ্য হিসেবে মুনাফার সামগ্রী করে তোলে। এমনকি করোনা অতিমারির আর্ত সময়ও এর ব্যতিক্রম নয়।(ভ্যাক্সিন অসাম্য – সৌঃ ফিনান্সিয়াল টাইমস)
ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় (নভেম্বর ৩০, ২০২১) প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল “দ্য ইনসাইড স্টোরি অফ দ্য ফাইজার ভ্যাক্সিনঃ এ ওয়ান্স-ইন-অ্যান-এপোক উইন্ডফল”। সংবাদে জানানো হল – “অ্যালবার্ট বোরলা (Albert Bourla) (যিনি ফাইজার কোম্পানির CEO) বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন চিফ এক্সিকিউটিভ হয়েছেন। যেহেতু টিকার ফলে বেশ কিছু দেশ এই গ্রীষ্মে তাদের অর্থনীতির দরজা আবার খুলে দিতে পেরেছে এজন্য ফাইজারের ‘বস’ কর্নওয়ালে জি-৭ সম্মেলনে জুন মাসে যোগ দিয়েছেন, তাঁর প্রাইভেট প্লেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের প্লেনের পাশেই পার্ক করা ছিল। কয়েক সপ্তাহ পরে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক্সে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিডে তাঁকে স্বাগত জানান। সরকারি আধিকারিকেরা স্মরণীয়কালের মধ্যে স্মরণ করতে পারছেননা যে কোন কর্পোরেট লিডারকে রাজকীয় আকাসাকা প্যালেস গেস্ট হাউসে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ৫৯ বছর বয়সী গ্রিস-জাত “অ্যালবার্ট”কে তার “ভালো বন্ধু” বলে অভিহিত করেছেন।” আরও জানানো হল – “প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের একটি বড়ো অংশ ইমেল, টেক্সট কিংবা ফোনে তাদের চাহিদামতো ভ্যাক্সিনের জন্য বোরলার সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করে গিয়েছেন, কিছুক্ষেত্রে নিজেদের রাজনৈতিক কেরিয়ার বাঁচাতে পারবে এই উদ্দেশ্যে। যদিও ইজরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানায়াহু নির্বাচনে হেরে গেছেন কিন্তু এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে একদম প্রথম নামটি ছিল তাঁর। তিনি ৩০বার বোরলার সাথে ফোনে কথা বলেছেন।” বিপরীত চিত্র হচ্ছে, আফ্রিকান ইউনিয়ন ভ্যাক্সিন টিমের কোওর্ডিনেটর হাজারবার বলেও ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করতে পারেননি – “আমরা পরিত্যক্ত। অতিমারির প্লাবনে আমরা ডুবে গেছি।”
এ থেকে বোঝা যায়, কর্পোরেট জগতের সাথে রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতা ও নীতিনির্ধারকেরা, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের শেকড় কত দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে। এমনিতেই ফরচুন-৫০০ থেকে প্রকাশিত লিস্ট অনুযায়ী ফার্মা কোম্পানিগুলোর মুনাফার পরিমাণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে সর্বোচ্চ। এই অতিমারি এবং একে মোকাবিলার জন্য ভ্যাক্সিনের ব্যবসা একে অভাবনীয় মুনাফার সুযোগ দিয়েছে।
২০২১ সালে ফাইজার কোম্পানির ভ্যাক্সিন থেকে মুনাফার পরিমাণ ৩৬ বিলিয়ন ডলার, যেখানে মোট মুনাফা হয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। মডার্না কোম্পানি অতিমারিকালে ভ্যাক্সিন তৈরির আগে একটিও ফার্মাসিউটিকাল প্রোডাক্ট তৈরি করেনি। এদের প্রথম প্রোডাক্ট শুধুমাত্র কোভিড ভ্যাক্সিন থেকে মুনাফার পরিমাণ ২০২০ সালে ১৫-১৮ বিলিয়ন ডলার। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত (৩১ জনুয়ারি, ২০২২) “ডোন্ট ওয়রি অ্যাবাউট ড্রাগ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রফিটস হোয়েন কনসিডারিং এ ওয়েভার অন ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস” প্রবন্ধে পরিষ্কার ভাষায় বল হয়েছে – “ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুর ভরকেন্দ্রে রয়েছে ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-এর প্রশ্ন। ভ্যাক্সিনকে করমুক্ত করা হবে কিনা? ভ্যাক্সিন তৈরির প্রযুক্তির হস্তান্তর করা হবে কিনা? কিংবা দরিদ্র দেশেগুলোর জন্য অন্য সংস্কার করা হবে কিনা?” যাদের বিনামূল্যে বিভিন্ন গরীব ও মধ্য-আয়ের দেশে ভ্যাক্সিন সরবরাহ করার কথা সেই কোভ্যাক্স সংস্থা (COVAX) বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চায়না। এর নেতৃত্বে রয়েছে বিল গেটসের সংগঠন। নিয়তির এমন পরিহাস যে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (হু) পলিসি এখন নির্ধারিত হয় প্রধানত ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন, আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চাপে। আবার এই সংস্থাগুলোর প্রধান লগ্নীকারী হল আমেরিকা সহ বিশ্বের সবচাইতে ধনী দেশগুলো যারা কর্পোরেটদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নীচে দাতা দেশগুলোর লিস্ট রয়েছে ছবিতে।
আমরা এক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন-এর অন্তর্ভুক্ত ১৬৪টি দেশের স্বাক্ষরিত Agreement on Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights (TRIPS)-এর কথা স্মৃতি থেকে উদ্ধার করব। এবং সেসময়ে ভারতবর্ষ জুড়ে TRIPS-বিরোধী অসংখ্য আন্দোলন, লেখালেখি এবং গবেষণাপত্রের কথা স্মরণে রাখব। ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়ার একান্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ ইমাটিনিব যা বহুজাতিক সুইস কোম্পানি নোভার্টিস ভারতে ১,০০,০০০ টাকারও বেশি দামে বিক্রি করত, সেই একই ওষুধ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করে খরচ পড়ে ১০,০০০ টাকারও কম। TRIPS-এর সুযোগ নিয়ে এরকম মুনাফা চলত। শেষ অবধি ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে দেশীয় কোম্পানি এ ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করার অধিকার পায়। সমধর্মী একটি ছোট ভারতীয় উদাহরণ হল আদানির মালিকানায় থাকা মুম্বাই এয়ারপোর্টে RT-PCR পরীক্ষা করার খরচ ৩৯০০ টাকা, যেখানে বাইরের প্রাইভেট সংস্থায় এ খরচ ৩০০-৫০০ টাকা। নীচের ছবি থেকে TRIPS থাকা বা না থাকার গুরুত্ব বোঝা যাবে।
(সৌঃ টাইমস অফ ইন্ডিয়া। কোভিড ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে এই বিতর্কই নতুন করে দানা বেঁধেছে।)
(বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দাতা দেশ ও সংগঠন)
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এর পূর্বোক্ত প্রবন্ধে বলা হয়েছে – “it is far from clear that the drug industry is focused on the most needed new products. Only around 2–3% of new drugs represent important breakthroughs and around 9–11% offer a modest advantage over existing treatments. Conversely, while many products offer little benefit, other crucial research is neglected by the industry: for instance, despite the urgent need for new products to counter the threat of antimicrobial resistance, development pipelines are largely empty and the few new products have relied on public sector support rather than pure market forces. But hasn’t the drug industry been critical for rapid vaccine development in the ongoing covid-19 pandemic?”
আরও বলা হয়েছে – “This debate rose high on the global policy agenda after President Joe Biden showed support for a temporary waiver on covid-19 vaccine intellectual property rights. He has now been backed by the US Senate and joined by others ranging from the World Health Organization to the UK’s Independent Scientific Advisory Group for Emergencies, Médecins Sans Frontières, and even the pope. Yet, half a year later, some European countries remain obstinately opposed, and the head of the World Trade Organization has warned that negotiations were “stuck … Predictably, the drug industry has held that a waiver would reduce the profits that incentivise new drug development. Emergence of the omicron variant, however, shows the risks of the status quo: maximising vaccination is not only a moral necessity but also a potential bulwark against the evolution of other variants that might be even more contagious, virulent, or immune evasive. Moreover, we argue that a waiver would not threaten future drug development, primarily because the link between profits and innovation is tenuous, and public sector contributions are already a major driving factor in much of the innovation that most benefits public health.”
স্মরণে রাখতে হবে, কোভিড ভ্যাক্সিন প্রস্তুতের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার জনতার ট্যাক্সের টাকা থেকে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার লগ্নী করেছে। জনতার অর্থ লগ্নী হচ্ছে, বিপরীতে মুনাফা যাচ্ছে দানবীয় কর্পোরেটদের হাতে। অথচ ডিসেম্বর, ২০২১-এর হিসেব অনুযায়ী “So far, 66 per cent of people living in G7 countries have had two vaccine doses; in Africa, only 6 per cent.”
(আফ্রিকার ভ্যাক্সিনের প্রতীকী চিত্র – সৌঃ ফিনান্সিয়াল টাইমস)
ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (১ অক্টোবর ২০২১) গবেষণাপত্র “The incalculable costs of tuberculosis”-এ বলা হয়েছে – “Data on tuberculosis financing, however, tell another story. In 2017, an estimated US$10·9 billion was spent on tuberculosis compared with $20·2 billion spent on HIV. The Stop TB Partnership has estimated a $7 billion shortfall in tuberculosis funding per year. In contrast with the estimated $291·1 billion for COVID-19 health spending up to June, 2021, a stark, disease-based inequality emerges … Using an analysis focused on annual mortality risk changes for 120 countries, the authors estimate a business-as-usual scenario of 31·8 million tuberculosis-related deaths between 2020 and 2050, resulting in economic losses of $17·5 trillion.” ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে যেখানে রোগীর সংখ্যা ২২ কোটি ৭০ লক্ষ ছিল সে সংখ্যা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ২৪ কোটি ১০ লক্ষ।
আরেকটি তথ্য এখানে উল্লেখযোগ্য। ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (১ জানুয়ারি ২০২২) “To end the neglected tropical diseases”-এ বলা হয়েছে – “Globally, WHO estimates that more than a billion people, approximately one in five individuals, are affected by NTDs. They contribute 19 million disability-adjusted life-years, which represents about 1% of the global burden of disease. Yet, as their name suggests, they have been historically neglected and often relinquished in the global health agenda.”
কোভিডকালে ভারতের চিত্র
বিমলা কুমারী, কল্পনা মেহতা এবং রাহুল চৌধুরী এই তিনজন চিকিৎসক পশ্চিম ভারতের ৪টি হাসপাতালে (যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাথে টারশিয়ারি কেয়ার যুক্ত) লকডাউনের প্রথম ১০ সপ্তাহের (মার্চ ২৫ থেকে জুন ২, ২০২০) গর্ভবতী মায়েদের অবস্থা নিয়ে লকডাউন পূর্ববর্তী ১০ সপ্তাহের সাথে (জানুয়ারি ১৫-মার্চ ২৪, ২০২০) একটি “retrospective analysis” করেন। এঁদের প্রাথমিক বিশ্লেষণে লকডাউন পুর্ববর্তী সময়ের তুলনায় পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার সংখ্যা কমেছে ৪৩.২%, এবং ২০১৯-এর তুলনায় ৪৯.৮%। প্রসূতিকালীন ইমার্জেন্সি রেফার হবার সংখ্যা কমেছে ৬৬.৪%। রোগীরা বহুক্ষেত্রেই আগাম আতঙ্কে হাসপাতালমুখী হচ্ছেনা। কারণ সরকারের তরফে চিকিৎসার সমস্ত সুযোগসুবিধে সরে গেছে কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে, এমনকি হাসপাতালের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাও সাধারণ রোগীর চিকিৎসা করতে অনেকক্ষেত্রেই অস্বীকার করছে। লকডাউনের সময়ে প্রসূতি মায়েদের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশন করে প্রসব করানো ৩৭.০৩%-এ পৌঁছেছে, এ চিত্র প্রাক-লকডাউন পর্বে ৩৩% ছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, হাসপাতালে ভর্তি থাকা গর্ভিনী মায়েদের মৃত্যুর হার। এরসাথে যুক্ত করতে হবে দেহাভ্যন্তরে শিশুর মৃত্যু এবং মৃত শিশু প্রসব হওয়া – লকডাউন পরবর্তী সময়ে এই দুই ক্ষেত্রেই সংখ্যা বেড়ে গেছে। সমীক্ষক চিকিৎসকদের মন্তব্য – “This current study showed a substantial rise in late intrauterine fetal death and stillbirth, along with in-hospital maternal mortality, which might be because of the delayed presentation of women requiring emergency obstetric care … along with the provision of an adequate number of emergency ambulances at primary and secondary health-care facilities for patients in emergency obstetric care requiring urgent referral.”
ল্যান্সেট-এর “Has COVID-19 subverted global health?”-এ ভারতের ন্যাশনাল হেলথ মিশন-এর দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে – মার্চ ২০২০-তে (২০১৯-এর তুলনায়) হাম, মাম্পস এবং রুবেলার জন্য শিশুদের টীকাকরণ ৬৯% হ্রাস পেয়েছে, বিসিজি টীকাকরণ ৫০% হ্রাস পেয়েছে, হাসপাতালে প্রসবের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ২১%, হার্টের অ্যাকিউট সমস্যায় হাসসপাতালে চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসার জন্য আসার সংখ্যা ৫০% কমে গেছে, এবং শ্বাসকষ্টের রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হওয়া কমেছে ৩২%। একইসাথে, আরেকটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হাসপাতালে ক্যান্সার রোগী আসার সংখ্যা কমেছে ৫০%। ভারতের মতো দেশে যেখানে প্রতিবছর ২ কোটি ৬০ লক্ষ শিশু (প্রতিদিন ৭০,০০০ শিশু) জন্মগ্রহণ করে সেখানে শিশুদের ইমিউনাইজেশন বন্ধ বা স্থগিত হয়ে যাওয়া কী মারাত্মক পরিণতির জন্ম দিতে পারে। হারিয়ে যাওয়া রোগগুলো আবার ফিরে আসতে পারে।
Wire.in-এ প্রকাশিত (৫.০৬.২০২০) একটি খবরের শিরোনাম “Rajasthan” TB Services Hit as Staff, Diagnosis Machines Diverted to COVID-19”। এই খবর অনুযায়ী ২০১৭ সালে রাজস্থানে সরকারী হিসেব অনুযায়ী টিবি রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৮ হাজার। ২০১৮-তে সে সংখ্যা বেড়ে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার, ২০১৮-তে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার। ২০১৯-এর হিসেব পাওয়া যায়নি।
এরকম একটা প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে আজকের করোনা অতিমারি যে বিশ্ব পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে তা বুঝতে সুবিধে হবে। ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (জুন ১৫, ২০২০) একটি প্রবন্ধে (“COVID-19: rethinking risk”) যা বলা হল তার মূল কথা – করোনা অতিমারিতেও সবাই একইরকমভাবে আক্রান্ত হবেনা। যাদের ক্ষেত্রে রোগের সামাজিকভাবে নির্ধারক শক্তিগুলো (social determinants) সঠিকভাবে ফলপ্রসূ হয়না – যেমন, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণী বা যারা চাকরি, বাসস্থান, খাদ্য এধরনের সামাজিক সুযোগ-সুবিধের ক্ষেত্রে বঞ্চিত – তাদের মধ্যে এ রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যাবে। পৃথিবী জুড়ে হয়েছেও তাই। আমেরিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার মতো দেশগুলোতে সর্বত্র একই চিত্র।
করোনা অতিমারির সময়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার মানুষের দৃষ্টিপথ (visibility), শ্রুতি (discernibility) এবং ভাবনার ক্ষেত্রপথের একেবারে বাইরে চলে যাচ্ছে। অতি উচ্চ মুল্যের আইসিইউ পরিষেবা, উচ্চচাপের অক্সিজেনের ব্যবস্থা, ECMO ইত্যাদি জন মানসিকতায় ক্রমশ গ্রাহ্য হয়ে উঠছে, মান্যতা পাচ্ছে। মনে ক্ষোভ পুষে রেখেও সাধারণভাবে মানুষ চাইছে বেশি দামের রেমডেসিভির বা এধরনের দামী ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা – নিতান্ত কমদামের এবং একমাত্র “improved survival” ঘটাতে পারে ডেক্সোমেথাসোনের চিকিৎসা নয়। চিকিৎসকেরাও এই সোশ্যাল সাইকি বা গণমানসিকতার বশে থাকছেন। বাজারের, মিডিয়ার এবং বিজ্ঞাপনের দুর্দমনীয় শক্তি উভয়কেই নিয়ন্ত্রিত এবং প্রভাবিত করছে। ফলে চিকিৎসা আরও বেশি করে হাই-টেক হয়ে উঠছে, ভার্টিকাল প্রোগ্রামের দিকে ঝুঁকছে। এবং ক্রমাগত ঝুঁকবে কেবলমাত্র রোগ-কেন্দ্রিক প্রোগ্রামের দিকে, সামাজিক স্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথের দিকে নয়।
WHO-র বুলেটিনে (অক্টোবর ২০০৮) প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে (“Primary health care comes full circle”) ডঃ হ্যাফডান ম্যালার (১৯৭৩ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত WHO-র ডিরেক্টর জেনেরাল ছিলেন এবং ১৯৭৮-এর ঐতিহাসিক আলমা-আটা স্বাস্থ্য সম্মেলনের প্রধান উদ্গাতা। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য” এবং “comprehensive primary health care”-এর ধারণাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়) যা বলেছিলেন তার একটা অংশ হচ্ছে – ১৯৭৮-এর আগে পর্যন্ত, “ঠান্ডা যুদ্ধ”-র সময়কালে, পৃথিবীতে রোগ-কেন্দ্রিক vertical program প্রধান স্থানে ছিল। আমেরিকা জোর দিয়েছিল ম্যালেরিয়া নির্মূল করার কাজে, রাশিয়া জোর দিয়েছিল স্মল পক্স নির্মূলে করাতে। ১৯৭৮-এর পরে পৃথিবীব্যাপী সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলার জোয়ার আসে। কিন্তু ১৯৭৯ থেকে আমেরিকার নেতৃত্বে আবার রোগ-কেন্দ্রিক vertical program ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কোভিডের পরে আমরা সম্ভবত আবার সেদিকেই ফিরে যাচ্ছি – সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিবর্তে। এবারের ভারতের বাজেটেও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন আছে।
নেচার-এর মতো পত্রিকায় (১৩.০৮.২০২০) বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে “এইডস, ম্যালেরিয়া অ্যন্ড টিউবারকিউলোসিস আর সার্জিং”, অর্থাৎ এইডস, ম্যালেরিয়া এবং টিউবারকিউলোসিস প্রবল গতিতে বাড়ছে। নেচার-এর আলোচিত প্রবন্ধের পর্যবেক্ষণে – “তিন মাসের বেশি সময় ধরে লকডাউন অসংখ্য মানুষকে নন-কোভিড বা কোভিড নয় এমন রোগীরা সাধারণ চিকিৎসার কাছে পৌঁছুতে পারেনি, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একইসাথে নতুন রোগীদের উপসর্গ চিহ্নিতই হয়নি। ফলে চিকিৎসার প্রসঙ্গ আসেনা।” এদের হিসেবে চিন, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে ২০২০ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ২০০,০০০ অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটবে, সাব-সাহারা আফ্রিকায় ২০২০-তে ৭৭৯,০০০ জন মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।”
এদেরকে কে বাঁচাবে? একমাত্র সক্রিয় ও জীবন্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এদের বাঁচাতে পারে। যদি এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা না যায় তাহলে কোভিডে যত মানুষের মৃত্যু হবে তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হবে এ রোগগুলোর জন্য। নেচার-এর উল্লেখিত প্রবন্ধের শেষে মন্তব্য করা হয়েছে – “কোভিড-১৯ সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিয়েছে কয়েক বছরের জন্যতো বটেই, এমনকি কয়েক দশকও হতে পারে।” বলা হয়েছে – “একটি সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে (পড়ুন কোভিড) মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে আরেক সংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ মারা যাচ্ছে সেটা হল এমন এক শেষ হিসেব যা মানুষ কখনো চায়না।”
অথচ মানুষের চাহিদায় কখনোই খুব বিরাট কিছু ছিলনা – সামাজিক ন্যায় এবং স্বাস্থ্যের ন্যায্যতা ছাড়া। সরকারের তরফে প্রয়োজন ছিল স্বচ্ছতার, তাহলে মানুষের আস্থা অর্জন করা খুব শক্ত বিষয় কিছু নয়। সামাজিক ন্যায় এবং স্বাস্থ্যের ন্যায্যতাকে ভিত্তি করে যেগুলো নীতি নির্ধারকেরা ভেবে দেখতে পারতেন সেগুলো হল – (১) কি করা সম্ভব, (২) মানুষের কাছে কোনটা গ্রহণীয়, (৩) সামাজিক ন্যায়, এবং (৪) কোনটা sustainable হবে এবং তাকে গ্রহণ করা।
এখানে ভিন্ন একটি বিষয় আমরা ভেবে দেখবো। প্রথমত, ১৯৭৪-৭৫-এ প্রধানত জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্ত ছুঁয়ে যে ঐতিহাসিক গণ আন্দোলন হয়েছিল এবং ফলশ্রুতিতে জরুরী অবস্থার ঘোষণা আর পরবর্তী নির্বাচনে দোর্দন্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধির পরাজয় – সেরকম কোন ঐতিহাসিক মুহূর্ত কি আমরা বর্তমান অবস্থায় ভাবতে পারি? বোধ করি না। একাধিক বিষয় রয়েছে এখানে। প্রথমত, রাষ্ট্র প্রতিমুহূর্তে “অতিরাষ্ট্র” হয়ে উঠছে – স্বশাসিত গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন সংগঠনগুলো রাষ্ট্রের প্রসারিত শাখা হয়ে যাচ্ছে হয়তো বা প্রতিদিন। দ্বিতীয়ত, সেসময়ের আন্দোলনে মানুষ মানুষের সাথে একসাথে বসে কথা বলতো, একজন মানুষ আরেকজন মানুষের শরীরী ভাষা, প্রতিটি অভিব্যক্তি বুঝতে পারতো, একজন মানুষের উষ্ণতা স্পর্শ করতো আরেকটি মানুষকে। কিন্তু আজকের এই ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় আমরা মুখহীন, অবয়বহীন, মানুষের স্পর্শহীন। ফলে প্রত্যেকেই পুরনো ক্ল্যান বা গোষ্ঠী ভিত্তিক সমাজের মতো আমরা সবাই একেকজন গোষ্ঠীপতি। প্রত্যেকে নিজেদের মতামত এবং ভার্চ্যুয়াল জগত অতি যত্ন নিয়ে রক্ষা করি। এরকম কনটেক্সটে কিভাবে গড়ে ওঠে স্বাস্থ্য নিয়ে দেশব্যাপী গণআন্দোলন? আর এটাতো কোন বিশেষ রাজ্য বা অঞ্চলের সমস্যা নয় – সমস্যা সমগ্র ভারতভূমির। তৃতীয়ত, শিক্ষকেরা এখন “এডুকেশনাল ম্যানেজার” – শিক্ষা থেকে দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে “কেন” প্রশ্নের অস্তিত্ব। “কেন” প্রশ্নের অস্তিত্ব বিলীন হওয়া নিওলিবারাল অর্থনীতির সাথে বিশেষ সঙ্গতিপূর্ণ, পুঁজির পক্ষে অনুকূল।
সায়ান্স-এর মতো বিশ্ববন্দিত জার্নালের সম্পাদকীয়তে (৮.০৫.২০২০) এরকম এক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে শুধুমাত্র কিছু ব্যবহারিক ওষুধ তৈরির পরিবর্তে আমাদের গবেষণার অভিমুখ হওয়া উচিৎ – “’কেন’ এই প্রশ্নকে জিজ্ঞাসা করা (উদাহরণ হিসেবে, এ রোগের প্যাথোফিজিওলজি বোঝার জন্য বুনিয়াদি গবেষণা) এবং কেবলমাত্র “গাদা করে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত” (shovel nready) ওষুধের আবিষ্কারের প্রোজেক্ট বাড়িয়ে চলা নয়।” আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ হল – “কোভিড-১৯ পৃথিবীর কাছে নিয়ে এসেছে একটি পাশবিক পছন্দ (brutal choice) – অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য এবং পাব্লিক হেলথের মধ্যে বেছে নেওয়া।” পৃথিবীর আগামী যাত্রাপথে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেবলমাত্র একটি অধরা আশা হয়ে পড়ে থাকবে হয়তো আমাদের সবার কাছে।
এজন্য করোনা অতিমারির সময়েও মাথায় রাখতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, social determinants of health এবং Sustainable Development Goals-এর মতো অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে, সক্রিয় ও জীবন্ত রাখতে না পারলে আগামী অতিমারির সংক্রমণ কিছুতেই সফলভাবে ঠেকানো সম্ভব নয়। ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (২৬ জুন, ২০২১) একটি প্রবন্ধে (“টাইম টু রিইমাজিন ইন্ডিয়া’স হেলথ সিস্টেম”) সতর্ক করা হয়েছিল – “The outbreak in India highlights the need to separate clinical and public health functions.”
PLoS-এ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় “নিউক্লিয়ার ওয়েপনস অ্যান্ড নেগলেক্টেড ডিজিজেসঃ দ্য টেন থাউস্যান্ড-টু-ওয়ান গ্যাপ”-এ বলা হয়েছিল – “১১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা খরচ হয় তার ১/১০,০০০ ভাগেরও কম খরচে অবহেলিত রোগগুলোকে নির্মূল করা ও বিশ্বের উত্তেজনা কমিয়ে শান্তি রক্ষা করা সম্ভব।”
বিচারের ভার আমাদের ওপরে।
খুব সুন্দর। অনেক নতুন তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ।
Khub bhaalo ebong Prasongik lekha
প্রচুর তথ্য বহুল লেখাটা পড়লাম৷ খুব ভালো লাগলো ৷
১. জয়ন্ত ভট্টাচার্য কে ধন্যবাদ – প্রচুর তথ্য সংগ্রহ ও তার সুন্দর উপস্থাপনার জন্য।
২. আমি অর্থনীতি কম বুঝি এবং রাজনীতি একেবারেই বুঝিনা। তাই ফার্মা কোম্পানির কর্মকর্তার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠতা আমাকে আদৌ ভাবায় না। তাঁরা তো একটা ভ্যাক্সিন তৈরি করেছেন – যেটা মানুষের কল্যাণে আসছে। তাহলে তাদের লাভ হলে আমার ক্ষতি কি ? বরং ঐ কোম্পানি তে কাজ করে বহু মানুষ ও পরিবার খেয়ে পরে বাঁচছে।