অনেকদিন বাদে আজ বিকেলটা ফাঁকা পেয়েছিলাম।অনেকটা পড়ে পাওয়া চোদ্দআনার মতো। কত সন্ধ্যা আর বিকেলবেলাই তো কেটে যায় নিজেদের মতো করে, তার হিসেব আর কেই বা রাখে।
এমনই একটা অকেজো বিকেলে আধঘণ্টা সময় মিলে গেল। আজকের ভাষায় ফ্রি টাইম। একটা ছোট্ট কাজের প্রয়োজনে আসতে হয়েছিল বালিগঞ্জ স্টেশনের পার্শ্ববর্তী বিজন সেতুর কাছের একটি বাড়িতে। ড্রাইভারকে গাড়ি পার্ক করতে বলে নেমে পড়লাম রাস্তায়। অনুভব করলাম কোন কারণ ছাড়াই হাঁটতে শুরু করেছি। না, যেখানে যাওয়ায় কথা ছিল সেইখানে নয়, একটি বিশেষ ঠিকানার উদ্দেশ্যে।
৮সি, একডালিয়া প্লেস। কয়েক পা হেঁটেই বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া গেল।
কিন্তু একি? সন্ধ্যার নিবু নিবু আলোর সিল্যুটে সে ঠিকানা একটা পরিত্যক্ত বাড়ির চেহারা নিয়েছে দেখছি! কবে বদলে গেল এইরকম? সত্যিই অনেকদিন আসা হয় না এই রাস্তায়! সময় সম্ভবত অগ্রাধিকারগুলো বদলে দেয়।
অরিন্দম, আমার ছোটবেলার প্রাণের বন্ধু, এ বাড়ি ছেড়েছে অনেক কাল। ছোটবেলার শহর ছেড়ে এখন অন্য শহরে তার বসবাস। প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার।
কিন্তু ফেলে রেখে গেছে সব স্মৃতিগুলো, কালের প্রভাব উপেক্ষা করেও যা এখনো অমলিন আমার কাছে। আমি, সব্যসাচী আর অরিন্দম তিন স্কুলতুতো অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলাম। পড়াশোনা, খেলাধুলো থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা, সর্বত্রই ছিল আমাদের অবাধ বিচরণ।
৮০র দশকের মাঝামাঝি। দীর্ঘ সময় কেটেছে এখানে।ছিমছাম দোতলা একচিলতে বাগানওয়ালা বাড়ীটাতে, কাকীমার নিশ্চিন্ত প্রশ্রয়ে।
মনে পড়ছে স্কুল থেকে ফেরার পথে ছোট্ট সেই থামওয়ালা গাড়ি বারান্দায় কাগজ পাকিয়ে ফুটবল অথবা ডাইনিং টেবিলে চুটিয়ে টেবল টেনিস খেলার কথা। বড় ড্রইং রুমে বসে মাস্টারমশাইদের গম্ভীরমুখের ক্লাস কিম্বা সাদাকালো টেলিভিশনে ক্রিকেট দেখতে দেখতে খুনসুটি।
আরেকটু এগিয়ে গেলাম বাড়ীটার দিকে। অযত্নে গজানো লতাপাতা আর কাঁটাঝোপ এড়িয়ে ধুলো মলিন গেট টার গায়ে হাত রাখলাম। লোহার গেটটা ঠেলতেই মোরামের চেনা আওয়াজ উঠলো না, শুধু মনে হোল সেই গাড়িবারান্দায় সাদা জামা আর খাঁকি প্যান্ট পরা স্কুলের বাচ্চার দল ফুটবল নিয়ে খেলতে খেলতে বাড়ীর ভিতর ঢুকে পড়লো। ওদের হৈ হৈ হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে রাস্তায়।
নুড়িপথে পড়ে থাকা ওই চকচকে জিনিসটাই বা কি?সব্যর হারিয়ে যাওয়া নাম্বার টেন সিগারেটের প্যাকেটটা?নাকি আমার আর্টেক্স কলমের ক্যাপ? কতকিছু ফেলে গেছি এ বাড়িতে!
ওই তো লম্বা বাদামিরঙা কাঠের দরজাখুলে কাকীমা উঁকি দিয়ে বলছেন, “ছেলের গলার আওয়াজ পেয়েই আমি বুঝে গিয়েছি, তোর জয়েন্টে হয়ে গেছে।”
সব মনে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে পারলেও পাস ওয়ার্ড টা খুঁজে পাচ্ছি না অতীতে ফেরার! সব্যসাচীও এসে খুঁজে পায়নি, ফিরে গেছে। আমিও পাচ্ছি না।যদি সময়টাকে ফিরিয়ে নেওয়া যেতো?
কতগুলো সন্দিগ্ধ চোখ আমায় দেখছে…. একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে সন্ধ্যার আলো আঁধারে আমার হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা!!
কিন্তু ওরা তো কেউ জানে না বয়স বাড়লে মানুষ অতীতে ফেরে, ডুব মেরে খোঁজে হারানো স্বজন…..!
তাই হাঁটতে শুরু করলাম আবার,যে রাস্তা দিয়ে দুই বন্ধু গলা জড়াজড়ি করে যেতাম কাঁকুলিয়ায় সব্যর বাড়িতে অথবা লেকের মাঠে প্যান্ট গুটিয়ে ফুটবল….! অদ্ভুত ভাবে আজ ভর সন্ধ্যাবেলায় একাকী হাঁটতে হাঁটতে আমার ঠিক একই রকম অনুভূতি হচ্ছিল!
কলকাতা শহরের একটা ভালো দিক আছে। শিল্পোন্নয়ন না হওয়ায় বহু এলাকা রয়ে গেছে এখনো ৭০-৮০র দশকে। তাই চালচিত্রটা বদলায় নি পুরোপুরি। না চাইলেও অতীত চলতে থাকে সময়কে অগ্রাহ্য করে।
হালকা হলুদ রঙের রাস্তার আলোতে এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়ে রয়েছে গোটা মহল্লায়। ঠুকঠাক স্যাঁকরার দোকান আর আটার চাকী পেরিয়ে, মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে আড্ডাগুলি এখনো রয়ে গেছে সেই সময়েই। অনতিদূরের আলোকসজ্জিত ঝকঝকে অ্যাক্রোপোলিস মল বা ওয়েস্টসাইডের অহঙ্কার বিন্দুমাত্র বিরক্ত করতে পারেনি ওদের বয়ে চলাকে! জগবন্ধু স্কুলের ভিতরেও চলছে নতুন নাটকের মহলা ।কোন সদ্যকৈশরোত্তির্ণ যুবকের গলায় ভেসে আসছে দ্বিজেন্দ্র লালের চন্দ্রগুপ্ত নাটকের সংলাপ।
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সব্যর বাড়ির সামনে এসে পড়ছি বুঝতে পারিনি। দেখলাম বাড়িটা এক থাকলেও, রঙ পড়েছে নতুন। কিন্তু সব্যরা তো ঠিকানা পাল্টেছে বহুকাল! এখানে যে আর থাকে না, তা তো আমি জানতাম। তবে এসে পড়লাম কি করে?
ঠিক জানি না,বলতে পারবো না এর কারণ।
স্মৃতিই বোধহয় ঠেলে নিয়ে এলো আমায় গোটা পথ। এক বুক নিরাশা নিয়ে ফিরে আসার সময় একবার পিছন ফিরে দেখবার চেষ্টা করলাম, সিগারেট হাতে সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্নমাখা সেই রোগা, চশমা পরা ছেলেটাকে দেখা যায় কিনা?
দেখতে পেলাম না! অজান্তে আমার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে উঠল।
আজকাল বোধহয় স্বপ্নরা আর চোখে বাসা বাঁধেনা!!