প্রথম পর্ব
আমাদের ছেলেবেলায় ফুটবল বলতে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। সদ্য বিশ্বকাপ দেখে উঠে মারাদোনার হ্যাংওভার থাকা সত্ত্বেও, আমাদের স্বপ্নে আসতেন কৃশানু দে – বাঁপায়ে স্বর্গীয় পাস। ফুটবল তখনও কলকাতা লীগ আর আইএফএ শীল্ড – আইলীগ-আইএসএল টাইপের কিছু যে কস্মিনকালেও গজিয়ে উঠতে পারে, সেকথা জ্যোতিষীরাও ভাবতে পারেন নি। তা, সেই আশ্চর্য সময়ে ময়দান-কাঁপানো স্ট্রাইকার ছিলেন চিমা ওকোরি – যেমন প্রকাণ্ড তাঁর শরীর, তেমন পাওয়ার, আর তেমনি তাঁর শটে গোলার মতো জোর – পাশে আমাদের দেশজ বাঙালী ডিফেন্ডারেরা প্রায় লিলিপুটসম দৌড়াদৌড়ি করতেন।
এহেন চিমা ওকোরি একবার সংবাদপত্রের প্রশ্নের উত্তরে নিজের প্রাত্যহিক খাবারদাবারের কথা জানালেন – ঠিক কী কী জানালেন, এখন আর মনে নেই – কিন্তু, শেষটুকু মনে আছে খুব – সেটি একখানা মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল – রোজ – তাও আবার যে-সে নয়, একেবারে বিদেশ থেকে আমদানি করা। এমন প্রচণ্ড স্বাস্থ্যের অধিকারী চিমা ওকোরি রোজ রোজ অকারণ মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল খান!!!
কিন্তু, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? ভিটামিন নিয়ে আমাদের সকলেই কমবেশি অবশেসড – ভিটামিনবহুল খাবারের প্রতি সকলেরই বাড়তি আগ্রহ – আর মাঝেমধ্যে বাড়তি ভিটামিন যে বাড়তি উপকারে আসবে, এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে কি??
এ তো শুধু এদেশের নয় – খাস বিদেশেও ভিটামিন নিয়ে আমজনতার আগ্রহ প্রবল – শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ভিটামিন সাপ্লিমেন্টের ব্যবসা বার্ষিক আটাশ বিলিয়ন ডলারের – ভারতীয় মুদ্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকার আশেপাশে – এদেশের তুলনীয় তথ্য পাওয়া অবশ্য মুশকিল – তবে, অঙ্কটা খুব কম হবে না, সম্ভবত।
ছেলেবেলা থেকেই জীবনবিজ্ঞান বইয়ে ভিটামিন বিষয়ে জেনে পড়ে আসছেন – কাজেই, ভিটামিন কয় প্রকার, কোনটি জলে গুলে যায় আর কোন কোনগুলি স্নেহজাতীয় পদার্থে দ্রবণীয়, সেই ফিরিস্তি দিতে বসব না। এমনকি, ঠিক কোন ভিটামিনের অভাবে স্কার্ভি হয়, আর কোনটি কম পড়লে বেরিবেরি – তেমন ক্যুইজ ধাঁচের প্রশ্ন করে আপনার সাধারণ জ্ঞানের পরিচয় নেওয়াও আমার উদ্দেশ্য নয়।
মোটের উপর, একথা সবাই জানেন, আমাদের শরীরের ভিটামিন প্রয়োজন – শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কাজকম্মে ভিটামিন জরুরী – এবং, ভিটামিন এতখানিই অপরিহার্য, যে, জীবনে কোনো কিছুর অপরিহার্যতা বোঝাতে দুটি রাসায়নিকের অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয় – প্রথমটি অক্সিজেন, আর দ্বিতীয়টি ভিটামিন – যেমন ধরুন, প্রাত্যহিক জীবনে অর্থের গুরুত্ব বোঝাতে বলা হয়, ভিটামিন এম (টাকাপয়সার ইংরেজি মানি-র আদ্যক্ষর অনুসারে)।
অতএব, এহেন ভিটামিন যে কারণে-অকারণে একটু-আধটু বেশী খেয়ে বসার প্রবণতা জাগবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে। বিশেষত, ছেলেবেলার জীবনবিজ্ঞান বইয়ে ভিটামিনের অভাবঘটিত রোগের লম্বা ফিরিস্তি থাকলেও, ভিটামিন বেশী হয়ে কী কী সমস্যা হতে পারে, সে নিয়ে উল্লেখ ছিল সামান্যই। কাজেই, ভিটামিনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা থেকে ভয়ানকরকমের অ্যানিমিয়া, প্রাণঘাতী স্কার্ভি, পঙ্গু করে দেওয়া রিকেট – আপনি খবর রাখেন সব। আর অতদূর যাওয়া দরকার নেই – ভিটামিনের অভাবে একেবারে জটিল রোগ বাধানোর চাইতে ঢের বেশী সম্ভাবনা খুচরো অসুবিধেয় ভোগা – অন্তত আপনার ধারণা তেমনই – শরীরটায় তেমন জুত নেই, দুর্বল লাগছে, রোজকার কাজে এনার্জি পাচ্ছেন না – আপনি জানেন, একটু ভিটামিন দরকার – টিভিতেও বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় তেমনই – কাজেই, মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল আপনি খেয়ে থাকেন – একেবারে নিয়মিত না হলেও, মাঝেমধ্যে তো বটেই।
আর এখন তো মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়ার জন্যে নতুন যুক্তিও হাজির – জানেনই তো চারপাশে ক্যানসার বাড়ছে প্রবলগতিতে – চারপাশে দূষণ, বাতাসে বিষ, খাবারে, জলেও – আপনি নিয়মিত কাগজে-ম্যাগাজিনে স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখালেখি পড়েন, টিভিতেও তদসংক্রান্ত আলোচনা শোনেন – সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনি অবশ্যই জানেন, আমাদের শরীরে তৈরী হচ্ছে প্রচুর ফ্রী র্যাডিকাল – এক বিপজ্জনক পদার্থ – যা কোষের উপর ফেলছে ভয়ানক প্রভাব, ভেঙে বা বিকৃত করে দিচ্ছে আমাদের ডিএনএ – ক্যানসার তো আসে এপথেই – অন্তত, ক্যানসার বাড়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা বড় কারণ এটা।
না, আপনি ভুল কিছু জানেন না। শুধু ক্যানসারই বা কেন, আমাদের অনেকগুলো অসুখবিসুখের পেছনেই এই ফ্রী র্যাডিকালের ভূমিকা – ফ্রী র্যাডিকাল জারণপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের বেশ কিছু অপকার করে থাকে তো বটেই – শহুরে দূষণের চোটে বয়সের আগেই আমাদের বুড়িয়ে যাওয়ার পেছনেও ফ্রী র্যাডিকালজনিক জৈবরাসায়নিক ক্রিয়ার প্রভাব কম কিছু নয় – হালে এপ্রসঙ্গে একখানা শব্দ বেশ ফ্যাশনেবল হয়ে উঠেছে – অক্সিডেটিভ স্ট্রেস।
তাহলে এই ফ্রী র্যাডিকালের বাড়াবাড়ি উপদ্রব থেকে বাঁচার উপায় কী? প্রথম এবং সর্বোত্তম উপায়টি আমার বা আপনার হাতে নেই – অর্থাৎ দূষণ নিয়ন্ত্রণ। বিভিন্ন প্রসঙ্গে আগে অনেকবার বলেছি, আমজনতার স্বাস্থ্যই বলুন, বা ক্যানসার কমানো – তার সামান্যই আমজনতার হাতে – কিন্তু, অনেকখানিই সরকারের হাতে, যে সরকারকে নির্বাচিত করেন ওই আমজনতা স্বয়ং। প্রথম বিশ্বের দেশগুলো দৈনন্দিন দূষণের পরিমাণ অনেকখানিই কমিয়ে ফেলেছে বিভিন্ন আইনকানুন করে – আমাদের সেসব দিকে নজর নেই। না, বিশ্বাস করুন, প্রথম বিশ্বের সাথে নিজেদের তুলনা করতে গেলেই যে যুক্তি আপনি অহরহ দেন – এত পপুলেশন, এই জনসংখ্যা না কমালে কিস্যু হবে না – সেসব আইন এদেশে লাগু করার পথে সে যুক্তি কোনোভাবেই বাধা নয় – অভাব যেটার আছে, সেটা সরকারিস্তরে সদিচ্ছের আর আমার-আপনার স্তরে সচেতনতার। আমি-আপনি বড় সহজেই বুঝে গেছি, মানে, আমাদের বোঝানো গিয়েছে, যে, আমার স্বাস্থ্য বা আমার শরীরের ভালোমন্দের দায় এক এবং একমাত্র আমারই – এবং এই বিভ্রান্তি থেকেই তথাকথিত স্বাস্থ্যসচেতনতার বাজারের এই বিপুল সম্প্রসার। কিন্তু, আজকের আলোচনার মুখ্য উপপাদ্য এটা নয়৷ আজ কথা বলব মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুলের গল্প নিয়ে।
প্রথম পথটি আপনার হাতে না থাকলেও, ফ্রী র্যাডিকালজনিত ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার দ্বিতীয় উপায়টি আপনার হাতে আছে – খাবারের মধ্যে দিয়ে শরীরকে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সরবরাহ করা। একেবারে সাধারণ বুদ্ধিতেই বলে, ফ্রী র্যাডিকাল যদি অক্সিডেশনের মাধ্যমে ক্ষতিটতি করে, তাহলে অস্ত্র হতে পারে তারাই, যারা কিনা এই অক্সিডেশন প্রক্রিয়া থামাতে পারে – অর্থাৎ, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। খাবারের মধ্যে নিয়ে, টাটকা ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস বাড়ালে পেতে পারেন তেমন সুরক্ষাকবচ।
কিন্তু, সেটা যদি আপনার দ্বারা হয়ে না ওঠে, তাহলে? হ্যাঁ, এইখানেই ওষুধকোম্পানির দক্ষ বিপণনকর্তারা আপনাকে বুঝিয়ে উঠতে পেরেছে, পরীক্ষা-বৈতরণী পার হতে যেমন অমুক প্রকাশনীর সহায়িকা মাস্ট, ঠিক তেমনই সুস্থ-সবল-নীরোগ থাকতে হলে ওই মাল্টিভিটামিন-মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ক্যাপসুল জরুরী।
অবশ্য, আপনাকে দুষে আর লাভ কী?
খোদ লিনাস পলিং অবধি খাবারের পরেও বাড়তি ভিটামিনের কার্যকারিতায় অগাধ আস্থা রেখেছিলেন – শুধু আস্থা নয়, বাড়তি ভিটামিন সি-কে প্রায় সর্বরোগহর মির্যাকল বলে বিশ্বাস করেছিলেন – এবং, জীবনের শেষ এক দশকেরও বেশী সময় ধরে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, খাবারের পরে ভিটামিন সি ট্যাবলেট, ঠাণ্ডা লাগা থেকে ক্যানসার, ঠেকিয়ে রাখতে পারে সর্বপ্রকার অসুখবিসুখ।
হ্যাঁ, সেই লিনাস পলিং, পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি যিনি কিনা পেয়েছেন নোবেল প্রাইজ এককভাবে দু-দুবার – আরো তিনজন ব্যক্তিমানুষ একাধিকবার নোবেল পুরস্কার পেলেও অন্তত একবার পেয়েছেন কারো না কারো সাথে যৌথভাবে – সেহেন বিজ্ঞানীও বাড়তি ভিটামিনের গুণাগুণ বিষয়ে ছিলেন নিশ্চিত – এবং এমন সব পথে সে বিশ্বাসকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যে, বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর সম্মানের আসনটিই নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল।
(চলবে)
দারুন শুরু
অসাধারণ কনটেন্ট, খুব উপকৃত হলাম, বহু মানুষ সচেতন হবেন, অসংখ্য ধন্যবাদ. পরবর্তী র অপেক্ষায় রইলাম.
ওনার লেখার হাত খুবই বলিষ্ঠ ,চিকিৎসক ও মানুষ হিসেবেও উনি অনন্য ।আমি ওনার গুণগ্রাহী । আবারও সম্বৃদ্ধ হলাম ।