পূর্ব প্রকাশিতের পর
ভিটামিন যে শরীরের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ, সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ভিটামিনের অভাবজনিত অসুখবিসুখ দুশো কি পাঁচশ বছর আগে হত, এইসব বিলুপ্ত অসুখগুলো স্রেফ ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে জানা জরুরী, ব্যাপারটা ঠিক এমন নয় – হ্যাঁ, এ রোগগুলো কিছুটা কমেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু দুনিয়া থেকে উবে যায়নি। অবশ্য, অপুষ্টি বা খাদ্যগুণের অভাব ইত্যকার গরীব মানুষের রোগটোগ নিয়ে আমাদের জানার ইচ্ছে ইদানিং কমে আসছে, কাজেই এসব নিয়ে ভাবাটাই কমে গিয়েছে। যদিও খেতে না পাওয়া মানুষের মধ্যে ভিটামিনের অভাব বেশ ভালোরকম বেশী দেখা যায়, তবুও মনে রাখা যাক, ভিটামিনের অভাব সবসময়ই অপুষ্টির সাথে জড়িয়ে থাকবে, এ নিশ্চয়তা নেই। ভিটামিন এ-র ঘাটতির কারণে রাতকানা রোগ এই বছরকয়েক আগেও এদেশে বেশ নিয়মিতভাবে চোখে পড়ত, এদেশে নিবারণযোগ্য অন্ধত্বর প্রধানতম কারণ ছিল ভিটামিন এ ডেফিসিয়েন্সি – প্রতিটি বাচ্চাকে ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট দিয়ে, হাম হওয়ার পরে বাড়তি ভিটামিন এ-র বন্দোবস্ত করে অবস্থা অনেকটাই সামাল দেওয়া গেছে, তবু পুরোপুরি উবে যায়নি। ভিটামিন সি-র অভাবে স্কার্ভি যত নাবিক বা নৌসেনার মৃত্যুর কারণ হয়েছে, আর কোনো বিশেষ একটি অসুখ তেমন করে হয় নি। ভাস্কো-ডা-গামা নিজের ভাইকে হারিয়েছিলেন এই স্কার্ভি রোগে। আশেপাশে মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত রোগীদের রক্তে ভিটামিন ডি লেভেলটা আজকাল ডাক্তারবাবুরা মাঝেমধ্যেই পরীক্ষা করে দেখলেও, খুব অপুষ্টিতে ভোগা শিশু বা অন্য কোনো জটিল অসুস্থতা বাদ দিয়ে ভিটামিন ডি-এর অভাবজনিত রিকেট আজকাল খুব সুলভ নয়, একেবারে দুর্লভ এমনও নয় – কিন্তু, বাড়ন্ত বয়সের বাচ্চাদের রিকেট বা তার পরবর্তী বয়সের অস্টিওম্যালাসিয়ার কথা সবাই জানেন। ভিটামিন বি-ওয়ান-এর অভাবঘটিত বেরিবেরি অসুখ – যা ছিল একসময় রীতিমতো প্রাণঘাতী – এখন বিরল। কিন্তু, ওই বি গ্রুপের ভিটামিনের অভাবেই মুখের কোণায় ঘা, বা জিভে ঘা – আকছারই দেখা যায়।
কাজেই, প্রশ্নটা কখনোই ভিটামিনের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নয় – লিনাস পলিং-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যে সব চিকিৎসকরা লাগাতার ভিটামিন মেগাডোজ বা অকারণ নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্টের বিরুদ্ধে বলে চলেছিলেন, তাঁরাও জানতেন ভিটামিন বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাবজনিত অসুখগুলোর খবর। প্রশ্নটা ছিল, বাড়তি বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিটামিন খেয়ে চলাটা কাজের কিনা।
আগেই বলেছি, ক্লিনিকাল ট্রায়ালে যাচাই করে দেখা গেল, না, বাড়তি ভিটামিন সি দিয়ে ঠান্ডা লাগা, সর্দি-জ্বর কিম্বা ক্যানসার – কোনোটাই ঠেকানোও যায় না, সারানোও যায় না। অতএব, চিকিৎসকরা পলিং-এর দাবীকে খুব গুরুত্ব কখনোই দেন নি – কিন্তু, রোগীদের দাবী মেটাতে ভিটামিন সি প্রেসক্রাইব করা ছাড়া পথ কী!!
ইতিমধ্যে, পলিং-এর সাধের ইনস্টিটিউট অফ অর্থোমলিকিউলার মেডিসিন-এ বসে, ভিটামিন প্রস্তুতকারক সংস্থার স্পনসরশিপে চলা প্রতিষ্ঠানের ল্যাবে গবেষণা করে, পলিং-এরই বাছাই করা গবেষক আর্থার রবিনসন যে কথাটা তুলে ধরলেন, সে ভারী ভয়ানক ব্যাপার। হোক না ইঁদুরের উপর গবেষণা – বাড়তি ডোজে ভিটামিন সি ক্যানসার ঠেকানো বা সারানো দূরে থাক, নিজেই ক্যানসারের কারণ হয়ে উঠছে – পলিং-এর দাবী কিম্বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের মুখ্য স্পনসরের বাণিজ্যিক স্বার্থের পক্ষে এর চাইতে ড্যামেজিং তথ্য আর কী-ই বা হতে পারে!! কাজেই, পলিং যে চটবেন আর তাঁর ইনস্টিটিউটের বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স যে রবিনসনের পিছনে হাত ধুয়ে লেগে পড়বেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ আছে কি??
কিন্তু, এখানে একটু থামা যাক। আসুন, একটু ভেবে দেখি – ঠিক কেন পলিং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, যে, ভিটামিন সি বেশী ডোজে খেলে ক্যানসার সেরে যেতে পারে? আর যা-ই হোক, লিনাস পলিং তো ঠিক বাবা রামদেব বা সদগুরু গোত্রে পড়েন না (অবশ্য একবিংশ শতকের ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় বিজ্ঞান কংগ্রেস অথবা চিকিৎসকদের সম্মেলনে বক্তা হিসেবে এনারা, যাকে বলে, হাই ইন ডিম্যান্ড) – তিনি বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের চিন্তাপদ্ধতি তাঁর প্রায় সহজাত – তাঁর দাবীর পিছনে তথ্যপ্রমাণ যদি না-ও থাকে, তত্ত্বগত কিছু যুক্তি, কিছু লজিক তো থাকবে – তাই না??
হ্যাঁ, পলিং-এর বক্তব্যের পিছনে তত্ত্বগত যুক্তি ছিল – সেই যুক্তি শরীরের ভিতরকার রাসায়নিক প্রক্রিয়ার যুক্তি – শরীরের ভিতরে লাগামছাড়া জারণ প্রক্রিয়া বা অক্সিডেশন থেকে উদ্ভূত বিপদ এবং তা ঠেকানোর যুক্তি। একটু বিশদে দেখা যাক।
আমাদের শরীরযন্ত্রটা তো কোনোভাবেই নিখুঁত নয় – অনেক হাজার বছরের বিবর্তনের শেষে যেরকম পথে কাজটা ভালো করে চালানো যায়, সেরকম কেটেজুড়ে ব্যাপারটা চলছে। কাজেই, আমাদের স্বাভাবিক বিপাকপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু গোলমেলে পদার্থ তৈরী হয় – যারা ভারী অস্থির আর ছটফটে, নাম ফ্রী র্যাডিকাল – তৈরী হতে না হতেই ছোঁকছোঁক করে, নিজেদের ইলেকট্রনের খামতি মেটাতে গিয়ে কখন পাশের কিছু অণুর সাথে ঝামেলা বাধাবে – তৈরী হওয়ার সাথেসাথেই আশপাশের উপাদান থেকে ইলেকট্রন কেড়ে নিয়ে অক্সিডাইজ করে ফেলে – আর সেই ফ্রী র্যাডিকাল জনিত অক্সিডেশন ব্যাপারটা শরীরের পক্ষে সুবিধের নয় – কোষের পর্দা বা সেল মেমব্রেনের ক্ষতি করে, ধমনীর দেওয়ালের কোষ নষ্ট করে ক্ষত সৃষ্টি করে -এটাসেটা ক্ষতির সাথে সাথে এসব ফ্রী র্যাডিকাল ডিএনএ-কেও ভেঙে দেয়, বা বিকৃত করে দেয়, যার থেকে ক্যানসার হতে পারে। শরীরের স্বাভাবিক বিপাকপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেসব ফ্রী র্যাডিকাল তৈরী হয়, তাদের নির্বিষ করার মতো পাল্টা এনজাইম, বা রাসায়নিক আমাদের শরীরের মধ্যেই থাকে, এবং তৈরী হয় – আমাদের সাধারণ খাবারের মধ্যেও থাকে এই অক্সিডেশন ঠেকানোর পাল্টা অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। কিন্তু, অনেকসময় বাড়তি ফ্রী র্যাডিকাল তৈরী হয়, জমা হয় শরীরে – যেমন, ধূমপানে, আশেপাশের দূষণে (যা এড়ানো কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না), সূর্যালোকের ইউভি রশ্মিতে (আমাদের ত্বকে অবশ্য সে সামলানোর ব্যবস্থা আছে, সমস্যা শ্বেতাঙ্গদেরই বেশী) – মোদ্দা কথায়, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস – শরীরের নিজস্ব ব্যবস্থা বা খাবারে পাওয়া অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যথেষ্ট সামলিয়ে উঠতে পারে না। পরিণামে বয়সের আগেই বুড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্তনালীতে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে পরত জমে যাওয়া, স্মৃতিভ্রংশ, স্ট্রোক, এমনকি ডায়াবেটিস, আর ক্যানসার তো আছেই – এককথায় অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে হতে পারে হাজারো অসুখ।
তাহলে উপায়?
সহজ যুক্তি, ফ্রী র্যাডিকাল বেশী হয়ে গিয়ে অক্সিডেটিভ ড্যামেজ যখন সমস্যার মূলে, তাহলে সেই বিষ ঝাড়ার উপায় – অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। আর, এই সহজ যুক্তির ফাঁদেই পড়লেন লিনাস পলিং। ভিটামিন সি খুব শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট – কাজেই, ফ্রী র্যাডিকাল বেড়ে ডিএনএ-র অক্সিডেটিভ ড্যামেজ থেকে যদি ক্যানসার হয়, তাহলে ভিটামিন সি বেশী করে দিলেই তো সেই ক্যানসার ঠেকানো সম্ভব – হয়ত, সারিয়ে ফেলাও সম্ভব – নয় কি? আর শুধু ভিটামিম সি-ই বা কেন, ভিটামিন ই, বিটা ক্যারোটিন তথা ভিটামিন এ, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সেলেনিয়াম – শরীরে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হিসেবে এর প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে, প্রয়োজনের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশী পরিমাণে এগুলো খাওয়া গেলে, অক্সিডেটিভ ড্যামেজ কিম্বা ক্যানসার – সবকিছু থেকেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব – তাই না?
আর, এই খানেই ভুল হয়ে গেল। মানুষের শরীর সহজ অঙ্ক মেনে চলে না – ইন ফ্যাক্ট, শরীরবিজ্ঞানকে সহজ ম্যাথেমেটিকাল মডেলিং-এ ফেলতে গেলেই এধরণের ভুল হয়ে যায় – কিন্তু, সে এক পৃথক তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়। মোদ্দা কথাটা হল, আমাদের শরীরের ভেতরকার প্রক্রিয়াগুলো একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে। মেলা থেকে কিনে আনা টলমলে পুতুল দেখেছেন (বহুমূল্য খেলনার দোকানেও অবশ্য একই জিনিস মেলে)? অনেকবার অনেকখানি নাড়িয়ে দিলেও সে টলমল করে তার পুরোনো অবস্থানে ফিরে আসে – কিন্তু, নাড়ানোর চোটে ভারসাম্যের কেন্দ্রটা যদি স্থানচ্যুত হয়ে যায়, তাহলে আর পুরোনো অবস্থানে ফিরে আসতে পারে না। আমাদের শরীরখানাও তেমনই। শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবেন তা-ই সয় – কথাটার মধ্যে একটা অনুল্লেখিত ডিসক্লেইমার রয়েছে, হ্যাঁ, সয় অবশ্যই, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে। ফ্রী র্যাডিকাল জনিত ক্ষয়ক্ষতি সামলানোর ব্যবস্থা আমাদের শরীরেই মজুত – এমনকি টুকটাক ডিএনএ ড্যামেজও সামলে নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে – কিন্তু, একটা সীমারেখা অতিক্রম করে গেলে আর সামলে ওঠা সম্ভব হয় না।
ফ্রী র্যাডিকাল ব্যাপারটা ক্ষতিকর তো বটেই, কিন্তু শরীরে তার কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও তো রয়েছে। শরীরের মধ্যে নতুন মাথা চাড়া দেওয়া বিকৃত কোষ, যা কিনা সময়-সুযোগ পেলে ক্যানসারে পরিণত হতে পারে – কিম্বা পলি জমে আটকে থাকা নদীস্রোতের মতো অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসে আটকে পড়া ধমনী – এসব সাফ করে শরীরকে সুস্থ রাখতে ফ্রী র্যাডিকাল জরুরী। শিশু ক্যান্সারকোষকে নিকেশ করা বা আংশিক বদ্ধ ধমনীর মেরামত করে রক্ত সঞ্চালন অব্যাহত রাখা – ফ্রী র্যাডিকাল ছাড়া উপায় নেই। বাইরে থেকে মুঠো মুঠো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট জোগান দিলে, আগে যে কথাটি বলছিলাম, সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যায় – ফ্রী র্যাডিকালজনিত ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা যদিও বা মেলে, অক্সিডেশনের মাধ্যমে যেসব জঞ্জাল নিকেশ হয়, সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অতএব, বেশী বেশী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট খেতে থাকলে, ক্যানসার বা ধমনী বন্ধ হয়ে হৃদরোগের সম্ভাবনা, উভয়ই বেড়ে যেতে পারে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চিরকাল তাত্ত্বিক ভাবনা বা তত্ত্বগত অবস্থান থেকে বাস্তবের ভবিষ্যদ্বাণীর চাইতে বাস্তবের মাটিতে ঘটনাটা ঠিক কীরকম দাঁড়াচ্ছে, তারই গুরুত্ব বেশী। কাজেই, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট দিয়ে ক্যানসার ঠেকানোর প্রত্যাশার চাইতে সে কাজটা যে বাস্তবে আদৌ সম্ভবপর হচ্ছে না, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সেই প্রমাণই বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
আবার, ঠিক তেমনই, এই যে বললাম, অত্যধিক মাত্রায় মাল্টিভিটামিন-অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ক্যানসার বা হৃদরোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে – সেও তো তাত্বিক প্রেডিকশন। বাস্তব কি অতখানিই নিষ্ঠুর, যে শখ করে চাট্টি ভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়ার অভ্যেস থেকে এত বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে??
আর্থার রবিনসন ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে একটা আভাস পেলেন ঠিকই – কিন্তু, ইঁদুর আর মানুষের মধ্যে যে সহস্র যোজন ব্যবধান!!
(চলবে)