শুধু দুটো খবর নিয়ে আজকের লেখার সূচনা। মহারাষ্ট্রে করোনা কেসের সংখ্যা আজ বিগত এক বছরের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, এই প্রথমবার পঁচিশ হাজার সংখ্যাটা ভেঙে দিল কোভিড। একদিনের সংক্রমণেই।
আরেক রাজ্য পাঞ্জাবে কেসের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। কিন্তু যেটা চিন্তার সেখানে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুহার,, যা ছাপিয়ে গিয়েছে প্রথম ইনিংসকে।
শেষ পর্যন্ত নড়েচড়ে বসেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন কিছু কিছু রাজ্যে ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত ব্যবহার নিয়ে! সরকারি বিধি নিষেধ এবং বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সময় আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি।
একদম ঠিক ধরেছেন সবার খারাপ লাগলেও আমি লকডাউনের কথাই বলছি।
যেটা আমাদের সকলের বোঝার দরকার ২০২১-এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে গুটি গুটি পায়ে, টেস্ট ক্রিকেটের ওপেনিং ব্যাটিং-এর মত ভাইরাসের যে উত্থান শুরু হয়েছিল আমাদের দেশে, তা মার্চের মাঝখানে এসেই আচমকা স্লগ ওভারের ঘূর্ণিঝড় শুরু করে দিয়েছে। আর ভয়টা ঠিক সেই জায়গাতেই।
গতবার প্রথম ওয়েভে মহারাষ্ট্রে একদিনে সর্বোচ্চ কেসের পরিমাণ ছিল, ২৪৮৮৬। আর দিনটা ছিল ১১ ই সেপ্টেম্বর। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখছি মহারাষ্ট্রে প্রথম কোভিড রোগী ধরা পড়ে ৯ই মার্চ, ২০২০। আর তার থেকে বেশ কিছুদিন পর, ঠিক ৬ মাস ৯ দিন বাদে দৈনিক কেসের সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছে যায় সেই রাজ্য। সেখানে এই দ্বিতীয় ওয়েভে মাত্র এক মাসের মধ্যেই, দৈনিক সংক্রমণের মাপকাঠি ভেঙ্গে দিল কোভিড। ২৫,৮৩৩ হচ্ছে সেই সংখ্যা।
কেন এমন হচ্ছে? তাহলে হার্ড ইমিউনিটি কি সমাজে এখনো তৈরী হয়নি?
কতটা কাজ করতে চলেছে ভ্যাকসিন?
কোন নতুন মিউটেশন কি এই কান্ড ঘটিয়ে চলেছে?
এই ভাইরাসের সংক্রামক ক্ষমতা কি আগের ভাইরাসগুলির চেয়েও অনেক বেশি?
মারণ হার কি আরও বাড়তে চলেছে এবার?
প্রশ্ন অনেক,কিন্তু উত্তর এখনো কারো কাছে নেই।
যদি ১০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া স্প্যানিশ ফ্লুর ইতিহাসে ফিরে যাই তাহলে দেখতে পাবো, সেবারেও কিন্তু দ্বিতীয় ওয়েভেই মারাত্মক মারণ ক্ষমতা নিয়ে ফিরে এসেছিলো মিউটেটেড ভাইরাস। সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় মানুষ মারা গিয়েছিলেন এই সেকেন্ড ওয়েভে, যার একটা বড় কারণ ছিল মানুষের লাগামছাড়া আচরণ– মাস্ক, সোশ্যাল ডিসটেন্সিং-এর তোয়াক্কা না করা। যেন প্রথম ওয়েভের পর মানুষ ধরে নিয়েছিলেন সেই মারণ রোগ আর ফিরে আসবে না। বেশ কিছুদিন ধরে ঘরে আটকে থাকার পরাধীনতার শৃঙ্খলা ভেঙে সাধারণ মানুষের কাছাখোলা উন্মাদনা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল মিউটেটেড ভাইরাস কে।
আমাদের ভারতেও এই সেকেন্ড ওয়েভে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান সেবার। আর সেই বারেও আমাদের দেশে এই রোগের উৎসমুখ ছিল মুম্বাই শহর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানকারী ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির সেনাদের পায়ে পায়ে মুম্বাই থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই মারণ রোগ, যার দেশীয় নামকরণ হয়েছিল ‘বম্বে ফিভার’।
আর অদ্ভুতভাবে এবারেও মহারাষ্ট্রই নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারতবর্ষে এই অতিমারীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
আমাদের দেশের কয়েকটি রাজ্যে এখন বিধানসভা নির্বাচনের উত্তেজনা চলছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ইলেকশন শুরু হতে চলেছে আমাদের রাজ্যেও। রাজনীতির পারদ চড়ছে ক্রমাগত। এই নির্বাচনের বাজারে কোভিড নিয়ে কারো বিশেষ চিন্তা নেই। প্রচারের সার্চলাইটে এখন শুধুই ক্ষমতা দখলের লড়াই। ভোটের মিছিলে ভীড় জমছে আর গরমাগরম আলোচনায় অতিমারীর স্থান যেন কেবল ইতিহাসের পাতায়। এটাই বিপদসংকেত।
আমাদের কিন্তু মনে রাখতে হবে,সব পার্টির এই জনসভায় ভীড় বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ, মাস্কের অব্যবহার, গলার স্বর চড়িয়ে স্লোগান তোলা সবকিছুই কিন্তু সুযোগ বাড়িয়ে দেবে ভাইরাসকে। ভীড়ের মাঝে কালো মাথার সারির মধ্যেই ডুবে থাকবে কোভিড। ঠিক সময়ে ছোবল মারার জন্য। আর এটাও মনে রাখতে হবে স্প্যানিশ ফ্লুয়ের দ্বিতীয় ওয়েভে সবচেয়ে বেশী মারা গিয়েছিল ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী আর শিশুরা, অপেক্ষাকৃত তরুণ মানুষেরা।
অতএব আবার সময় আসছে সাবধান হওয়ার।
আবার ভয় পাওয়ার।
আবার সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহারের।
এবং অবশ্যই সুযোগ নষ্ট না করে ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়ার। কারণ ভ্যাকসিনই একমাত্র আপনার বাঁচার সম্ভাবনা বাড়াবে, মিউটেটেড ভাইরাসের সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়লেও।
ভালো থাকবেন।