ভুঁড়ি বাড়ছিল|অন্তত মাসখানেক অ্যালার্ম বন্ধ করে আগামী কাল থেকে শিওর উঠবো’র পর মৃন্ময়ী আর আমি দুজনেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম যে এবার শুরু না করলে শিগ্গিরি আমাদের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ্য পরস্পরকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে একটি গোলক সদৃশ বস্তুরূপ ধারণ করবে যেটি বড়ই বেদনার|
-আজকের আউটডোরে কি ওই মোটা ডাক্তারবাবু বসবেন? কিংবাএকজন মোটা করে ভদ্রমহিলা কাউন্টারে ছিলেন কাল| আজ আসেননি?–কেই বা এসব সুমধুর বৃহৎবৃহৎ বিশেষণে আপ্লুত হয় বলুন! অতএব রাত এগারোটার মধ্যে মশারি টসারি গুঁজে আমরা চল্লাম নিদ্রার দেশে|কিন্তু চল্লাম বল্লেই কি তিনি যেতে দেন|এতদিনের মোবাইল ঘষা, ইউটিউব চটকানো নেত্রযুগলে ঘুম আসে কই!! তবে কি জানেন কবি তো কবেই বলেছেন ভীষণ ইচ্ছাদের দাবায় রাখা যাবে না (একথা কোন কবি বলেছেন মনে নেই| কবিরা অনেক কথাই বলেন| সবাই তার খবর রাখবে তার মানে নেই)|
আসল কথা হইলো আমাগের দুর্নিবার ইচ্ছায় অবশেষে নিদ্রাদেবী পরাভূত হইলেন| শুরু হইলো দেবা দেবীর প্রাতঃভ্রমণ|
মর্নিংটা সত্যিই অসাধারণ একটা সৃষ্টি| বিশেষত প্রাক বসন্তে| সকালের দিকটায় এই মফস্বলে হালকা শীত শীত ভাব| নরম আলোয় একধরণের উদাস স্থবিরতা হালকা শিশির ভেজা ঘাসে চুপ করে বসে থাকে| হলুদ বৌ-কথা-কও তিড়িং বিড়িং লাফায়|ঝগড়ুটে শালিক বেস্ততায় খাবার খোঁজে এদিক ওদিক|
নিমাই ধর তার দোকানের সামনেটা ঝাঁট দেয় পরম মনস্কতায়| একটু পরেই সামনের রেলিংগুলি উপচে পরবে কুড়কুড়ে ল্যেস পপকর্নের বাহারি মালায়| বাজারের চায়ের দোকানে সাঁ সাঁ স্টোভ ধোঁয়া ওঠা চা বানায় হাটুরে খদ্দেরদের জন্যে|
পিচরাস্তার কালো ক্যানভাসে ফ্লোরাল আল্পনা আঁকে সজনে ফুল| রেল লাইনের ধারঘেঁষা সুঁড়িপথের ধারে ঝোঁপালো ভাঁটুল তার সাদা ফুলের বুনো মৌতাতে আলোকরে রাখে দুইপাশ| লহমায় চলে যাই ক্লাস ফোর| নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়| রাবণের বাগান|
রাবণের বাগানে আমরা যেতাম বচ্ছরভর| শরতের শিউলী দিনে| বর্ষার ভীষণ সবুজ হয়ে ওঠা অজানা ঝোপ ঝাড়ে| বসন্তের ভাঁটুল গাছেদের বুনো গন্ধ দুপুরে| স্কুলে তখন পাঁউরুটি দিত| চৌকো করে কাটা দুটো পাঁউরুটির টুকরো নিয়ে হাজির হতাম প্লাস্টার উঠে যাওয়া পুরোনো ভাঙা একটা ঘরে|এই ঘরের দেওয়ালে ইঁটের আঁকিবুঁকিতে লেখা থাকত তীর ফুঁড়ে দেওয়া লাভ চিহ্ন, এস প্লাস এম, ইত্যাদি| তার দেওয়ালের দিকে হেলান দিয়ে একটা ভাঁটুল ফুলের বোঁটা থেকে মধু চুষতে চুষতে শুকদেব বলেছিলঃ এই চিঠিটা দিতে পারবি? মৌপ্রিয়ার ব্যাগে?
বাড়িতে তখন চিঠি আসতো দুপ্পুরবেলা পোস্টম্যান গৌরকাকুর সাইকেল ক্রিং ক্রিং ফেলে দিয়ে যেত হলুদ পোস্টকার্ড কিংবা নীল ইনল্যান্ড লেটার|শীতের দুপুরে সেলাই ফোঁড়াইয়ের ফাঁকে চোখে চশমা লাগিয়ে মা পড়তে বসতো চিঠিঃ শ্রী চরণেষু মামা ও মামী| আশা করি আপনারা মঙ্গলময় ঈশ্বরের কৃপায় কুশলেই আছেন|….’
এহেন চিঠি কেন রাখতে হবে মৌপ্রিয়ার ব্যাগে!
শুকদেব অদ্ভুত বিজ্ঞতায় আকাশের দিকে চেয়ে বলেছিলঃ এ হল লাভ লেটার| গার্লফ্রেন্ডকে বয়ফ্রেন্ডরা দেয়|
মৌপ্ৰিয়া আমাদের বন্ধু| সে ফ্রক পরে| তার ঘাড়ের কাছে লেগে থাকে ট্যালকম পাউডার| সে শুকদেবের গার্লফ্রেন্ড| ভাঁটুল ফুলের মত বুনো গন্ধে ভেসে যাচ্ছে ঝাঁঝাঁ দুপুর| আমার হাতে চিঠি| রূপকথার নিষিদ্ধ পুরীর মতন রহস্যময় একটা চিঠি আমার হাতে|
নির্বিকার শুকদেব বসে বসে ভাঁটুলের বোঁটা চুষছে| সে দু তিনবছর ক্লাস ফোরেই আছে| ক্লাসের অঘোষিত মনিটর সে| আমরা দুচারজন তার ফাইফরমাশ খাটতে পারলে কৃতার্থ হই| আজ নিতান্ত দয়া করে চিঠি দেবার মতন একটা মহান কাজ আমার উপর অর্পণ করেছে| চটপট বগলদাবা করে বেরিয়ে আসি রাবণের বাগান থেকে|
কিন্তু কৌতূহল বড়ই বেগবান| সুড়কির রাস্তাটা পার হতে হতেই ইচ্ছে হল দেখি তো কি আছে| পঞ্চায়েতের পাঁচিলের আবডালে খুব সন্তর্পণে ভাঁজ খুলি তার|নিতান্তই সাদামাটা একটা কাঁচাহাতের ভালোবাসি টাসি ছিল, ঠিক মনে নেই| তবে যেটা খুব মনে আছে চিঠির মধ্যিখানে খুব যত্ন করে রাখা ছিল কয়েকটা তাজা ভাঁটুল ফুল| সাদা পাপড়ির মাঝখান ফুঁড়ে বের হয়ে থাকা রক্তাভ পুংকেশর|
কি জানি কেন, খুব হিংসে হচ্ছিল শুকদেবকে| ঐ চিঠি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ছিটিয়ে দিয়েছিলাম ভাঁটুলবাগানে|
সকালে হাঁটতে বেরোলে রেললাইনের ধারের সুঁড়িপথ, অসংখ্য নাম না জানা পাখি, ভাঁটুল জঙ্গল এইসব দেখতে দেখতে হাঁটি| পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় ভোরের পাইকারী হাটফেরত মানুষেরা|
রজনীর দাম আইজ ভালোই পাইছি … কিংবা তোমার পাঁচকাঠাতে কি লাগাবা কত্তা?–এইসব রোজকার কেজো কথা, কর্মব্যস্ত দিনযাপণ দেখি|একবছরের হঠাৎ লকডাউনের কর্মহীনতা কাটিয়ে মানুষ জড়িয়ে পরছে জীবনের ওঠা নামায়| ভালো লাগে। অপাাংক্তেয় ভাঁটুল ফুলের মত এইসব খুচরো যাপণ,অজানা রাস্তায় টুকরো টুকরো বেঁচে থাকা ফুটে থাকুক ভোরের আলোয়|