- পাড়ায় ঢুকেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেছে। টোটো, অটো, সাইকেল, বাইক, মানুষ মিলে জট পাকিয়ে গেছে। কোনও রকমে স্কুটারটা গ্যারেজে ঢোকাই। জমায়েতের লোকজনের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা যায়। ডাক্তার চলে এসেছে। তাঁদের প্রতীক্ষার অবসান হবে। দুয়েকজন ভাবেন হয়ত তাঁদের যন্ত্রণারও অবসান হবে। আমি শঙ্কিত হই। এক জায়গায় ভিড় ফাঁকা করে এলাম, আবার এই ভিড়।
ভিড়ের মধ্যে থেকে পাড়ার দুটো কুকুর চেনা লোক দেখে কাছে আসে। প্যান্ট শোঁকে, খুশি হয়। স্কুটার থামাতেই প্রথম বসন্তের বাতাস আদর করে। সোয়েটার খুলি। পার্থকে বলি, ‘প্রেশার মাপা শুরু করো। আমি আসছি।’
তিন মিনিট আঠারো সেকেন্ডে ভাত খাওয়া শেষ করে রোগীদের মুখোমুখি। অষ্টাদশী রোগিণী ভ্রূলতা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে জানায়, তাকে ঘোড়ায় কামড়েছে।
কোনও কিছুতেই চমকাই না আমি। পৃথিবীর যাবতীয় চমক বহুদিন আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। মেয়েটিই শোনাতে উৎসুক, বসন্তদিনের প্রাক্কালে পরিবার সহ সে গেছিল কলকাতা পরিদর্শনে। সেখানে ভিক্টোরিয়ার সামনে একটি ঘোড়ার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতে গেছিল। সেই অকৃতজ্ঞ ঘোড়া এই নারী নিগ্রহের ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
মেয়েটির বাবা প্রতিবাদ করলেন। বললেন, ‘ওটা খচ্চর ছিল। মোটেই ঘোড়া ছিল না।’
অপমানিত মেয়েটি বলে, ‘ আলবাত ঘোড়া ছিল। তুমি ঘোড়া- খচ্চর কোনোটাই চেন না।‘
‘হুঁ আমি চিনি না, তুই খুব চিনিস।’
আমি বললাম, ‘ঘোড়াই হোক- খচ্চরই হোক, তোকে তো ভ্যাকসিন নিতে হবে। কালকে কামড়েছে। এর মধ্যে তো প্রথম ডোজ নিয়ে নেওয়ার কথা।’
মেয়েটির বাবা বললেন, ‘সেটাই তো দোকানদাররা ঠিক করে বলতে পারছে না। কেউ বলছে ভ্যাকসিন লাগবে, কেউ বলছে লাগবে না। কেউ আবার বলছে কুকুরে কামড়ানোর ভ্যাকসিনে হবে না। ঘোড়ার জন্য আলাদা ভ্যাকসিন।’
আমি বললাম, ‘ভ্যাকসিনটা মোটেই কুকুরে কামড়ানোর ভ্যাকসিন নয়। জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাকসিন। কুকুরে কামড়াক, ঘোড়ায় কামড়াক আর বাঘেই কামড়াক ওই এক ভ্যাকসিন নিতে হবে।
মেয়েটি বলল, ‘এটা আপনি কী বললেন ডাক্তারবাবু, বাঘে কামড়ালে আদৌ কী ভ্যাকসিন নেওয়ার দরকার হবে?’ বলে হাসি শুরু করল।
বসন্তের দিনে বেলা বারোটায় অষ্টাদশীর দন্তরুচিকৌমুদী সকলের মাথার বারোটা বাজানোর জন্য আদর্শ, একমাত্র চিকিৎসকের ছাড়া। ব্যাজার মুখে বললাম, ‘পরের জন।‘
পরের জনের রক্তচাপ অস্বাভাবিক রকমের বেশি। বললেন নিয়মিত প্রেশারের ওষুধ খাচ্ছেন।
‘ওষুধ পত্র দেখান।‘
‘সে তো সঙ্গে আনিনি ডাক্তারবাবু। আপনি নতুন করে সব শুরু করেন।’
সবিনয়ে জানাই আগে কী ওষুধ খাচ্ছেন না জেনে চিকিৎসা অসম্ভব।
ভদ্রলোক বলেন, ‘ ওই যে আমলা… না কী যেন?’
‘আপনি কি আয়ুর্বেদিক ওষুধ খাচ্ছেন? পতঞ্জলি? ‘
‘না না, আমলা…জিন…’
‘অ্যাম্লোডিপিন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটাই সকালে খাই। আর রাত্রে আট… আটা…?’
‘রুটি?’
‘না না, ওষুধ। নামটা…কী যেনো…’
‘বাড়ি কোথায় আপনার?’
ভদ্রলোক জানান, ‘পাশেই, কারবেলায়।’
‘যান, বাড়ি গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসেন। এভাবে আন্দাজে চিকিৎসা করলে আপনার ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী।‘
ভদ্রলোক মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বিদায় নেন। বসন্তের বেলা গড়ায়। লাইনের রোগীদের দেখা হয়। নতুন রোগীরা এসে আবার লাইন করে।
শীর্ণ চেহারার রোগিণী বলে, ‘হাত পা কাঁপে, কাজ করতে পারিনা, উলটে উলটে পরে যাই।‘
‘কত বয়স আপনার? ‘
‘ছাব্বিশ… ডাক্তারবাবু, আমার না… ছেলে হওয়ার সময় সুগার ছিল।‘ মেয়েটি কোলের বছর দেড়েকের ছেলেকে দেখায়।
গৌরকে সুগার মাপতে বলি… ৪৫৬। গৌর চমকায়, আমি চমকাই না।
আমার চমকিত হওয়ার ক্ষমতা বহুদিন চলে গেছে। বলি, ‘বাচ্চা হওয়ার পর সুগার মাপেন নি কেন, ওষুধ খান নি কেন?’
মেয়েটি মাথা নিচু করে। বলে, ‘লক ডাউনে প্রথমে ওর বাবার কাজটা গেল। তারমধ্যেই ছেলে হল। তারপর গতবছর মে মাসে করোনায় লোকটাই চলে গেল। চার বাড়ি ঝি এর কাজ করি। ছেলেকে নিয়েই কাজে যাই।‘
মিন মিন করে বলতে যাই, ‘সরকারি হাসপাতাল তো ছিল।’
আমার আওয়াজ চাপা পড়ে যায়। বাইরে ভোটের মিছিল যাচ্ছে, ‘ভোট দিন, ভোট দিন।’ ঠিক দু’সপ্তাহ পর পৌরসভা ভোট। এই মেয়েটিও ভোট দিতে যাবে। হয়তো বাচ্চাটিকে কোলে করে নিয়েই যাবে।
মেয়েটি তার তাপ্পি দেওয়া চটের ব্যাগটি হাতড়ায়। তারপর ম্যাজিকের মতো সেটা থেকে একেবারে নতুন একটা জুনিয়র হরলিক্সের কৌটো বার করে। বলে, ‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু, বাচ্চাকে ভালোমন্দ খাওয়াতে পারি না। মাসে একটা করে এটা খাওয়ালে হবে? অনেক দাম, একটার বেশি কেনা মুশকিল। ‘
আমি চমকাই না। আমার চমকিত হওয়ার ক্ষমতা বহুদিন নষ্ট হয়ে গেছে।