সকালে হাসপাতালে বেরোতে যাব, মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করলো আচমকাই। উল্টোদিকে এক উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। —“ডাক্তারবাবু আমার স্যাচুরেশন অক্সিমিটারে 69 দেখাচ্ছে। আমার কি এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন?”
—“আপনার কি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?’
— “না। বিশ্বাস করুন আমার কোন কষ্ট নেই।”
—“আর পালস রেট কত দেখাচ্ছে?”
—“98, ডাক্তারবাবু।”
—“তাহলে অক্সিমিটারটিকে এবার ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্য করুন। খুব সম্ভবত আপনি পালস রেট আর স্যাচুরেশন গুলিয়ে ফেলেছেন। বলুন, এবার কত দেখাচ্ছে?”
— “এখন 98 দেখাচ্ছে স্যাচুরেশন আর 69 পালস। আপনি ঠিক বলেছেন ডাক্তারবাবু। আমি বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। স্যরি, বুঝতে পারিনি।” অপরপ্রান্তের কণ্ঠস্বর এবার লজ্জিত।
সারাদিন ধরেই এই রকম প্যানিক কল সামলাতে হচ্ছে ডাক্তারদের। আর হবে নাই বা কেন, পরিস্থিতিটা যে সে রকমই। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত এসে পড়া কোভিড ঝড় এই মুহূর্তে সুনামির মতো বয়ে চলেছে গোটা দেশজুড়ে। প্রথম ইনিংসে দৈনিক সর্বোচ্চ সংক্রমণ যেখানে ছিল প্রায় এক লাখ, দ্বিতীয় ইনিংসে তাকে অবজ্ঞায় পিছনে ফেলে আমরা এখন দিনে চার লাখ সংক্রমণের আশেপাশে ঘুরছি।
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। রোজ সারাদেশ জুড়ে প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি মানুষ মারা যাচ্ছেন এই অতিমারীতে। যেটা লক্ষ্যণীয় বিষয় এই দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম বারের মত বয়স্করা তো বটেই, তার সঙ্গে সমান সংক্রামিত হচ্ছেন কম বয়সের মানুষ। চিন্তিত করার মতো সংক্রমণ এবং মৃত্যু ঘটছে কুড়ি থেকে চল্লিশ বছর বয়সীদের মধ্যে। ডাবল, ট্রিপল মিউটেশন করে রূপ বদলেছে ভাইরাস। বেড়েছে তার সংক্রমণ করার ক্ষমতা।
মারণ হার প্রায় এক থাকলেও, সংক্রামিত অনেক বেশি হওয়ায়, সংখ্যায় মৃত্যুর পরিমাণ বেড়েছে অনেকটাই।
চারপাশে তাই ঘরে ঘরে এখন সংক্রমণ। পাশের বাড়ি থেকে গোটা পাড়া হয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কোভিড। কারো বাড়িতে ঢুকলে প্রায় সবাই সংক্রামিত হচ্ছেন।
আর এবার শুধু কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নয়, জেলায় জেলায় বাড়ছে সংক্রমণ। যেটা এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়ের।
কারণ বেড অথবা অক্সিজেন,অপ্রতুলতা যারই হোক না কেন, শহরের মধ্যে তা নিয়ে লড়াই করা যায়। কিন্তু গ্রামে গঞ্জে অবস্থা আরো করুণ হতে বাধ্য। সেখানে তো স্বাস্থ্য পরিকাঠামোই ভীষণ সীমিত।
তবে লড়ছেন মানুষ। ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের লড়াইটা লড়ছেন হাসপাতালের ভিতর, আইসিইউ অথবা অপারেশন থিয়েটারে।
পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভাররা লড়ছেন রাস্তায়।
অকুতোভয় রেড ভলান্টিয়ার্সরা অক্সিজেনের সিলিন্ডার ঘাড়ে করে পৌঁছে দিচ্ছেন মুমূর্ষু রোগীর বাড়িতে। প্রয়োজনে ভর্তি করার চেষ্টা করছেন হাসপাতালে।
সাধারণ মানুষ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন অতিমারী এবং পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলা বেকারত্বর সাথে।
কোন প্রশংসাই এদের জন্য যথেষ্ট নয়।
হাসপাতালে আমরা যারা সার্জিকাল বিভাগের ডাক্তার, তাদেরকে নিজের কাজ সামলেও, নেমে পড়তে হচ্ছে কোভিড রোগীর চিকিৎসায়।
যে যেরকম ভাবে পারেন বাড়িয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত। মহামারীতে সেটাই দস্তুর।
অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে সবার এই স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান নিশ্চয়ই মনে থাকবে চিরকাল।
আর সারাদিন ধরে আসছে ফোন আর মেসেজ। যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হচ্ছে মানুষকে সাহায্য করার। সঠিক ডাক্তারি পরামর্শ দিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারের। যাতে সবাই মিলে উতরে যাওয়া যায় এই মারাত্মক সুনামি।
তবে এইসবের মধ্যেই ভালো খবর আসতে শুরু করেছে। সারা ভারত জুড়ে সুস্থতার সংখ্যা, সংক্রমিত হওয়ার তুলনায় বাড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। আর এর ফলে কমতে শুরু করবে অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা। মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব সংক্রমণে এগিয়ে থাকা সব রাজ্যই লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এইবার আমাদের সংক্রমণের লেখচিত্র খুব দ্রুত নিম্নমুখী হওয়া শুরু করবে। অনেক সংখ্যাতাত্ত্বিক বলছেন যেহেতু সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখ অনেকটা খাড়া ছিল, নিম্নমুখও ঠিক ততটাই খাড়া হবে। অর্থাৎ খুব তাড়াতাড়ি এই সংক্রমণ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু যেহেতু এই দ্বিতীয় তরঙ্গ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে একটু দেরিতে শুরু হয়েছে, তাই এই রাজ্যে, সংক্রমণ কমার সময় একটু বেশি লাগতে পারে।
যাই হোক না কেন, চারিদিকে এত সংক্রমণ আর মৃত্যুর মধ্যে কোথায় যেন একটা আশার আলো। ঝড় কেটে যাওয়ার আভাস।
তাই সামনের কয়েকটি সপ্তাহে চোয়াল চেপে জারি থাকুক এই লড়াই। ভীষণ দরকার না পড়লে রাস্তাঘাটে না বেরোনোই ভালো। আর বেরোতে হলে খুব সাবধানে। মাস্ক কোন মতেই খোলা যাবে না কোথাও। খুব পরিচিত লোক জনের সাথে কথা বার্তার সময়েও।
জানি সময়টা ভীষণ খারাপ। তবুও সাহস হারাবেন না। অচিরেই এই দুর্যোগের মেঘ আমরা ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারব।
অন্তত আমার সেই রকমই বিশ্বাস।
আবার দেখা হবে অন্য কোনদিন। অন্য কোন লেখায়।
ভালো থাকুন। বেঁচে থাকার লড়াই চলতে থাকুক।