বছরটা তাহলে শেষ হয়েই গেল। সব খারাপ সময়ই তো আর চলতে থাকে না। কষ্ট পেতে পেতে আচমকাই একদিন শেষ হয়ে যায়। অনেক দুঃখ, কষ্ট, বিষাদ আর মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে গেল এই বছর। কত পরিচিত নাম যে মুছে গেল চিরতরে।
বছরের শুরু থেকে অশনি সংকেত ছড়িয়ে, ভাইরাল ফ্লু অতিমারী হয়ে ঘুর্ণিঝড়ের মতো আছড়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর বুকে। প্রথমে অবজ্ঞা করলেও যখন বোঝা গেল দুয়ারে দাড়িয়ে আছে শমন, তখন অনেক দেরি করে ফেলেছি আমরা।ঠিক যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেলো ভাইরাস মানুষের শরীরে ভর করে।
পূর্ব থেকে পশ্চিমে অথবা উত্তর থেকে দক্ষিণে,
যেখানেই উপচে পড়েছে মানুষের ভীড়, সেখানেই বেড়েছে রোগ। বিমানে, বাসে, ট্রেনে মানুষের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে আণবিক ভাইরাস। কপালের ফেরে আমাদের দেশের গ্রামে গঞ্জে ছড়ায় নি কোভিড, ঢুকতে পারেনি এক বস্তি থেকে অন্য বস্তিতে। যার কারণ যদিও এখনো অজানা,
পরে হয়তো কোন বিজ্ঞানী অনুসন্ধিৎসা খুঁজে পাবে তার সন্ধান। তবে আপাতত সেটাই স্বস্তি।
বছরভর ভাইরাসের এই উৎপাতে ক্লান্ত হয়ে পড়া আমাদের মতো চিকিৎসকরা এই মূহুর্তে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছি? কোভিড কি পরিবর্তন নিয়ে এলো আমাদের জীবনে?
উত্তর খুঁজতে গেলে এই সময়টাকে আসুন একটু জড়িপ করে নি। উন্নত পৃথিবী জুড়ে মিউটেটেড ভাইরাস এখন দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে দিয়েছে।বিশেষত ইউরোপে এবং আরো পরিষ্কার ভাবে বলতে গেলে ইংল্যান্ডে। সেখানে মিউটেটেড কোভিড যার পোশাকি নাম B.1.1.7, তার স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন এনে বাড়িয়েছে রোগ সংক্রমণ ক্ষমতা। তা নাকি সাধারণ ভাইরাসের তুলনায় সত্তর শতাংশ বেশী। তবে মারণক্ষমতা কিন্তু একইরকম। এতোটুকু বেশি অথবা কম নয়।
এমনটাই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। আর তা নাকি নজর এড়িয়ে এসে পড়েছে আমাদের দেশেও। তাই আপাতত ইংল্যান্ডকে একঘরে করে দিয়েছে অনেক দেশ। সেখান থেকে আকাশে ওঠা বিমানের উপরেও চাপানো হয়েছে বিবিধ নিষেধাজ্ঞা।
এইক্ষেত্রে আমার প্রশ্নটা খুব সরল। সেপ্টেম্বরেই প্রথম ইউরোপে জানতে পারা যায় এই ভাইরাসের কথা। তারপর অন্তত তিন মাস কেটে গিয়েছে।মিউটেটেড ভাইরাস নিশ্চয়ই এতদিন হাত পা গুটিয়ে বসে নেই। এই ক মাসে ফ্লাইটে মানুষের সাথে সেও নিশ্চয়ই ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।
এখন যেহেতু ভারতের মতো দেশগুলিতে কোভিডের সব টেস্টে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়না, তাই আমাদের দেশে এখনো ঘোষিত হয় নি তার সাড়ম্বর অস্তিত্ব। ইংল্যান্ডে যেহেতু জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রায় সর্বক্ষেত্রেই করা হয় তাই মিউটেশন ধরা পড়ে যাচ্ছে অনেক বেশী। আর শেষমেশ সব প্রাণই তো বেঁচেবর্তে থাকতে চায়।তাই মিউটেট করে চলে ভাইরাস,নিজেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে। এই ভাবেই এমন একটা সময় আসবে যখন সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হয়ে যাবে মনুষ্য সমাজের সেই বহু প্রার্থিত হার্ড ইমিউনিটি। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর অথবা প্রয়োগ বিহীন।মানুষ এবং কোভিড থাকবে পাশাপাশি,শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে। তাই সত্যি কথা বলতে কি নতুন এই মিউটেটেড ভাইরাস সম্বন্ধে আমার অনাবশ্যক দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। কিন্তু আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানী নই, বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করে তার সঠিক প্রয়োগ করি মাত্র। কিন্তু আমার ধারণা ভুল হলে একটু অবাকই হব।
তবে সারা বছর ধরে বেঁধে রাখা এই মুখোশের তলায় চেনা মুখগুলো কেমন যেন হারিয়ে গেল।কারো নাম মনে করলে তার চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ে না এখন। সারাদিন মুখোশচাপা থাকতে থাকতে, মাথা ধরে যায় আমাদের মধ্যে অনেকেরই।
তবে পিপিই-র উৎপাত কমে গেছে এখন। শুরুতে এই পিপিই-র অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেক স্বাস্থ্যকর্মী। এখন কোভিড রোগীর অপারেশন ছাড়া, পিপিই ব্যবহার উঠে গেছে প্রায়।আমরা কোভিড ওয়ার্ডেও শুধু মুখে N 95 চেপেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। আইসিইউ থেকে জেনারেল কোভিড ওয়ার্ড-সর্বত্র। তবে স্যানিটাইজেশন চলছে সর্বক্ষণ। রোগী দেখার আগে ও পরে।
কোভিড নিয়ে নিশ্চয়ই চিন্তা আছে এখনো সবার মনে। তবে সেই প্যানিকটা আর নেই, রোগী বা চিকিৎসক দুতরফেই। বাড়ির আর পাঁচ জনের মধ্যে কারো কারো করোনা হয়ে যাওয়ার দরুণ চট করে আর মানুষ ভয় পাচ্ছেন না। নন কোভিড রোগীরাও অনেক বেশি করে আসতে শুরু করেছেন হাসপাতালে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। মেডিক্যাল কলেজের নতুন ইয়ারের ক্লাস শুরু হতে চলেছে, এটাও একটা ভালো খবর।
তবে এই বছরে, ভাইরাসের আবহে কত মানুষকে নতুন করে চেনা গেল, জানা গেল কত মানুষের সহমর্মিতা। পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই
ক্লান্ত হাঁটাপথে কত সাধারণ মানুষ যে এগিয়ে দিলেন সাহায্যের হাত, জানা গেল তাও।
চিকিৎসক সহ নির্ভীক স্বাস্থ্যকর্মীদের সমাজের আর দেশের প্রয়োজনে এগিয়ে এসে এই লড়াই ইতিহাস হয়ে থাকলো। আমাদের মতো স্বল্প স্বাস্থ্যপরিষেবার দেশে বড় হাসপাতালগুলি তো বটেই ছোট ছোট নার্সিংহোমগুলি যেভাবে বুক চিতিয়ে লড়াই দিল ভোলা যাবে না তাও।
বারবার প্রমাণিত হয়ে গেল বাজেটে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার পিছনে আরো বেশি অর্থলগ্নির প্রয়োজনীয়তা।
আর বিশেষ করে বলতে হবে সেইসব অকুতোভয় পুলিশকর্মী এবং অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারদের কথা।
এইসব দুর্দান্ত লড়াকু অভিজ্ঞতাগুলো নিয়েই না হয় শেষ হোক এই বছরটা।
একটা ছোট্ট খবর পেলাম আজ। দামিনীর গল্প শুনিয়ে ছিলাম বন্ধুদের। হাইওয়েতে সাংঘাতিক এক মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে স্পাইনাল কর্ড ইঞ্জুরি হয় দামিনীর। প্যারালিসিস হয়ে যায় দুই পা, অসাড় হয়ে যায় নিম্নাঙ্গ।অপারেশন থিয়েটারে ভেঙে দুমড়ে যাওয়া মেরুদণ্ড স্ক্রু এবং রড দিয়ে ফিক্স করে দিই আমরা। ভাঙা হাড়ের টুকরো সরিয়ে দেওয়া হয় স্পাইনাল কর্ডের উপর থেকে। কিন্তু আঘাতপ্রাপ্ত নার্ভের ফিরে আসা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। সেটা জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল বাড়ির লোকেদের।
তবে মাস তিনেক আগের ভিডিও কনসাল্টেশনের ছবি অবাক করে দিয়েছিল আমাদের। একটু একটু করে পায়ে জোর ফিরছিল দামিনীর। আমাদেরও আশা বাড়ছিল।
গতকালের ভিডিও দেখে অবাক হয়ে গেলাম।দুর্গাপুরে তার দাদার কাঁধে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটতে পারছে দামিনী। বাঁ পায়ের জোড় প্রায় স্বাভাবিক। ডান পাও অনেকটা ভাল। সাড়ও ফিরে এসেছে বেশ কিছুটা।
বারবার ওরা বলছিলেন ভালো চিকিৎসার কথা।কিন্তু সত্যি বলতে কি, চিকিৎসা নয় এখানে হাল না ছাড়া মানুষের লড়াই আর কিছুটা সৌভাগ্য ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে আসলে যে শেষ কথা বলে কিছু নেই, বারংবারই তা প্রমাণিত হয়। আর এটা বুঝিয়ে দিয়ে যায় যে মানুষের শরীরের সমস্ত রহস্য এখনও বিজ্ঞান ভেদ করে উঠতে পারেনি।
সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠুক দামিনী। নতুন বছরের শুরুতে এটাই আমাদের সকলের প্রার্থনা হয়ে থাক।
তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই আর। ভ্যাকসিন আসুক আর না আসুক আমাদের সবাইকেই চালিয়ে যেতে হবে ছায়াযুদ্ধ, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে। দামিনী যদি পারে আমরাও পারব লড়াই টা চালাতে।
আর লড়াইটা অনেকটা শেষ হয়ে আসছে বলেই আমার ধারণা।
তবে যা শিক্ষা দিয়ে গেল কোভিড, তাতে ভবিষ্যতে মহামারী সামলাবার ভালো ট্রেনিং হয়ে গেল সকলের।
কিন্তু মনে হচ্ছে এবার বেরিয়ে পড়তে হবে কোথাও, ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে, কোন দিকশূন্যপুরের উদ্দেশ্যে। বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এই একঘেয়ে লড়াই লড়তে লড়তে।
ভালো থাকবেন সবাই। আবার ফিরে আসবো নতুন বছরে। শুভ নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা সকলকে।