কাল হরিয়ানা সরকার এক ঝটিতি নোটিশে মেডিকেল পড়াশুনোর ব্যাপারে তাদের ভবিষ্যত ভাবনাচিন্তা জানিয়েছেন, এবং যেটুকু জানিয়েছেন তা ভয়াবহ (গুগল ড্রাইভ লিঙ্ক কমেন্টে)। তা নিয়ে আশঙ্কাজনকভাবে এখনও যথেষ্ট পরিমাণে আলোচনা বা প্রতিবাদ চোখে পড়ল না!
আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে হরিয়ানার যে কোনও সরকারি কলেজে এমবিবিএস পড়তে গেলে নিটে র্যাঙ্ক করে ওঠার পরেও একজন ছাত্র/ছাত্রীকে বেশ কিছু টাকা এবং বাধ্যতার হিসেব মেলাতে হবে।
১. প্রথম থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত যথাক্রমে ৮০ হাজার, ৮৮ হাজার, ৯৭ হাজার এবং ১.০৭ লক্ষ টাকা বার্ষিক ফীজ দিতে হবে! ৩.৭২ লক্ষ টাকা সব মিলিয়ে! র্যাঙ্ক করার পরেও সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার বাধ্যতামূলক খরচ!
২. এরপরের ক্লজ আরও ভয়ঙ্কর। উপরোক্ত এই বার্ষিক ফী এর পরেও একজন ছাত্রকে বার্ষিক দশ লক্ষ টাকা বন্ড হিসেবে সরকারকে চার বছরে মোট চল্লিশ লক্ষ টাকা (ফী এর টাকাটা সহ) বন্ড দিতে হবে। কীসের বন্ড? না এমবিবিএস পাশ করে উঠেই একজন ডাক্তার বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দেবেন সরকারি চাকরিতে। সরকার দু’টি অপশন দিচ্ছে একজন এমবিবিএস পড়ুয়াকে। এক, সে সরকার নির্দিষ্ট কোনও ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে বন্ডের টাকাটা দেবে, এবং তারপর সে সরকারি চাকরিতে যোগ দিলে পরবর্তীকালে সরকার ধাপে ধাপে তার লোন শোধ করে দেবে। দুই, সে নিজের পকেট থেকে টাকাটা দেবে (এবং এক্ষেত্রে সে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য নয়)।
৩. সরকার কত বছর চাকরিতে বাধ্য করছে একজন এমবিবিএস গ্র্যাজুয়েটকে? না, সাত বছর!
৪. একইভাবে বিপুল পরিমাণে বার্ষিক ফী বেড়েছে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটদের ক্ষেত্রেও!
______________________________________________
এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত খুব কিছু আলোচনা বা অসন্তোষ চোখে পড়ল না এখানে। এক ধাক্কায় একটা গোটা রাজ্যের মেডিকেল শিক্ষাকে যে সংখ্যাগুরু মানুষের হাতের বাইরে নিয়ে ফেলা হল, একই সঙ্গে এমবিবিএস স্তর থেকেই বাধ্যতামূলক বন্ড পদ্ধতি চালু করা হল- এই জোড়া কালা কানুনের বিরুদ্ধে যে পরিমাণে আওয়াজ ওঠার দরকার ছিল, কান পেতে তার সামান্যতমও শুনলাম না। তার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটা হল, লোকে যেহেতু অমায়িকভাবে ও সগর্বে ‘অরাজনৈতিক’ তাই তারা প্রাথমিকভাবে একটা সিদ্ধান্তের গুরুত্বই বোঝে না। তারা জানে না, তাই বোঝে না এবং তাই ভাবেও না তাদের ক্ষুদ্রতম গন্ডির বাইরের পৃথিবী ও তার মানুষজন নিয়ে। এখানে সবাই ‘প্রতিবাদহীন’ ‘শান্তিপ্রিয়’ ‘অরাজনৈতিক’ ভালো মানুষ।
ঠিক শ্লেষ মিশিয়ে বলছি না জানেন, মন থেকেই বলছি, এখানে সবাই বেশ ‘ভালো মানুষ’! এবং হঠাৎ করেই খেয়াল পড়ে, আমার রাজ্যের বর্তমান মেডিকেল পড়ুয়ারাও সবাই কী অস্বস্তিকরভাবে শান্তিপ্রিয় ভালোমানুষ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে!
______________________________________________
এই এক মাস আগেই তো ফেসবুকে লড়াই দেখলাম, নতুন মেডিকেল পড়ুয়াকে এস এস কে এম এবং মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন সিনিয়র কনভিন্স করার চেষ্টা করছে কোন মেডিকেল কলেজ সবচেয়ে ভালো। এবং তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইটেরিয়া কী? না কোন কলেজে এক্কেবারে রাজনীতি হয় না! হ্যাঁ ঠিকই তো, তুমি সব ছেড়ে কোনওদিকে না তাকিয়ে নির্বিবাদী হয়ে শুধু পড়াশুনোটুকুই করবে। প্রয়োজনে কিছুটা প্রেম, কিছুটা গেম… বাকিটা ‘ফুটেছে হাসনুহানা’…
কিছু বলতে ইচ্ছে করে না এদের কাউকেই। এদেশের প্রতিটা ক্ষেত্র থেকে সরকার হাত তুলে নিচ্ছে, বিক্রি করে দিচ্ছে প্রতিটি ইঞ্চি, গ্রাম মফস্বলের অতি সাধারণ বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলোর ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন জাস্ট মুখের ওপর ভেঙে দিচ্ছে আর সবাই আজীবন ভালো মানুষ হয়ে বেঁচে থেকে, কী অদ্ভুত উটপাখি হয়ে বেঁচে থেকে একে একে দিন শেষে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে!
এ জিনিস কাল যদি হরিয়ানায় চালু হয় তাহলে সবাই লিখে রাখবেন, পরশু একই জিনিস চালু হবে পশ্চিমবঙ্গে, সারাদেশে। ডাক্তারি পড়তে আসবে শুধু এবং শুধুমাত্র কোটিপতির বাচ্চারা। তারা ক্লিনিকস শিখবে না, একটা রোগের আর্থসামাজিক কারণ শিখবে না, মানুষের অসহায় ক্ষতদাগকে খোঁজার বোঝার ও তাতে মলম দেওয়ার চেষ্টা করবে না! তারা শুধু স্বর্ণ ইমারতে বসে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে শিখবে বড় বড় নামওয়ালা রোগ আর তার অত্যাধুনিক ইনভেস্টিগেশন আর তার চিকিৎসাপদ্ধতি।
এবং তারপর যখন মাটিতে দাঁড়িয়ে এদেশের মানুষকেই চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখবে সে রোগ চিনলেও ‘রোগী’ নামক মানুষটাকেই চেনে না, বোঝে না, তার থেকে এতটাই দূরে বসে থাকছে মানুষ যে ক্রমশ বাড়ছে ভুল বোঝাবুঝি তখন সে নিরুপায় হয়ে অভিমানী হবে, ক্রুদ্ধ হবে, হতাশ হবে…
সব হবে, তবু সে রাজনৈতিক হবে না! যে রাজনীতির ফসল সে, যে রাজনীতির সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তার চিকিৎসাশিক্ষার উপযুক্ত প্রয়োগ, যে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র রাজনীতির ওপর নির্ভর করে তার সারাজীবনের ক্লিনিক্যাল ও নন ক্লিনিক্যাল সিদ্ধান্তগুলো তাদের সব্বাইকে অস্বীকার করে সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী অসহায়ভাবে শুধু ‘অরাজনৈতিক ভালোমানুষ’ হবে! এবং তারপর সক্কলে জীবনের মাঝসমুদ্রে এসে রাত্রিকালীন হাহাকার করব, “তাহলে এত কিছুর পরেও আমরা সবাই এরকম বিকারগ্রস্ত খারাপ আছি কেন, ডাক্তারবাবু?”
‘আমার’ রাজনীতি, ‘ওর’ রাজনীতি করতে হবে না ভাই, শুধু দয়া করে প্রাথমিকভাবে রাজনীতিমনস্ক টুকু হও, তাহলেই হবে। দেশ অথবা রাজ্যের সরকার একখানা দু’পাতার নোটিশে তোমার এবং তোমার মতো আরও লক্ষ ছেলেমেয়ের স্বপ্ন- ভবিষ্যৎ- মাধ্যমিকের রচনার ওপর যখন একমুঠো অন্ধকার ঢেলে দেয় তখন সেই ক্রাইসিসকে আপৎকালীন পদ্ধতিতে চিনতে শেখো, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখো, তাহলেই অনেকখানি।
ভালোমানুষ হয়ে মরে যাওয়ার চেয়ে অন্তত রাজনৈতিক হয়ে বেঁচে থাকা শ্রেয়। এক্ষেত্রে, যদিও তার গ্ল্যামার কম, তবু সিস্টেমশুদ্ধু নিজে ভেন্টিলেশনে ঢুকে যাওয়ার আগে থেকেই যতটা পারা যায় প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের সাহায্য নেওয়াই বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে। ভবিষ্যতের ডাক্তাররা ভেবে দেখবেন একবার?
কিছু কিছু সংগঠন এবং ব্যক্তি প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছে। সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম এবং মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টার প্রতিবাদ জানিয়েছে।
একথা সত্যি সমাজের বড়ো একটা অংশ ( ডাক্তার বাবুরা সহ) ‘ অরাজনৈতিক ‘ বলতে গর্ব বোধ করে ।
প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আজ হারিয়ে যাচ্ছে