অন্য একটা স্বীকারোক্তির গল্প।
সোজাসুজি বলে ফেলি – ডাক্তার হলেও আমার নানা রকমের বদভ্যাস আছে। বলা ভালো, বদভ্যাসই বেশি ভালো অভ্যাসের চেয়ে। ডাক্তারি করতে বসে, ডাক্তারির সাথে সাথে সেইসব বদভ্যাসও প্রাকটিস করে ফেলি মাঝেমাঝেই।
হ্যাঁ, সেসবের পর যখন নিজে নিজে ভাবি, বেজায় খারাপ লাগে। কিন্ত জোর করে নিজের সহজাত বদভ্যাস, এখনো তাড়াতে পারিনি।
প্রথমতঃ বেচাল দেখলেই রোগীকে বকে দেয়া। সে যে বয়সেরই হোক আর যত বড় মাপের মানুষই হোক! দ্বিতীয়তঃ ডাক্তারি করে বাইরে বেরোলে, আমাকে যাতে কেউ ডাক্তার বলে না বুঝতে পারে , তেমন কাজকর্ম করা! (এর মধ্যে এমন অনেক কিছুই আছে, যেটা অনেকে কল্পনাও করতে পারবে না!)
প্রায় প্রত্যেক বার, পেছনে কেউ না কেউ প্রশ্ন তোলে – এ ডাক্তার??
আমিও ভাবি- আমি আদৌ ডাক্তার তো??
যাকগে। এসব বন্ধ হচ্ছে না। হচ্ছে না বলেই, আমিও জোর করে সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার বোধ করি না। ডাক্তারি ডিগ্রি যতক্ষণ বাতিল না হচ্ছে, ততদিন হয়তো এসব চলবে।
এই স্বীকারোক্তিটি করার একটা কারণ আছে। সেটি ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
আমি রোগী দেখতে বসে, প্রায়ই ভুলে যাই, একজন অসুস্থ মানুষ আমার সামনে। সিরিয়াস মুখ করা দরকার। কিন্ত নানা কারণে আমার হাসি পায়! মনে হয়, ভেতরে নাইট্রাস অক্সাইড লিক হচ্ছে!! হতে পারে রোগীর কথা শুনে বা কাজকর্ম দেখে, হতে পারে বাড়ির লোকজনের কথা শুনে বা কাজকর্ম দেখে, হতে পারে সহকারীর কথা শুনে বা পুরানো কোন রোগীর কথা মনে পড়লে!
না, আমি স্ট্যাণ্ড আপ কমেডিয়ান না। কিন্ত ইউএসজি করতে করতে মাঝে মাঝেই যা সব বলে ফেলি বা ভেবে নিই, সেগুলো জোকসের মতোই শুনতে লাগে। অন্ততঃ আমার মতে।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে।
ধরা যাক, অ্যালকোহলিক সিরোসিস এর রোগী বললেন – খালি জল খেতে পারি না।
আমি বললাম – মদের এর সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারবেন?
আরেকজন সেম রোগী বলেছিল – ডাক্তার বাবু, আমি তো মদ ছেড়ে খাওয়া দিয়েছি। এখন কেন সমস্যা হবে?
বললাম- এর আগে আপনি মদ খেয়েছেন, এখন মদ আপনাকে খাচ্ছে!
কেউ হয়তো বললো- খাওয়ার পরই পেট ফুলে যায়।
বললাম – না খেলেই ল্যাঠা চুকে যায়!
কেউ একজন বলেছিল- ডাক্তার বাবু, এতো গ্যাস, কি যে করি এই গ্যাস নিয়ে!
আমি বলেছিলাম- রিলায়েন্সকে খবর দিন!
একজন অলরেডি চার বাচ্চার মা সাত মাসের প্রেগন্যান্ট মহিলা, জিজ্ঞেস করলেন- ডাক্তার বাবু, বাচ্চা কি করছে?
বললাম- কপালে হাত দিয়ে ভাবছে, খেতে পাবে কিনা!
আরেক প্রেগন্যান্ট মহিলা জিজ্ঞেস করলেন- ডাক্তার বাবু, বাচ্চা এতো এদিক ওদিক পাল্টি খায় কেন?
আমি গম্ভীর মুখ করে বলেছিলাম- ভবিষ্যতে রাজনৈতিক নেতা হবে।
রোগীরা ও এমন কথা বলেন যে না হেসে পারি না।
একজন বললো- ছবি করাতে হলে প্রস্রাব ধরে আসতে হবে?
বললাম- সেটা তো পারবেন না! আপাতত প্রস্রাব করবেন না!
একজন রোগী না বুঝে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলেন- কৃমির মুখে পাথর। (আসলে বলতে চান- কিডনিতে পাথর!)
বললাম- কৃমির মুখে পাথর, তো আপনার কি?
যাকগে, এরকম প্রায় দিনই দু’চারটে জোকস হয়ে যায়।
কালও এমনই একখানা খারাপ জোকস বলে ফেলেছি। রোগী বছর পঁচাত্তরের পুরুষ। কমপ্লেইন- প্রস্রাব আটকে যায়।
বললেন- আর কি প্রস্রাব হবে না?
আমি খানিকটা নিচু গলায় অপরাধীর মতো বললাম- এতো বছরে অনেক তো করেছেন! আর না হয় …
দেখলাম প্রস্রাব জমেনি ।
বললাম , বসে থাকুন আর জল খান।
এবার এই ভদ্রলোক, কেন জানি না বেশ খানিকটা খিটখিটে মেজাজের। মুখ ব্যাজার করে উঠে পড়লেন।
সকাল দশটায় এ ঘটনার পর আমি আমি নিজের কাজে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, আমার আর এই রোগীকে দেখা হয়নি।
ঘরে ফিরে এসেছি। তখন বিকেল তিনটে। হঠাৎ তলব পড়লো সহকারীর – স্যার একজন রোগী রয়ে গেছে!
অন্য কারণে মেজাজ খারাপ ছিল। বললাম- বলে দাও, পরে আসতে।
বললো- না স্যার, আসতেই হবে। রোগী সকাল থেকে বসে আছে।
কখনোই কোন রোগীকে এভাবে আমি বসিয়ে রাখি না । তাই আরো খারাপ লাগলো।
বললাম- তো আগে মনে করাওনি কেন?? যাচ্ছি একটু পর।
রোগী সেই থেকে চেঁচামেচি করছে। – ডাক্তার কহন আইবে কইয়া দ্যান! আমাগো ফান্দে ফেইল্যা …
আমি পেছনে দাঁড়িয়ে ফান্দে পড়া মুখ নিয়ে বললাম- ডাক্তার আপনার পিছে দাঁড়িয়ে আছেন!! আসুন।
যাইহোক, ভদ্রলোক টেবিলে শুয়ে পড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। – ডাক্তার বাবু, এক বছর ধইরে পেচ্ছাপ এর সঙ্গে রক্ত যাচ্ছে।
বললাম- পরীক্ষা করাননি কেন?
ভদ্রলোক বললেন- আর কি করমু। আমাগো অবোস্তা কেডা দ্যাহে। টাহা পয়সা নাই।
– আরে বাবা সরকারি হাসপাতালে টাকা লাগে না!!
মুখে বিতৃষ্ণা।
ততক্ষণে পরীক্ষা করতে করতে, ভেতরের গণ্ডগোল দেখতে পাচ্ছি আর আমার ভেতরে এক নির্দয় বিচারক খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে চলেছে। হেসেই চলেছে। সেই ক্রুর হাসি আমার বড্ড চেনা। সে হাসি শোনার পর আমার হাত পা থরথর করে কাঁপতে থাকে। পায়ের তলার মাটি সরে যেতে থাকে। আমি ভেতরে ভেতরে কাঁদতে থাকি অসহায়ের মতো। ক্রমশঃ নিঃশেষ হতে থাকি।
সে হাসি শোনার পর প্রতিবার আমি শুনতে পাই- দেখ ব্যাটা কমেডিয়ান ডাক্তার! খুব তো জোকস বলার চেষ্টা করিস, এইবার হেসে দেখা! মানুষকে নিয়ে জীবনের কমেডি শো-এ কমেডি করেছিস বেশ ভালো কথা, এইবার হেসে দেখা! নিজের জোকস মনে কর! তারপর ভেবে দেখ, তোর নিজের এই অবস্থায় আমি বলবো- অনেক তো প্রস্রাব পায়খানা করেছিস!! আর কেন? কি রে কি হলো? হাসি পাচ্ছে??
স্ক্যান করতে করতে, স্ট্যাণ্ড আপ এক কমেডিয়ান আমি, শেষ বিচারকের সামনে ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে’ র মতো নোনতা চোখের জলে ভিজে যাচ্ছি। নির্জীবের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সহকারীকে বলে চলেছি একজন মানুষের মৃত্যু পরোয়ানার মতো রিপোর্টের শেষ অংশ – Ultrasound reveals – Poorly differentiated transitional cell carcinoma of urinary bladder with involvement of ureters, bilateral pelvis of kidney, rectum, lateral pelvic wall along with hepatic and lymph nodal metastasis .
আর তাকাতে পারি না রোগীর মুখের দিকে। আর জোকস আসে না আমার। এই শো-এ, এই নির্দয় বিচারকের সামনে আমি কোনদিন জিতবো না ভেবে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসতে থাকি মঞ্চ ছেড়ে।
চিরপরিচিত রিয়ালিটি শো-এর সেই নির্দয় বিচারকের স্বর শুনতে পাই- চিত্রগুপ্ত, যা করে চলেছো তাই করো! কমেডি তোমার জন্য নয়!!